ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ঢাকায় সেমিনারে মার্কিন আন্ডার সেক্রেটারি;###;নারীর ক্ষমতায়নের সাফল্য শেখ হাসিনার যোগ্য নেতৃত্বের কারণেই;###;পৌরসভা নির্বাচনের সুযোগ প্রত্যেককেই সর্বোচ্চভাবে কাজে লাগাতে হবে

বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র ॥ টমাস শ্যানন

প্রকাশিত: ০৫:১৪, ১৪ ডিসেম্বর ২০১৫

বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র ॥ টমাস শ্যানন

কূটনৈতিক রিপোর্টার ॥ গণতান্ত্রিক নীতিমালার ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশকে একটি আদর্শ রাষ্ট্রের উদাহরণ বলে মন্তব্য করেছেন মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের রাজনীতিবিষয়ক নতুন আন্ডার সেক্রেটারি টমাস এ শ্যানন। তিনি আরও বলেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বাংলাদেশ সব সময় গুরুত্ব বহন করে। এছাড়া সহিংস জঙ্গীবাদী গোষ্ঠী বিভক্ত, দুর্বল ও বিশৃঙ্খল বাংলাদেশ দেখতে চায়। বাংলাদেশ-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উভয় দেশই সহিংস জঙ্গীবাদী হুমকির মুখে অরক্ষিত বলে তিনি মন্তব্য করেন। টমাস শ্যানন বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের কারণেই বাংলাদেশ নারীর ক্ষমতায়ন ও লৈঙ্গিক সমতার ক্ষেত্রে সাফল্য দেখিয়েছে। তার মন্তব্য, বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের সম্ভাবনা উন্নয়নশীল অনেক দেশের কাছেই ঈর্ষার বিষয়। আসন্ন পৌরসভা নির্বাচনে গণতন্ত্রের প্রতি বাংলাদেশের প্রতিশ্রুতিকে পুনর্নিশ্চিত করতে প্রতিটি দলই এই সুযোগটি সর্বোচ্চভাবে কাজে লাগাতে চাইবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন। রবিবার বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল এ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ (বিআইআইএসএস) মিলনায়তনে ‘বাংলাদেশ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক : বৈশ্বিক ইস্যুতে একযোগে’-শীর্ষক সেমিনারে বক্তব্য রাখেন টমাস শ্যানন। বিআইআইএসএস আয়োজিত এ সেমিনারে আরও বক্তব্য রাখেন পররাষ্ট্র সচিব এম শহীদুল হক, বিআইআইএসএস চেয়ারম্যান মুন্সী ফয়েজ আহমেদ ও মহাপরিচালক মেজর জেনারেল একেএম আবদুর রহমান এনডিসি। সেমিনারে দক্ষিণ-মধ্য এশিয়াবিষয়ক মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই বিসওয়াল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোহাম্মাদ জিয়াউদ্দিন প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। সেমিনারে টমাস শ্যানন বলেন, বিজয় দিবসের মাত্র কয়েকদিন আগে বাংলাদেশ সফর করতে পেরে আমি বিশেষভাবে আনন্দিত। একটি সদ্য স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক জাতির উদ্দেশে বক্তব্য রাখতে বাংলাদেশের বিজয়ের পরপরই সিনেটর টেড কেনেডি ঢাকা সফর করেন। তিনি তখন এদেশে একটি জরুরী, সরল এবং আন্তরিক বার্তা পৌঁছে দেন, সেটি হলো- ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে গুরুত্ব দেয়’। টেড কেনেডি ৪৪ বছর আগে যা বলেছিলেন আজকে আমি তার সঙ্গে শুধু কয়েকটি শব্দ যোগ করতে চাই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখনও বাংলাদেশকে গুরুত্ব দেয়। এ বিষয়ে কোন সন্দেহ থাকতে পারে না। আমি আবারও বলছি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বাংলাদেশ সব সময় গুরুত্ব বহন করে। তিনি বলেন, গণতান্ত্রিক নীতিমালার ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশকে একটি আদর্শ রাষ্ট্রের উদাহরণ। একটি জাতি যখন বহুত্ববাদী ও নাগরিকদের কাছ থেকে যেসব সুবিধা লাভ করে তখন যে সম্ভাবনা দেখা দেয় সেটা বাংলাদেশকে দিয়েই উদাহরণ দেয়া যায় এটি এমন একটি দেশ যেটির কথা পুরো পৃথিবী মনোযোগ দিয়ে শোনে, তা হোক শান্তিরক্ষা, জলবায়ু পরিবর্তন অথবা সন্ত্রাসবিরোধী বিষয়ে। আর বাংলাদেশীরা এই বিশ্বের সবচেয়ে সহিষ্ণু, উচ্চাকাক্সক্ষী এবং উদ্যোগী মানুষের মধ্যে অন্যতম বলে তিনি মন্তব্য করেন। মার্কিন আন্ডার সেক্রেটারি বলেন, বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের সম্ভাবনা উন্নয়নশীল অনেক দেশের কাছে একটি ঈর্ষার বিষয়। সেজন্যই একটি শক্তিশালী এবং সম্মানজনক ব্র্যান্ড বাংলাদেশ গড়ে তোলা খুব গুরুত্বপূর্ণ যেখানে শ্রমিকদের অধিকার এবং নিরাপত্তা সুরক্ষিত হয়। শ্রমিকের ক্ষমতায়ন হলে তারা নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আরও বেশি ভাল অবস্থানে থাকেন এবং তাদের উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ে। আর এর মাধ্যমেই বেশি দক্ষতা, বেশি উৎপাদন, অধিকতর লাভ, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ- জীবনমানের উন্নয়ন ও আরও বেশি অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়। টমাস শ্যানন বলেন, বাংলাদেশ লিঙ্গসমতা ও নারীর ক্ষমতায়নে বিপুল সাফল্য দেখিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যোগ্য নেতৃত্বের কারণে সম্ভব হয়েছে। বাংলাদেশের সাফল্যের অনেকখানিই অর্জিত হয়েছে নারীকে উন্নয়ন কর্মসূচীর সম্মুখে রেখে। তবে নারীর প্রতি সহিংসতা কমানো, বাল্যবিয়ে এবং জোরপূর্বক বিয়ে বন্ধ করাসহ আরও অনেক বিষয়ে সাফল্য অর্জন এখনও বাকি রয়েছে। এই বিষয়গুলোর ভয়ঙ্কর সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং স্বাস্থ্যগত নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ আঞ্চলিক যোগাযোগের ক্ষেত্রেও অনেক দিন ধরে নেতৃস্থানীয় অবস্থানে রয়েছে। দেশটি দক্ষিণ এশিয়ার শীর্ষ অর্থনীতিতে পরিণত হতে পারে। এটি হতে পারে এই অঞ্চলের বাণিজ্যিক শক্তিকেন্দ্র এবং দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে মানুষ এবং পণ্য পরিবহনে কেন্দ্রীয় ভূমিকা রাখতে পারে। আমাদের ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অর্থনৈতিক করিডোর উদ্যোগের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র এই লক্ষ্য বাস্তবায়নে সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। টমাস শ্যানন বলেন, বাংলাদেশ-ভারত-নেপাল ও ভুটানের মধ্যে সরাসরি সড়ক যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এর ফলে এই চার দেশ বিশেষ উপকৃত হবে। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সমুদ্র পথে নৌ যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু হতে চলেছে। সমুদ্র পথে যোগাযোগ বাড়লে দুই দেশই চট্টগ্রাম থেকে কলকাতা ও চেন্নাইয়ে সরাসরি পণ্য আনা নেয়া করতে পারবে। এটি একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ বলে তিনি উল্লেখ করেন। বাণিজ্য ও বিনিয়োগের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে সচল রাখার সাহায্য অব্যাহত রাখবে। ইতিমধ্যেই আমরা বাংলাদেশের বৃহত্তম বৈদেশিক বিনিয়োগকারী দেশগুলোর অন্যতম। দুই দেশের দ্বি-পক্ষীয় বাণিজ্য নিয়মিতভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে যার পরিমাণ ছয়’শ কোটি ডলারেরও বেশি। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সৈনিক ও নাবিকেরা স্থলভাগে ও সমুদ্রে একত্রে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। দশক ধরে চলে আসা বাংলাদেশের সঙ্গে আমাদের শান্তিরক্ষা মিশনের অংশীদারিত্ব ব্যাপক সফলতার প্রমাণ রেখেছে। আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে একটি অপরিহার্য অংশ হিসেবে গড়ে উঠতে সাহায্য করা। জলবায়ুর প্রভাব মোকাবেলার কথা যখন আসে তখনও বাংলাদেশ বিশ্বের কাছে একটি উদাহরণ। তাই আমরা আরও ভাল সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে ও আপদকালীন ব্যবস্থাপনা কেন্দ্র গড়তে বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করার আশা ব্যক্ত করছি যেন প্রবল ঝড় ও দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার প্রভাব আরও কমানো যায়। পৌরসভা নির্বাচনের সময় আবার এগিয়ে আসছে। আমি আশা করছি গণতন্ত্রের প্রতি বাংলাদেশের প্রতিশ্রুতিকে পুনর্নিশ্চিত করতে প্রত্যেকেই এই সুযোগটি সর্বোচ্চভাবে কাজে লাগাতে চাইবে। প্রত্যেকটি দেশ, সেটি যুক্তরাষ্ট্র হোক বা বাংলাদেশ তাদের সম্পূর্ণ সম্ভাবনা তখনই অর্জন করতে সক্ষম হয় যখন জাতীয় বিতর্ক এমনকি মতানৈক্য একটি শান্তিপূর্ণ, উন্মুক্ত এবং নিরঙ্কুশ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে আসে। আমরা একই লক্ষ্যে কাজ করছি, এমন একটি বাংলাদেশকে সহায়তা দেয়া যা অন্তর্ভুক্তিমূলক, সমৃদ্ধ ও নিরাপদ। সহিংস উগ্র ও সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী ওই স্বপ্ন লালন করে না। তারা এমন একটি বাংলাদেশ চায় যা বিভক্ত, দুর্বল এবং বিশৃঙ্খল। শতাব্দীব্যাপী চলে আসা ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে ধ্বংস করতে চায় তারা। এগুলো তারা সম্পন্ন করতে চায় বর্বরতা ও সন্ত্রাসের মাধ্যমে। বাংলাদেশ-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উভয় দেশই এই হুমকির মুখে একইভাবে অরক্ষিত। তবে এটিকে পরাজিত করতে আমরা একত্রে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। আমি সিনেটর কেনেডির আরও একটি উদ্ধৃতি দিয়ে বলতে চাই, এই যুদ্ধে আমরা সকল বাংলাদেশী ও আমেরিকান মানবিকতার বৃহত্তর জোটে আমরা সকলে জোটবদ্ধ। জলবায়ু পরিবর্তন হোক আর নিরাপত্তা, নারীর ক্ষমতায়ন, অথবা উন্নয়ন যাই হোক না কেন বিগত চল্লিশ বছর ধরে এটি প্রতীয়মান হয়, যখন যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশ একত্রে কাজ করে অসাধারণ সব অর্জন লাভ করতে পারে। আগামী চল্লিশ বছরও তার ব্যতিক্রম হবে না, কারণ আমাদের অংশীদারিত্বটি এমনই শক্তি, সহিষ্ণুতা এবং সম্ভাবনা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধি পায়। সেমিনারে পররাষ্ট্র সচিব এম শহীদুল হক বলেন, বাংলাদেশ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বহুমুখী সম্পর্ক বিদ্যমান। এই সম্পর্ক অনেক গভীর ও বিস্তৃত। তবে দুই দেশই বর্তমানে দুইটি বিষয়কে খুবই গুরুত্ব দিচ্ছে। একটি হলো জলবায়ু পরিবর্তন ঝুঁকি ও সন্ত্রাস-জঙ্গীবাদ মোকাবেলা। অন্যান্য ইস্যুর পাশাপাশি এই দুই ইস্যুকে এখন খুবই গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। রবিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাত করেন টমাস শ্যানন। এছাড়া প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী, পররাষ্ট্র মন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর সঙ্গে পৃথক বৈঠক করেন। রাতে পররাষ্ট্র সচিব এম শহীদুল হকের আমন্ত্রণে নৈশভোজে অংশগ্রহণ করেন টমাস শ্যানন। এর আগে রবিবার সকালে তিন সদস্যের মার্কিন প্রতিনিধি দল ঢাকায় পৌঁছেন। বিমানবন্দরে তাদের স্বাগত জানান পররাষ্ট্র সচিব এম শহীদুল হক, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোহাম্মাদ জিয়াউদ্দিন, ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট প্রমুখ। ঢাকা সফররত মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের রাজনীতিবিষয়ক নতুন আন্ডার সেক্রেটারি টমাস শ্যানন, দক্ষিণ-মধ্য এশিয়াবিষয়ক মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই বিসওয়াল ও দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক উপসহকারী পররাষ্ট্র মন্ত্রী মনপ্রীত সিং আনন্দ। রবিবার রাতেই নিশা দেশাই ভারতের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেন। আজ সোমবার ঢাকা শ্রীলঙ্কার উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করবেন টমাস শ্যানন ও দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক উপসহকারী পররাষ্ট্র মন্ত্রী মনপ্রীত সিং আনন্দ। ঢাকা ত্যাগের আগে তিনি ইউএসএআইডির অর্থায়নে একটি ক্লিনিক পরিদর্শন করবেন।
×