ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

শামীম হাসান

বিজয়ের আনন্দে

প্রকাশিত: ০৬:২৮, ১৪ ডিসেম্বর ২০১৫

বিজয়ের  আনন্দে

ম্যারাথন দৌড়ের কথা আমরা সবাই কম বেশি জানি। অলিম্পিক ক্রীড়ার অন্যতম একটি ইভেন্ট হচ্ছে এই ম্যারাথন দৌড়। কিন্তু আমরা অনেকেই জানি না এই খেলার নেপথ্যে রয়েছে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ এবং যুদ্ধ জয়ের বিজয়োল্লাসের ইতিহাস। আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগে পারস্যের শাসনকর্তা ছিলেন সম্রাট প্রথম দারিয়ুস। সম্রাট দারিয়ুস ছিলেন উচ্চ বিলাসী এবং যুদ্ধবাজ। সে এক এক করে পররাজ্য গ্রাস করতে থাকে। এমনিভাবে সে গ্রীক রাজ্যও দখল করে নেয়। কিন্তু গ্রীকের নাগরিকেরা চুপচাপ বসে থাকেনি। তারা বিদ্রোহ ঘোষণা করে। এর মধ্যে এথেন্সের নাগরিকরাই বেশি সক্রিয় ছিল। সম্রাট দারিয়ুস তাদের শায়েস্তা করার জন্য এথেন্সের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। তার বাহিনী জাহাজে চড়ে ইজিয়ান সাগর অতিক্রম করে এথেন্স থেকে ২৬ মাইল দূরে এটিকা নামক এক গ্রামের ম্যারাথনের মাঠে উপস্থিত হয়। সেখানে গ্রীক বাহিনী তাদের মাতৃভূমি রক্ষার জন্য পারস্য সৈন্যের মুখোমুখি হয়। শুরু হয় রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। পারস্য বাহিনীর তুলনায় গ্রীক সৈন্য নিতান্তই কম। কিন্তু তাদের হৃদয়ে ছিল দেশ মাতৃকা রক্ষার আবেগ। প্রতিজ্ঞা ছিল দখলদার পারস্যের কাছ থেকে নিজ মাতৃভূমি দখলমুক্ত করার। মিলিটিয়াডাস নামে গ্রীক বাহিনীর এক সেনাপতির যুদ্ধ কৌশল এবং সৈন্যদের মরণপণ প্রতিজ্ঞায় পরাক্রমশালী পারস্য বাহিনী পরাজিত হয়। গ্রীকরা লড়েছিল দেশের মাটির জন্য, মায়ের জন্য, সন্তানদের জন্য। দেশ মাতৃকার প্রতি প্রেম, স্বাধীনতার জন্য আকাক্সক্ষাই ছিল যুদ্ধজয়ের এই অনুপ্রেরণা। যুদ্ধ জয়ে শুরু হলো বিজয়োল্লাস। বিজয়ের এই আনন্দ আপনজনের সঙ্গে ভাগাভাগি করতে তাদের আর তর সইছিল না। কিন্তু তারা তো যুদ্ধের ময়দান হতে ২৬ মাইল দূরে এথেন্স নগরীতে। সেখানে তাদের পরিবার পরিজন নগরবাসী অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে আছে। তখন তো আর এখনকার মতো যোগাযোগের মাধ্যম উন্নত ছিল না। ফেইডিপিডিস নামক এক সৈন্য সেনাপতিকে বলল এ দায়িত্ব আমাকে দিন। আমিই যাব বিজয়ের বার্তা নিয়ে। ফেইডিপিডিস ২৬ মাইল ৩৮৫ গজের দীর্ঘ পথ দৌড়ে দৌড়ে এথেন্সে এসে পৌঁছাল। পথিমধ্যে কোথাও থামে নাই, যদি দেরি হয়ে যায়। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ‘বন্ধুরা তোমরা সব আনন্দ করো, আনন্দ করো, আমরা জিতেছি।’ এ কথা বলেই সৈন্যটি মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। যুদ্ধের ক্লান্তি আর দীর্ঘ পথের দৌড়ের ক্লান্তিতে সে আর উঠতে পারল না। তার এই আত্মাহুতির স্মরণেই প্রতি বছর অনুষ্ঠিত হয় ম্যারাথন দৌড়। ম্যারাথন দৌড়ের এই কাহিনী এখানে উল্লেখ করা হলো শুধুমাত্র বিজয়ের আনন্দের মহিমা বুঝাতে। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে যুদ্ধ জয়ের গৌরব বুঝাতে, দেশের জন্য আত্মত্যাগের উদাহরণ হিসেবে। অথচ ব্যাপ্তিতে, স্থায়িত্বে পৃথিবীর অনেক যুদ্ধের তুলনায় এই যুদ্ধ ছিল খুবই নগণ্য। আর আমাদের বিজয় এসেছে দীর্ঘদিনের ষড়যন্ত্র, নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে। এই বিজয় অর্জিত হয়েছে ত্রিশ লাখ বাঙালীর প্রাণের বিনিময়ে, দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রম হারানো আর কোটি বাঙালীর অবর্ণনীয় দুঃখ দুর্দশার বিনিময়ে। সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর মধ্যে কতিপয় রাজাকার, আলবদর, আলশামস নামক কুলাঙ্গার ব্যতীত সবাই ছিল মুক্তিকামী যোদ্ধা। কেউ সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে, কেউ আশ্রয় দিয়ে, অর্থ দিয়ে, বুদ্ধি দিয়ে সহযোগিতা করেছে। স্বামী-সন্তান যুদ্ধ করেছে আর নেপথ্যে মনোবল যুগিয়েছে মমতাময়ী মা-বোন বা স্ত্রী। হয়েছে নির্যাতিতা। বৃদ্ধরা প্রার্থনা করেছে মসজিদ, মন্দির বা গীর্জায়। হানাদার বাহিনীর কবল থেকে দেশকে মুক্ত করার জন্য যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে পুরুষ-নারী, যুবক-বৃদ্ধ, ছাত্র-শিক্ষক, কৃষক-শ্রমিক ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে। আমাদের বিজয় অর্জিত হয়েছে দেশের অমূল্য সম্পদ বুদ্ধিজীবীদের প্রাণের বিনিময়ে। আমাদের বিজয় অর্জিত হয়েছে সন্তানহারা মায়ের হাহাকার, স্বামীহারা স্ত্রীর আর্তনাদ, ভাইহারা বোনের চোখের জলে। আমাদের বিজয় অর্জিত হয়েছে হানাদার পাকবাহিনীর নির্মম নির্যাতনে মৃত্যুবরণ করে। এই বিজয় এসেছে দানবের ভোগে পিষ্ট হয়ে অবলা নারীর সম্ভমের বিনিময়ে। পৃথিবীর প্রায় সব দেশ বা জাতির স্বাধীনতা দিবস আছে। কিন্তু আমাদের আছে স্বাধীনতা দিবস ও বিজয় দিবস। আমাদের স্বাধীনতাকে যুদ্ধ করে অর্জন করতে হয়েছে। এত ত্যাগের বিনিময়ে বিজয় পেয়েছি বলেই আমাদের বিজয়ের আনন্দ এত বেশি। বর্ষ পরিক্রমায় আবার এসেছে আমাদের বিজয়ের মাস ডিসেম্বর। ১৬ ডিসেম্বর বাঙালী জাতির সেই মুক্তির দিন। মহাআনন্দের দিন। যারা বাঙালী জাতি সত্তায় বিশ্বাসী, যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী সেই কোটি হৃদয়ে এই দিন অবশ্যই বাজবে আনন্দের সুর। বিজয় দিবসে দেশটা হয়ে ওঠে উৎসবমুখর। বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতায় উদযাপিত হয় এই বিজয় উৎসব। রাষ্ট্রীয়ভাবে এবং বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন আয়োজন করে এসব অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানে আগতদের পোশাক পরিচ্ছদে থাকে লাল-সবুজের ছোঁয়া। ছোট্ট ছোট্ট শিশুদের কচি গালে আঁকা থাকে জাতীয় পতাকার ছবি। সবাই যেন জাতীয় পতাকার ক্ষুদ্র অংশ। বিজয়ের রঙে রঙিন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হয় বিশেষ ক্রোড়পত্র। টেলিভিশনে প্রচারিত হয় বিশেষ অনুষ্ঠানমালা। অনুষ্ঠিত হয় সশস্ত্র বাহিনীর কুচকাওয়াজ। কিন্তু এই আনন্দোৎসব স্বাধীনতাবিরোধী কুলাঙ্গারদের উত্তরসূরিদের কাছে অতিরঞ্জিত মনে হয়। বিজয় উৎসবে রাষ্ট্রীয় বা সামাজিক আনুষ্ঠানিকতার পাশাপাশি আমাদের ঘরকেও উৎসবমুখর করে তুলতে হবে। সন্তানদেরকে স্বাধীনতার মর্ম বুঝাতে হবে। স্বাধীনতার জন্য মহান বীরদের আত্মত্যাগের ইতিহাস জানাতে হবে। বিজয় দিবসে বিজয়ের আনন্দ উপভোগ করতে শেখাতে হবে। আর সেই সঙ্গে যাদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে স্বাধীনতা তাদের পারলৌকিক মঙ্গলের জন্য প্রার্থনা করতে হবে। স্বাধীনতার আনন্দ ছড়িয়ে দিতে হবে কোটি বাঙালীর অন্তরে অন্তরে। শুধু একদিন বা এক মাস নয়। বছরের প্রতিটি দিন বিজয়ের আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশের জন্য কাজ করতে হবে। মডেল : রানী আহাদ, টুটুল, শাওন ও টিসা মেকআপ : পারসোনা, পোশাক : অঞ্জন’স
×