ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

আয়ের উৎস নিয়ে কানাঘুষা

ব্যাংক কর্মকর্তা ফেঁসে যাচ্ছেন স্ত্রী নির্যাতন ও প্রতারণায়

প্রকাশিত: ০৬:৩১, ১৩ ডিসেম্বর ২০১৫

ব্যাংক কর্মকর্তা ফেঁসে যাচ্ছেন স্ত্রী নির্যাতন ও প্রতারণায়

মাকসুদ আহমদ, চট্টগ্রাম অফিস ॥ চট্টগ্রামে অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেডের কর্মকর্তা শেখ জাফর ইকবাল স্ত্রী নির্যাতনের ঘটনায় গ্রেফতার হলেও অপর দুই আসামি এখনও পলাতক। দীর্ঘ প্রায় এক মাস এ কর্মকর্তা কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকলেও প্রশাসনিক কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। এদিকে, এ কর্মকর্তার ব্যাংক এ্যাকাউন্টে গত এক বছরে ৬৮ লাখ টাকা জমা হওয়ার পেছনের উৎস নিয়েও চলছে কানাঘুষা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়মানুযায়ী নগদ পাঁচ লাখ টাকার উর্ধে লেনদেনের ক্ষেত্রে জমাদানকারী ও গ্রহণকারীর তথ্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকে প্রেরণের নির্দেশনা থাকলেও এক্ষেত্রে তা মানা হয়নি। অভিযোগ উঠেছে, মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সঠিক তদন্ত না করে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়ার জন্য তড়িঘড়ি করছেন। এক্ষেত্রে মামলার বাদী উলফৎ জাহান দাবি করেছেন, প্রতারণার মাধ্যমে অর্থ আদায় এবং যৌতুক আদায়ের চেষ্টা করেছে তার স্বামী জাফর ইকবাল, শ্বশুর ইসা মিয়া ও শাশুড়ি আংকুরের নেসা। ১০ মাসের সন্তান গর্ভাবস্থায় নিয়ে অমানুষিক নির্যাতনের কারণে তিনি গত ২০ অক্টোবর বাপের বাড়ি চলে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। গত ৩০ অক্টোবর পুত্রসন্তানের জন্ম দেন তিনি। মামলার বাদী জানান, আদালতে কোন ধরনের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী এমনকি ডিভোর্স দেননি উলফৎ জাহান গত ২১ জানুয়ারি। প্রতারক ব্যাংক কর্মকর্তা এ সকল স্ট্যাম্প ডিভোর্স স্বীকারোক্তিতে ব্যবহার করেছে বলে অভিযোগ করেছেন বাদী। এ ধরনের প্রতারণার আশ্রয় নেয়ায় অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে চেক বিষয়ে লেনদেন ও চেকের অর্থ কে বা কারা উত্তোলন করেছে এমনকি কার এ্যাকাউন্টে এ টাকা লেনদেন হয়েছে এ বিষয়ে জানতে চেয়ে আবেদন জানিয়েছেন। মামলার এজাহার সূত্রে জানা গেছে, উলফৎ জাহানের সঙ্গে ২০১৪ সালের ২৯ আগস্ট রেজিস্ট্রিমূলে বিয়ে হয় জাফর ইকবালের। আট লাখ টাকা দেনমোহরের কাবিননামায় দুই লাখ টাকা উসুল দেখানো হয়েছে। কিন্তু চার-পাঁচ মাসের মধ্যেই দাম্পত্যজীবনে যৌতুকের দাবি করে বসে তার স্বামী। ৩০ লাখ টাকায় গাড়ি কেনার কথা বলে যৌতুকলোভী স্বামী ২০ লাখ টাকা নিজস্ব ঋণ ও বাকি ১০ লাখ টাকা শ্বশুরবাড়ি থেকে নিয়ে আসার জন্য চাপ সৃষ্টি করে স্ত্রীকে। প্রতারণার আশ্রয় নিতে ব্যাংক গ্যারান্টার হিসাবে স্ত্রীকে দেখানোর জন্য কয়েকটি অলিখিত নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর আদায় করে নেন জাফর ইকবাল। যৌতুক আদায় করতে গত ২০ অক্টোবর ৩টার দিকে তাদের বেডরুমে জাফর ইকবাল, তার বাবা শেখ ইসা মিয়া ও মা অংকুরের নেসাসহ তিনজনে মিলে উলফৎ জাহানের ওপর নির্যাতন চালায়। ধাক্কা মেরে খাটের ওপর থেকে অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে ফেলে দেয়। খবর পেয়ে উলফৎ জাহানের মা এসে তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান। এদিকে চট্টগ্রাম আদালতের নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে ভুয়া স্বীকারোক্তিনামা আদায় করেছেন জাফর ইকবাল। প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে চলতি বছরের ২১ জানুয়ারি নোটারি পাবলিকের রেজিস্টার্ড নং-৫ অনুযায়ী উলফৎ জাহানকে ডিভোর্স দেয়া হয়েছে। ওই স্বীকারোক্তিতে স্বামী-স্ত্রী উভয়েরই স্বাক্ষর রয়েছে। অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেডের আগ্রাবাদ বাণিজ্যিক এলাকার কর্পোরেট শাখার দুটি চেকনং যথাক্রমে ০২৩৭০৪৪-এর আওতায় সাত লাখ টাকা ও ০২৩৭০৪৫-এর আওতায় তিন লাখ টাকা, তাং ২১/১/২০১৫ইং ইস্যু করা হয়। এ দুটি চেকের অর্থ অগ্রণী ব্যাংক লালদীঘি পূর্ব, কর্পোরেট শাখার মাধ্যমে পরিশোধ করার কথা রয়েছে। তবে স্বীকারোক্তিনামায় যেসব স্ট্যাম্প ব্যবহার করা হয়েছে সেগুলো পূর্বে অলিখিত প্রতারণার মাধ্যমে স্বাক্ষর নেয়া স্ট্যাম্প বলে দাবি করেছেন মামলার বাদী উলফৎ জাহান। গত ২১ নবেম্বর রাতে গ্রেফতার হন আগ্রাবাদ কর্পোরেট শাখার কর্মকর্তা জাফর ইকবাল। গ্রেফতারের পর তার ব্যাংক বিবরণীতে দেখা যায়, অনলাইন ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ২১ জানুয়ারি ইস্যুকৃত ওই দুটি চেকের ১০ লাখ টাকা ছাড়াও জাফর ইকবালের আরেকটি চেকের (নং-২৩৭০৪৭) মাধ্যমে ১৩ লাখ টাকা অনলাইনে লালদীঘি কর্পোরেট শাখা থেকে উত্তোলন করা হয়েছে। এমনও তথ্য রয়েছে, গত ৩ মার্চ চেকের (নং-৬৩২৬১৪১) মাধ্যমে ২৩ লাখ টাকা স্থানান্তরের একটি এন্ট্রি সন্নিবেশিত আছে জাফর ইকবালের (হিসাব নং-০২০০০০২৪৫০৫৮২) এ্যাকাউন্টে। প্রশ্ন উঠেছে দেড় মাসের ব্যবধানে ২৩ লাখ টাকা ব্যালান্স ট্রান্সফার নিয়ে। এছাড়াও এ কর্মকর্তা মাত্র এগারো মাসে ৬৮ লাখ ৪১ হাজার ৫১৩ টাকা এ্যাকাউন্টে জমা করেছেন এবং উত্তোলন করেছেন ৬৮ লাখ ৩৪ হাজার ৮৫৫ টাকা। এ বিষয়ে চট্টগ্রামের অগ্রণী ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপক জানান, ব্যাংক লেনদেনের বিষয়গুলো আমরা খতিয়ে দেখছি। দীর্ঘ সময় দফতরে অনুপস্থিত থাকার বিষয়ে কারণ দর্শাও নোটিস প্রদান করা হয়েছে। এখনও কোন জবাব পাওয়া যায়নি। তবে পারিবারিক ও নারী নির্যাতন বিষয়গুলো আইনী। মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল প্রসঙ্গে হালিশহর থানার ওসি জানিয়েছেন, নারী নির্যাতন ও প্রতারণার বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। এক্ষেত্রে কোন ধরনের কারসাজি করার সুযোগ নেই তদন্ত কর্মকর্তার। কারণ, নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে মামলা দায়ের ও প্রতারণার অভিযোগ এনে বাদী যেসব কাগজপত্র জমা দিয়েছেন তা পর্যবেক্ষণ করে দেখা হচ্ছে। সঠিক তথ্যের ভিত্তিতেই প্রতিবেদন তৈরি করা হবে। এদিকে ভুয়া স্বীকারোক্তিতে ১১টি শর্ত সন্নিবেশিত রয়েছে এবং প্রতিটি শর্ত ব্যাংক কর্মকর্তা জাফর ইকবালের পক্ষেই রয়েছে বলে দাবি করেছেন নারী ও শিশু নির্যাতন মামলার বাদীপক্ষের কৌঁসুলি।
×