ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

জাকারিয়া স্বপন

ব্র্যাক, অরবিস এবং ফেসবুক কাহিনী

প্রকাশিত: ০৫:৩১, ১৪ ডিসেম্বর ২০১৫

ব্র্যাক, অরবিস এবং ফেসবুক কাহিনী

গত সপ্তাহে ‘আমার দিন: ফুল বিক্রি করে স্কুল হয় না’ প্রকাশিত হওয়ার পর লেখাটি নিয়ে বেশকিছু প্রতিবাদ এসেছে। বিশেষ করে ওই লেখায় ব্র্যাকের প্রসঙ্গ আসাতে অনেকেই ভুল ব্যাখ্যা করেছেন। এটা লেখক হিসেবে আমার ব্যর্থতা। আমি লেখক হিসেবে আমার চিন্তাটাকে নিশ্চয়ই ততটা ভাল করে প্রকাশ করতে পারিনি, যা সমাজে কনফিউশন তৈরি করতে পারে। লেখকদের কাজ সমাজে কনফিউশন তৈরি করা নয়, কনফিউশন দূর করা, চিন্তাটাকে সঠিক দিকে প্রবাহিত করা, কিংবা কোন একটি পরিস্থিতির বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি বের করা। কোন লেখকের লেখা যদি সমাজে কনফিউশন তৈরি করে তাহলে এর চেয়ে ব্যর্থতা আর হতে পারে না। সেই দায়ভার আমি নিচ্ছি। তবে পাঠকদেরও কি কিছু দায়িত্ব এর ভেতর থেকে যায় না? পাঠক যদি কোন লেখার ভেতর খুব বেশি প্রবেশ করতে না পারেন, কিংবা খুব সারফেস লেভেলে চিন্তা করেই মন্তব্য প্রকাশ করেন তাহলে সেই ব্যর্থতা যতটা লেখকের ওপর বর্তায় তার কিছু হয়ত পাঠকের উপরও যায়। একটি সমাজে সেরকম লেখকই তৈরি হয়, ওখানে তার পাঠক যেমন। পাঠক যদি কোন লেখা নিতে না পারেন, কিংবা লেখাটির মর্মার্থ ধরতে না পারেন তখন লেখককেও পিছু হটতে হয়। এই কারণেই হয়ত অনেক লেখক তার মৃত্যুর অনেক পরে গিয়ে জনপ্রিয় হয়েছেন। আমি বিশ্বাস করি একজন ভাল লেখক, চিত্রশিল্পী কিংবা দার্শনিক তার জীবদ্দশায় জনপ্রিয় হতে পারেন না, হওয়ার কথাও নয়। তাদের মৃত্যুর অনেক পরে মানুষ সেগুলো নিয়ে এনালাইসিস করবে; তখন হয়ত রেফারেন্সটা বুঝতে পারবে। আমি বলছি না আমি সেই মাপের লেখক। আমি শুধু বলার চেষ্টা করছি পাঠকদেরও আরও অগ্রসর হওয়ার সুযোগ রয়েছে। দুই. ব্র্যাক নিয়ে কিছু বলার আগে অরবিস নিয়ে কিছু কথা বলা যেতে পারে। অরবিসকে মানুষ চেনে একটি ‘উড়ন্ত চক্ষু হাসপাতাল’ হিসেবে। তারা এটাকে বলে থাকেন ‘ফ্লায়িং আই হসপিটাল’। একটি উড়োজাহাজের ভেতর পুরো একটি চক্ষু হাসপাতাল। ১৯৮২ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়া আমেরিকার এই এনজিওটি বর্তমানে বাংলাদেশসহ বিশ্বের ৯২টি দেশে কাজ করছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গিয়ে চোখের চিকিৎসা করাই অরবিসের একমাত্র উদ্দেশ্য নয়। তারা ওই উড়োজাহাজের ভেতর একটি ট্রেনিং সেন্টারও তৈরি করে নিয়েছে, যেখান চক্ষু পেশার সঙ্গে জড়িত প্রফেশনালদের ট্রেনিং দেয়া হয়। অরবিসের ওয়েবসাইট থেকে দেখা যায়, ২০১৩ সালেই তারা ২২,০০০ প্রফেশনালকে ট্রেনিং দিয়েছে এবং ৫৭ লাখ মানুষকে চোখের চিকিৎসা দিয়েছে। বাইরে থেকে দেখলে এটা একটা ডিসি-১০ বিমান। কিন্তু ভেতরের সবকিছু বিশেষভাবে তৈরি করা। স্কুলে পড়ার সময় একবার পত্রিকায় পড়েছিলাম, অরবিসের উড়োজাহাজ বাংলাদেশে নেমেছিল। প্লেনের ভেতর চোখের জটিল অপারেশন হচ্ছে, এটা পড়েই শিহরিত হয়েছিলাম। এখনও মনে আছে ইত্তেফাকের সেই রিপোর্ট আমার কাছে বিজ্ঞান কল্পকাহিনীর মতো মনে হয়েছিল। বিষয়টা যেন অনেকটা এমন যে, আকাশ থেকে একটি সসার এসে নামল। তারপর আমাদের অসংখ্য অন্ধ মানুষের চোখে আলো দিয়ে তারা চলে গেল। এর থেকে বড় সায়েন্স ফিকশন কী হতে পারে! বর্তমান সময়ের মানুষকে এভাবে ভাবতে হয় না। তাদের কাছে টিভি আছে, ইন্টারনেট আছে। আমার ছোটবেলায় অরবিস যেভাবে আলোড়ন তৈরি করেছিল বর্তমান সময়ের শিশু-কিশোরদের তা হয়ত ছুঁয়েই যাবে না। তারা মনে করবে, ‘ওহ এটা আর তেমন কি! এটা তো হতেই পারে।’ সময় পাল্টেছে, জ্ঞানের বিস্তৃতি বেড়েছে, বেড়েছে তথ্যের প্রবাহ। কিন্তু অরবিসের একটি বিজ্ঞাপনের কথা আমার এক গুণমুগ্ধ পাঠক মনে করিয়ে দিয়েছেন। আমি তার প্রতি কৃতজ্ঞ। বিজ্ঞাপনটির সঠিক কথাগুলো আমার মনে নেই। তবে বিজ্ঞাপনটির মূল বক্তব্যটি ছিল অরবিসের ‘ভিশন’ হলো ‘গোয়িং আউট অব বিজনেস’। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের একটি ভিশন থাকে। তাদের ভিশন হলো এই কার্যক্রমটি বন্ধ করে দেয়া। এখানে তারা ‘ভিশন’ শব্দটিকে দুটি অর্থে ব্যবহার করেছেন। একটি হলো ‘লক্ষ্য’, আরেকটি হলো ‘দেখা’ বা দৃষ্টিশক্তি। প্রতিষ্ঠানটি মনে করছে, এই পৃথিবীর সকল মানুষ যখন দেখতে পাবে তখন আর তাদের প্রয়োজন হবে না। তাই তারা যত বেশি সফল হবে তত তাড়াতাড়ি তাদের কার্যক্রমটি বন্ধ করে দিতে পারবে। এর অর্থ কি এই যে, অরবিস তাদের কার্যক্রম বন্ধ করে দিতে চাইছে? একটা পাগলও বুঝতে পারবে, অরবিস এটা বোঝাতে চায়নি। তারা পৃথিবী থেকে অন্ধত্ব দূর করার জন্য একটি প্রতিজ্ঞাকে এভাবে প্রকাশ করেছে মাত্র। এবং আমি মনে করি, এটা খুবই বুদ্ধিদীপ্ত কমিউনিকেশন। এই ধরনের একটি বিজ্ঞাপন কোথাও প্রকাশিত হলে অনেকেই অনেক সময় ধরে বিজ্ঞাপনটির দিকে তাকিয়ে থাকবেন এবং এটা নিয়ে কথা বলবেন। এটাই হয়ত অরবিসের সাফল্য। যে কারণে আমি ওই বিজ্ঞাপনটি নিয়ে কথা বলছি। আমি লিখতে গিয়েছিলাম ‘অরবিস আরও বড় হও’। পরমুহূর্তেই খটকা লাগল। নতুন করে লিখলাম ‘অরবিস তুমি দ্রুত ছোট হও, এই পৃথিবী থেকে অন্ধত্ব দূর হোক।’ তিন. বাংলাদেশে অসংখ্য এনজিও বিভিন্ন কার্যক্রম নিয়ে কাজ করে। তাদের একটি বড় অংশ কাজ করে দারিদ্র্য নিয়ে। তাদের মধ্যে ব্র্যাকও আছে। তবে ব্র্যাকের বর্তমান কার্যক্রম শুধুমাত্র দারিদ্র্য বিমোচন নয়, তারা তাদের কার্যক্রমকে ক্ষুদ্রঋণ, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, কৃষি, আইন সহায়তা, সামাজিক উদ্বুদ্ধকরণ, জীবিকা সংস্থান, উদ্যোক্তা প্রশিক্ষণসহ অসংখ্য কাজে ছড়িয়ে গেছে। তবে মূল উদ্দেশ্য হলো সরকারের পাশাপাশি উন্নয়ন পরিচালনা করা। এটা কি একটি খারাপ কাজ? অবশ্যই না। এই পৃথিবীতে সম্পদের সুষম বণ্টন হয়নি। যেই ব্রিটিশরা আমাদের কাছ থেকে দু’শ’ বছরের বেশি সময় ধরে শোষণ করে সম্পদ নিয়ে গেছে এখন তাদের কাছ থেকেই আমাদের সাহায্য নিতে হয়, গণতন্ত্র শিখতে হয়, কিংবা মানুষের অধিকার কিভাবে প্রতিষ্ঠা করা যায় তার বয়ান শুনতে হয়। এটাই হয়ত পৃথিবীর বড় প্রহসন। আলেক্জান্ডারের গুরু ছিলেন এরিস্টটল নিজে। সেই এরিস্টটলের ছাত্র আলেক্জান্ডারকে কেন মানুষ ‘দি গ্রেট’ বলে আমি জানি না। আলেক্জান্ডারের হাতে এত রক্তের দাগ, তারপরও তার নামের পরে ‘দি গ্রেট’। একটি মানুষের সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার জন্য যে যুদ্ধ তাকে আমাদের গ্রেট বলতে হবে! এই পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ এখনও অভুক্ত থাকে, এই গ্রহে টয়লেটের সুবিধার চেয়ে মোবাইল ফোনের সংখ্যা অনেক বেশি। মানুষ বিশুদ্ধ পানি পান করতে পারে না। কিন্তু আমরা সবাই একই আকাশের নিচে থাকি এবং একই অক্সিজেন দিয়ে জীবন বাঁচাই। এই গ্যাপ যারা কমিয়ে আনার জন্য কাজ করছেন তাদের চেয়ে মহৎ আর কিছু হতে পারে না। অ-উন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এই সমস্যা প্রকট। আর তাই এই সকল এলাকাতে সরকারের পাশাপাশি এনজিওগুলোর কাজ করতে হয়। যেমন, এক সময়কার সুন্দর আফগানিস্তানে এখন এনজিও কর্মকা- দিয়ে মানুষের জীবনকে কিছুটা বাঁচিয়ে রাখা গেছে। সরকারের একার পক্ষে এত কিছু করা সম্ভব হয়ে উঠছে না। একই কারণে বাংলাদেশে অসংখ্য এনজিও জন্ম নিয়েছে। কোন কোন এনজিওর কর্মকা- নিয়ে হয়ত সমালোচনা হতে পারে; তবে আমরা দারিদ্র্যসীমার নিচে আছি বলেই, শিক্ষায় পিছিয়ে আছি বলেই, সামাজিকভাবে সুগঠিত নই বলেই এই প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রয়োজন রয়েছে এবং অনেক প্রতিষ্ঠান নিঃসন্দেহভাবে ভাল কাজ করছে। ব্র্যাক নিয়ে আমার মন্তব্য ছিল অরবিসের ভিশনের মতো। যারা ব্র্যাক তৈরির পেছনে ছিলেন এবং এখনও যুক্ত রয়েছেন তাদের ভিশন নিশ্চয়ই এমনটাই যে, এই দেশ থেকে দারিদ্র্যকে দূর করবেন, শিক্ষাকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন এবং সামাজিক বৈষম্যকে দূর করবেন। তখনই তাদের সাফল্য পরিমাপযোগ্য হবে। এবং যখন পুরোপুরি তারা এই কাজে সফল হবেন আমরা একটি উন্নত দেশে পরিণত হবো। আমরা হয়ে যাব মালয়েশিয়া কিংবা সিঙ্গাপুর, নয়ত ব্রিটেন। তখন এই কাজগুলো করার জন্য ব্র্যাকের প্রয়োজন হবে না। তারা ভিন্ন দেশে গিয়ে সেখানকার সমস্যাগুলো সমাধান করবে এবং আমাদের তখন হয়ত নতুন সমস্যার তৈরি হবে- সেগুলোকে এড্রেস করবে। আমি তো মনে করি যেদিন ব্র্যাক ম্যানেজমেন্ট সবার সামনে দাঁড়িয়ে বলতে পারবে এই বছর তাদের ক্ষুদ্রঋণের পরিমাণ ৯০ ভাগ কমে গেছে তাহলেই তো সেটা সাফল্য। নইলে ব্র্যাক তাদের সাফল্য পরিমাপ করে কিভাবে? তারা কি এটা বলে আরও ৯০ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেছে? এটা নিশ্চয়ই তাদের সাফল্য নয়! একই বিষয়টি গ্রামীণ ব্যাংকের বেলাতেও প্রযোজ্য। অধ্যাপক মুহম্মদ ইউনূস যখন বলেন ২০২০ সালের মধ্যে দারিদ্র্যকে মিউজিয়ামে পাঠাবেন, তখন তার ওই বক্তব্যের মধ্যেই কি নিহিত থাকে না যে, ২০২০ সালের পর আর মানুষকে ক্ষুদ্রঋণ নিতে হবে না। তারা মধ্যম আয়ের মানুষ হয়ে যাবেন। এবং প্রথাগত মূল ব্যাংকিং-এর আওতায় চলে আসবেন। গ্রামীণ ব্যাংকের কার্যক্রম যদি শত শত বছর ধরে পরিচালিত হয় তাহলে তারা তাদের সাফল্যকে কিভাবে পরিমাপ করবেন? এই কার্যক্রম তো সীমাহীন সময় ধরে চলতে পারে না। তাহলে তো আর তারা তাদের লক্ষ্যে পৌঁছতে পারলেন না। এই সহজ বিষয়টি না বুঝলে তাদের মনের অন্ধত্ব দূর করার জন্য আরেকটি অরবিসের প্রয়োজন হতে পারে। চার. দীর্ঘ ২২ দিন বন্ধ থাকার পর, বৃহস্পতিবার বাংলাদেশে ফেসবুকের এক্সেস খুলে দেয়া হয়েছে। আমি জানি অনেকেই বিশ্বাস করবেন না যে, আমি এই ২২ দিন ভিপিএন ব্যবহার করিনি, ফেসবুক ব্যবহার করিনি। এমনকি এটা নিয়ে কোথাও কথাও বলিনি, কোন লেখাও লিখিনি। ফেসবুক খুলে দেয়ার পর একাত্তর টিভি থেকে আমাকে একটি আলোচনায় অংশ নিতে অনুরোধ করা হয়। আমি মিডিয়া নিয়ে কাজ করার পরেও টিভি এড়িয়ে চলি। ওখানে কথাগুলো সঠিকভাবে গুছিয়ে বলা যায় না। এত মানুষ থাকে, কথাগুলো এলোমেলো হয়ে যায়। কিন্তু কাল তাদের অনুরোধ রাখলাম এবং আলোচনার এক পর্যায়ে মন্ত্রী তারানা হালিম টেলিফোনে অংশগ্রহণ করেন। তার গলার টোন থেকে মনে হয়েছে তিনি পুরো পরিস্থিতিটি নিয়েই আপসেট। তাই এখানে একটু লেখার চেষ্টা করছি, এ ধরনের সামাজিক মাধ্যমগুলো নিয়ে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি কী হওয়া উচিত। ক. প্রথমেই বলি, আমি কেন গত ২২ দিন ভিপিএন ব্যবহার করে ফেসবুক ব্যবহার করিনি। যখন আমি এটা টিভিতে বলি উপস্থাপিকা সামিয়া রহমান হাসতে হাসতে বললেন, আপনি ভয় পেয়েছেন। এটা আসলে সাহস কিংবা ভয়ের বিষয় নয়। আমি যদি চাইতাম তাহলে সরকার সেটা টের পেত বলে আমি মনে করি না। তবে, আমি সরকারের একটি সিদ্ধান্তকে সম্মান জানিয়েছি কেবল। প্রযুক্তিগতভাবে আমি অনেক কিছুই করতে পারি। কিন্তু আমি পারি বলেই করব, তার তো কোন অর্থ নেই। বর্তমান সরকারের অনেক মন্ত্রী ভিন্ন পথে ফেসবুক ব্যবহার করলেও আমি করিনি। আমি ফেসবুকে লগ-ইনও করিনি, কোন মেসেজও দেখিনি। অনেকেই ভাবতে পারেন আমি হলাম এই সরকারের সবচেয় বড় চামচা। কিন্তু আমার মতো একজন মানুষ ফেসবুক ব্যবহার করছে কি করছে না তাতে কার কী আসে যায়। আমার পয়েন্ট ভিন্ন। নিরাপত্তার কারণে যেহেতু সরকার একটি সিস্টেমকে ব্লক করেছে, আমি কেন সেই নিয়মকে বাই-পাস করব? আজ যদি আমেরিকার সরকার একই কাজ করত আমি কি সেটাকে ভঙ্গ করে ফেসবুক ব্যবহার করতাম? করতাম না। তাহলে বাংলাদেশের বেলায় সেটা হবে কেন? রাষ্ট্রের সিদ্ধান্তকে আমি সম্মান জানিয়েছি। সেটা আমি যখন যে রাষ্ট্রে থাকব তখন সেই রাষ্ট্রের নিয়ম মেনেই আমাকে চলতে হবে। খ. ফেসবুক বন্ধের পেছনে সরকার কারণ দেখিয়েছে নিরাপত্তাজনিত। এটা আমাদের সবাইকেই মানতে হবে যে, নিরাপত্তা সংক্রান্ত যে তথ্য সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কাছে থাকে তা আমাদের কাছে থাকে না। তাই আমরা যতই চিৎকার করি নিরাপত্তা কোন ইস্যু নয়- সেটা শুধু এক ধরনের প্রতিবাদ হতে পারে। এটা মোটেও তথ্যনির্ভর হবে না। আর সরকার তো আমাদের সঙ্গে সেই তথ্য শেয়ারও করছে না। পাশাপাশি আমরা কেউ নিরাপত্তা নিয়ে সরাসরি কাজও করি না। একটি দেশের সরকার যদি মনে করে এতে তার জনগণের জীবন নিরাপদ হবে, সেই সরকার তো সেটা করতেই পারে। যদি সত্যি সত্যি তখন মানুষ মারা যেত আমরাই কিন্তু উল্টো বলতাম, দেখ দেখ গোয়েন্দারা করে কী! গ. মানুষের জীবন কতটা মূল্যবান, কেন ফেসবুক, ভাইবারসহ অন্যান্য সিস্টেম বন্ধ রাখতে হবে- সেগুলো ব্যাখ্যা করে মন্ত্রী তারানা হালিম একটি লেখা প্রকাশ করেছিলেন। টেলিফোনেও একই বাক্যগুলো তিনি খুব আবেগমিশ্রিত কণ্ঠে বলেছেন। এই পুরো পরিস্থিতির চাপটুকু তার ওপর দিয়ে যাচ্ছে সেটা বোঝা যাচ্ছিল। কিন্তু এই পুরো বিষয়টির জন্য একজন স্পোক-পার্সন থাকতে পারত। তিনিই হয়ত এই কঠিন বিষয়গুলো প্রফেশনালী হ্যান্ডেল করতে পারতেন। পৃথিবীর বিভিন্ন ক্রাইসিসের সময় স্পোক-পার্সন থাকেন। ঘ. বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে কথা বলে আমার যা মনে হয়েছেÑ তারা বিশ্বাস করে না যে, ফেসবুক বন্ধ করে সন্ত্রাসী কার্যক্রম রোধ করা যায়। প্রথমে যখন সাময়িকভাবে ফেসবুক বন্ধ করা হয়েছিল তখন তারা এটাকে এপ্রিশিয়েট করেছিল। কিন্তু এই লম্বা সময় ধরে আটকে রেখে সেই এপ্রিশিয়েশনকে আর ধরে রাখা যায়নি। মানুষ বিরক্ত হয়েছে এবং তারা ধীরে ধীরে বিকল্প পথে ফেসবুক ব্যবহার করতে শুরু করেছে। শেষের দিকে এসে ব্যাপারটা এমনি হয়ে গিয়েছিল যে, চারপাশের সবাই ভিপিএন বা প্রক্সি ব্যবহার করে ফেসবুক কিংবা ভাইবার ব্যবহার করতে শুরু করেন। তাহলে যে কারণে এটাকে বন্ধ করে রাখা হয়েছিল সেই উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হয়ে গেল এবং পরবর্তী সময় আর ফেসবুক বন্ধ করা যাবে না। মানুষ প্রথম দিনেই ভিপিএন ব্যবহার শুরু করে দেবে। মানুষ কেন সরকারের সিদ্ধান্তকে বিশ্বাস করছে না এটা ভেবে দেখার প্রয়োজন থাকলেও আমি নিশ্চিত এটা নিয়ে কেউ ভাবছে না। পাবলিককে কিভাবে ম্যানেজ করতে হয় তার ফর্মুলা এই দেশে ভিন্ন। এগুলো নিয়ে কোন কথা বলে কাজ হয় বলে আমি মনে করি না। ঙ. পাশাপাশি ফেসবুকের মতো একটি জনপ্রিয় যোগাযোগ মাধ্যম লম্বা সময় ধরে বন্ধ থাকাতে সরকারেরই বেশি ক্ষতি হয়েছে। কারণ এই পুরো সময়টাতে ফেসবুকে সরকারের উপস্থিতি নিশ্চয়ই কম ছিল। সরকার যদি উপস্থিত থাকত তাহলে অনেক কিছুই সেখানে পোস্ট করতে পারত। ভবিষ্যতে লম্বা সময় নিয়ে যেন এমন একটি প্ল্যাটফর্ম বন্ধ রাখতে না হয় সেটা মাথায় রাখাটা জরুরী। পাঁচ. বাংলাদেশের মানুষ ফেসবুক নিয়ে যতটা মাতোয়ারা বিশ্বের অন্য দেশগুলোতেও কি তাই? আমার কাছে মনে হয়, বাংলাদেশের মানুষ ফেসবুকের ওপর অনেক বেশি নির্ভরশীল। এর একটি বড় কারণ হতে পারে, বাংলাদেশের মানুষ ফেসবুককে এক ধরনের কাঠগড়া মনে করে থাকেন। তারা সেখানেই বিচার-আচার সব করে ফেলেন। কার পেছনে কার লাগতে হবে, কাকে পচানো যাবে, কিংবা নিজের ভেতরে যে ক্ষোভ রয়েছে তা প্রকাশ করার একটি জায়গা যেন তারা পেয়েছেন। নইলে একটি প্ল্যাটফর্মের জন্য মানুষ এমন মরিয়া হয়ে উঠবে কেন? নিশ্চয়ই তাদের কোন বিকল্প নেই। বাংলাদেশে ফেসবুকের বিশাল সাফল্য। তাদের এই সাফল্যের কারণটি আমরা কি কেউ একটু ঠা-া মাথায় ভেবে দেখেছি? পৃথিবীর অন্য দেশগুলোয় টুইটার অনেক বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠতে শুরু করলেও বাংলাদেশে কিন্তু সেটা হয়ে ওঠেনি। এর মূল কারণটি আমাদের মনস্তাত্ত্বিক কাঠামোর সঙ্গে জড়িত। সাধারণ মানুষের নিত্যদিন কথা বলার জন্য কিছু টপিকের প্রয়োজন হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে রসালো টপিক, গসিপ। ফেসবুক হলো আমাদের সবচেয়ে বড় গসিপের জায়গা। আমরা যদি গসিপের জন্য আরও কিছু প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে পারতাম তাহলে ফেসবুকের ওপর এই নির্ভরতা কমত। সরকার এই বিষয়টি ভেবে দেখতে পারে। ১১ ডিসেম্বর ২০১৫ লেখক : তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ এবং সম্পাদক, প্রিয়. কম ুং@ঢ়ৎরুড়.পড়স
×