ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

হন্তারকদের ফাঁসির রায় কার্যকরে স্বস্তি ভিন্ন আবহ

বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালবাসায় শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালিত

প্রকাশিত: ০৫:৩০, ১৫ ডিসেম্বর ২০১৫

বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালবাসায় শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালিত

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ স্বজন হারানোর বেদনা আর বুদ্ধিজীবী হন্তারকদের ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে রায় কার্যকরের স্বস্তিÑ এই ভিন্ন আবহেই সোমবার জাতির শ্রেষ্ঠসন্তান শহীদ বুদ্ধিজীবীদের শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করল কৃতজ্ঞ বাঙালী জাতি। দীর্ঘ চার দশকের বিচারহীনতার সংস্কৃতি আর দেশী-বিদেশী নানা ষড়যন্ত্রের বেড়াজাল ছিন্ন করে শীর্ষ বুদ্ধিজীবীদের হন্তারকদের বিচারের রায় কার্যকরের তৃপ্তি নিয়েই গোটা জাতি বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালবাসায় পালন করেছে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। দিবসের প্রতিটি কর্মসূচীতে সকল যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তি, একাত্তরের ঘাতক সংগঠন জামায়াত নিষিদ্ধ এবং পরাজিত পাকিস্তানের সঙ্গে সব ধরনের সম্পর্ক ছিন্নের দাবি ছিল প্রচ-। জঙ্গীবাদ-মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িক অপশক্তিকে নির্মূল করার মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশ গড়ার অঙ্গীকার আর যুদ্ধাপরাধীমুক্ত দেশ বিনির্মাণে এবার দিবসটিতে নতুন প্রজন্মের বাঁধভাঙ্গা জোয়ার নেমেছিল সর্বত্র। রাজাকার-আলবদর-আলশামস ও তাদের দোসরমুক্ত বাংলাদেশ বিনির্মাণে যেন একাত্তরের মতোই জেগে উঠেছিল দেশের মানুষ। পথে পথে ছিল নতুন প্রজন্মের বাঁধভাঙ্গা গণজাগরণ। বুদ্ধিজীবী হত্যায় জড়িত আলবদর প্রধানসহ কয়েকজন যুদ্ধাপরাধীর সর্বোচ্চ শাস্তি কার্যকর হওয়ায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলাদেশ গড়ার পথ আরও মসৃণ হওয়ার আশা বুকে ধারণ করেছেন শ্রদ্ধা জানাতে আসা শহীদ পরিবারের সদস্যরাও। শহীদদের শ্রদ্ধাবনত চিত্তে স্মরণের পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধাদের স্বপ্নের অসাম্প্রদায়িক, বৈষম্যহীন ও উন্নত বাংলাদেশ গড়ার দৃঢ়প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন সর্বস্তরের জনগণ। জাতীয় জীবনের বেদনাঘন দিনটিতে রাজধানীতে মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ, রায়েরবাজার বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের শ্রদ্ধা জানিয়েছেন লাখো মানুষ। তাদের হাতে ছিল ফুল, কণ্ঠে ছিল স্বাধীনতাবিরোধীদের মোকাবেলার দৃপ্ত শপথ। বুদ্ধিজীবী হন্তারক যুদ্ধাপরাধীদের প্রতি প্রবল ঘৃণা-ধিক্কার জানানোর পাশাপাশি দেশে-বিদেশে পালিয়ে থাকা সব যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও রায় কার্যকরের দাবিও ছিল প্রচ-। ‘রাষ্ট্রদ্রোহী হায়েনা রাজাকার-আলবদর-যুদ্ধাপরাধী, বাঙালী তোদের ক্ষমা করবে না, তোদের সকলের বিচার হবেই এ বাংলায়’- মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধের প্রবেশ পথেই একটি সাদাকালো ব্যানারে লেখা ছিল এই দীপ্ত শপথের বাণী। শুধু ব্যানার নয়, সোমবার দিনভর হৃদয়ের গভীর শ্রদ্ধা, ভালবাসার সঙ্গে স্মরণ করতে আসা লাখো শোকার্ত মানুষের কণ্ঠেও ছিল সেই একই দাবি। পাশাপাশি স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি ও তাদের মদদদাতাদের প্রতি তীব্র ঘৃণা-ধিক্কার জানিয়েছেন নানাভাবেই। মানুষের বিনম্র শ্রদ্ধায় ফুলে ফুলে ভরে উঠেছিল মিরপুর ও রায়েরবাজার শহীদ বৃদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধের মূলবেদি। এ দুটি স্থানে একাত্তরে পাকহানাদার ও তাদের এ দেশীয় দোসর রাজাকার-আলবদর হায়েনাদের দেশমাতৃকার শ্রেষ্ঠসন্তানদের নৃশংসভাবে হত্যার পর বধ্যভূমিতে ফেলে রাখার অসংখ্য নিষ্ঠুর ও ভয়াবহ আলোকচিত্র এবং প্রতীকী বধ্যভূমি বানিয়ে তা প্রদর্শন করায় শ্রদ্ধা জানাতে আসা লাখো বাঙালীকে শিহরিত করে তুলেছিল। শহীদ পরিবারের সদস্যরা বধ্যভূমি প্রাঙ্গণে এসে স্বজনদের স্মরণ করার পাশাপাশি স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। একই সঙ্গে আলবদর নেতা আলী আহসান মুজাহিদসহ যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তি কার্যকর হওয়ায় স্বস্তি প্রকাশ করেছেন তারা। মিরপুরে শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর শ্রদ্ধা ॥ সকালে মিরপুরে শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করেছেন রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সকাল ৮টা ১ মিনিটে শহীদ বেদিতে প্রথমে রাষ্ট্রপতি ও পরে প্রধানমন্ত্রী পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করেন। শ্রদ্ধা নিবেদন করে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী কিছু সময় নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন। এ সময় বিউগলে বাজানো হয় করুণ সুর। সেনাবাহিনীর একটি চৌকস দল শহীদ বুদ্ধিজীবীদের উদ্দেশে সশস্ত্র সালাম জানায়। এরপর আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হিসেবে দলের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে নিয়ে শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ করেন শেখ হাসিনা। এ সময় তার সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, কেন্দ্রীয় নেতা মাহবুব-উল-আলম হানিফ, আহম্মদ হোসেন, আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বীরবিক্রম, নৌমন্ত্রী শাজাহান খান, বস্ত্র ও পাট প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজম প্রমুখ। এর আগে সকাল ৭টা ৫৫ মিনিটে বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে পৌঁছে প্রথমেই যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা এবং শহীদ বুদ্ধিজীবী পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কুশলবিনিময় করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। স্মৃতিসৌধে তাকে স্বাগত জানান মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক এবং স্থানীয় সংসদ সদস্য আসলামুল হক আসলাম। রাষ্ট্রপতি সকাল ৮টায় স্মৃতিসৌধে পৌঁছলে প্রধানমন্ত্রী তাকে স্বাগত জানান। পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ শেষে রাষ্ট্রপতি যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা এবং শহীদ বুদ্ধিজীবী পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কুশলবিনিময় করেন ও তাদের খোঁজখবর নেন। শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দলের নেতাদের নিয়ে ধানম-ির ৩২ নম্বর বঙ্গবন্ধু জাদুঘরের সামনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতেও পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করেন। সকাল সোয়া ৮টার দিকে জাতীয় সংসদের স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী ও ডেপুটি স্পীকার এ্যাডভোকেট ফজলে রাব্বী মিয়া শহীদে বেদিতে শ্রদ্ধা জানান। তাদের পর ১৪ দলীয় জোটের শীর্ষ নেতারা একে একে শ্রদ্ধা জানান। সাড়ে আটটার দিকে দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করেন প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ। শ্রদ্ধা জানান ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি বিমানমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সভাপতি তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে গণফোরাম, সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া। এরপর যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা, সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামসহ বিভিন্ন সংগঠন শ্রদ্ধা নিবেদন করে। সকাল ১০টা ২০ মিনিটে মিরপুরে শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিস্তম্ভে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। পুষ্পস্তবক অর্পণ শেষে তিনি শহীদদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করেন। এ সময় তার সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব) আ স ম হান্নান শাহ, ড. আবদুল মঈন খান, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, আবদুল্লাহ আল নোমান, আলতাফ হোসেন চৌধুরী, ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর, শামসুজ্জামান দুদু, এজেডএম জাহিদ হোসেন, রুহুল কবির রিজভী, ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন, ফজলুল হক মিলন প্রমুখ। সকালে বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ চত্বরে মানববন্ধন করে সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম। কর্মসূচীতে ১৯৭১ সালে বাঙালীর ওপর পাকিস্তানী বাহিনীর গণহত্যা ও বর্বরতার দায় অস্বীকার করে দেশটির সরকারের দেয়া সাম্প্রতিক বিবৃতিকে প্রত্যাখ্যান করে প্রতিবাদ জানানো হয়। বধ্যভূমির মূলবেদিতে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের শ্রদ্ধা জানিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার ও দেশের প্রথম সেনাবাহিনী প্রধান কে এম সফিউল্লাহ বলেন, কটূক্তি করার জন্য ক্ষমা না চাওয়া পর্যন্ত আমি বলব, পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের সব ধরনের কূটনৈতিক সম্পর্ক বন্ধ করা উচিত। এছাড়াও ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ, আওয়ামী যুবলীগ, আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগ, কৃষক লীগ, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, তাঁতিলীগ, মহিলা আওয়ামী লীগ, শ্রমিক লীগ, যুব মহিলা লীগ, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, আমার মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট, বাংলাদেশ শিশু একাডেমি, বঙ্গবন্ধু গবেষণা পরিষদ, বঙ্গবন্ধু পরিষদ, জাতীয় জাদুঘর, শিল্পকলা একাডেমি, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অজস্র সংগঠনও শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিস্তম্ভে শ্রদ্ধা জানায়। রায়েরবাজারেও জনতার ঢল ॥ শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে রাজধানীর রায়েরবাজার বধ্যভূমিতেও নেমেছিল শোকার্ত মানুষের ঢল। স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, পেশাজীবী ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি এবং শহীদ বুদ্ধিজীবী পরিবারের সদস্যরা। সকাল সাড়ে সাতটা থেকেই স্মৃতিসৌধ প্রাঙ্গণ ও সংলগ্ন রাস্তায় ঢল নামে শিক্ষার্থী ও সাধারণ জনতার। যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষ নেয়ায় পাকিস্তানের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন এবং যুদ্ধাপরাধী দল হিসেবে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার দাবি ছিল স্মৃতিসৌধে আগতদের কণ্ঠে।
×