মিথুন আশরাফ ॥ ধুন্ধুমার ব্যাটিং করছেন রংপুর রাইডার্সের দুই ওপেনার সৌম্য সরকার ও লেন্ডল সিমন্স। বাউন্ডারির পর বাউন্ডারি হাঁকাচ্ছেন। ৪ ওভারেই স্কোরবোর্ডে ৩৩ রান জমা হয়ে যায়। সবার মনেই প্রশ্ন জাগে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সের গড়া ১৬৩ রানকে টপকে যাবে নাতো রংপুর? ঠিক এমন মুহূর্তেই সব ওলট-পালট করে দেন কুমিল্লার সেরা পেসার আবু হায়দার রনি। পঞ্চম ওভারে টানা দুই বলে সৌম্য ও সিমন্সকে আউট করে দেন। তখন কুমিল্লার ক্রিকেটারদের মধ্যে এতটাই আত্মবিশ্বাস দেখা যায়, বোঝাই যায় দিনটি কুমিল্লারই হতে যাচ্ছে। আর রংপুরের ব্যাটসম্যানদের মানসিক ভীত যেন দুর্বল হয়ে পড়ে! অষ্টম ওভারের সময় টানা দুই বলে আসহার জাইদি যখন মোঃ মিঠুন ও সাকিব আল হাসানকে আউট করে দেন তখন আর রংপুরের জেতার কোন আশাই যেন থাকে না। রংপুরকে ৭২ রানে হারিয়ে ফাইনালে খেলা নিশ্চিত করে নেয় কুমিল্লা।
বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লীগে (বিপিএল টি২০) প্রথমবারের মত খেলছে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্স। সবার আগে ফাইনালে খেলছে দলটি। মাশরাফি বিন মর্তুজার নেতৃত্বে শনিবার প্রথম কোয়ালিফায়ারে রংপুর রাইডার্সতো কুমিল্লার সামনে দাঁড়াতেই পারলো না! ব্যাট (১৫ বলে অপরাজিত ৪০ রান) ও বল হাতে ( ৪/১১) জাইদি এমন নৈপুণ্যই দেখালেন। কুমিল্লার সামনে টিকতেই পারলো না রংপুর। এরসঙ্গে রনির (৪/১৯) গতির সামনে ৯১ রানেই অলআউট হয়ে গেল সাকিবের দল। এবারের আসরে রানের দিক দিয়ে সবচেয়ে বড় জয়টিই পেয়ে গেল কুমিল্লা। সেই সঙ্গে রনি ২১ উইকেট শিকার করে এবারের আসরে সবচেয়ে বেশি উইকেট শিকারি বোলারও হয়ে গেলেন।
প্রথম কোয়ালিফায়ার ম্যাচের নিয়মটিই এমন, যে দল জিতবে ফাইনালে খেলবে। হারা দল এলিমিনেটর ম্যাচের জয়ী দলের বিপক্ষে রবিবার দ্বিতীয় কোয়ালিফায়ার ম্যাচ খেলবে। সেই ম্যাচে যে দল জিতবে কুমিল্লার বিপক্ষে ১৫ ডিসেম্বর শিরোপা নির্ধারণী ম্যাচে সে দলই লড়াই করবে।
একজন বাংলাদেশ ওয়ানডে ও টি২০ দলের অধিনায়ক। তিনি মাশরাফি বিন মর্তুজা। আরেকজন সহ-অধিনায়ক। তিনি সাকিব আল হাসাান। নির্ধারিত ওভারের অধিনায়ক ও সহ-অধিনায়কের মধ্যেও লড়াই হয়। সফল অধিনায়ক মাশরাফিকে পেছনে ফেলে কী সবার আগে সহ-অধিনায়ক সাকিবের দল রংপুর ফাইনালে খেলতে পারবে? নাকি অধিনায়কেরই জয় হবে? এ প্রশ্নগুলো ঘুরপাক খায়। টুর্নামেন্টের লীগ পর্বে দুইদলই সমান অবস্থানে ছিল। দুই দলই ১০ ম্যাচে ৭ জয় করে পেয়েছে। ১৪ পয়েন্ট পেয়ে রানরেটে কুমিল্লা এগিয়ে থেকে প্রথম স্থানে থাকে। দ্বিতীয় স্থানে থাকে রংপুর। লীগ পর্বে দুইদলের অবস্থান দেখেই বোঝা গেছে জমজমাট লড়াই হবে। দুইদলই সমান শক্তির। না হলে কী আর সমান পয়েন্ট হয়! তবে কুমিল্লার এত দূর আসায় মাশরাফি আগেই বলেছিলেন, ‘এত দূর আসব ভাবতেই পারিনি।’ সেই দলটি কিনা ফাইনালেই উঠে গেছে।
ম্যাচে টস জিতে রংপুর আগে ফিল্ডিং করার সিদ্ধান্ত নিয়েই যেন ভুল করে। আগে ব্যাটিংয়ের সুযোগ পেয়ে কুমিল্লা বাজিমাত করে। আসল সময়ে এসে ইমরুল কায়েস জ্বলে উঠলেন। তাকে যোগ্য সঙ্গটাই দিলেন ওপেনার লিটন কুমার দাস। শুরুটাই কুমিল্লার দুর্দান্ত হয়। দুইজন মিলে ৭৯ রান করে ফেলেন। এমন সময় লিটন (২৮) আউট হন। স্কোরবোর্ডে এরপর ৩৩ রান যোগ হতেই আরও ৪টি উইকেটের পতন ঘটে যায়। থিসারা পেরেরাই এই চারটি উইকেট শিকার করেন। ১৬তম ওভারে ইমরুল, রাসেল ও শেহজাদকে আউট করে দেন পেরেরা।
আগের ম্যাচগুলোতে আহমেদ শেহজাদ ওয়ানডাউনে নেমে দুর্দান্ত ব্যাটিং করছিলেন। কিন্তু এদিন মাশরাফি ব্যাট হাতে নেমে গিয়ে ১ রান করেই আউট হন। ১০৭ রানের সময় দলের সর্বোচ্চ রান করা ইমরুল (৪৮ বলে ৬৭) আউট হতেই ১১২ রানে গিয়ে আন্দ্রে রাসেল ও শেহজাদ সাজঘরে ফেরেন। তখন ১৬ ওভার শেষ হয়। হাতে থাকে ৪ ওভার। ২৪ বলে কী কুমিল্লা পারবে ১৫০ রান ছাড়াতে? ম্যাচটি থেকে যেন নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলতে থাকে মাশরাফির দল। এমন সময় ঝড় তোলেন জাইদি। মুহূর্তেই ১৫ বলে ৪ চার ও ২ ছক্কা হাঁকান জাইদি। ১২৬ রানে পেরেরার বলে অলক কাপালী ও ১৪৯ রানে শুভগত হোম (১২) আউট হলেও জাইদি ৪০ রান করে অপরাজিত থাকেন। দল শেষ পর্যন্ত দেড় শ’ রান ছাড়িয়ে ৭ উইকেট হারিয়ে ২০ ওভারে ১৬৩ রান করে ফেলে। পেরেরা একাই ৫ উইকেট নেন।
কুমিল্লার ইনিংস শেষ হতেই আশা করা হয় জিতবে মাশরাফির দলই। প্রথম কোয়ালিফায়ার জিতেই ফাইনালে খেলা নিশ্চিত করে নেবে। কিন্তু শুরুতেই সৌম্য ও সিমন্স মিলে যে ঝড়ের গতিতে রান তুলতে থাকলে কুমিল্লা সমর্থকদের মনে ভয় ধরা স্বাভাবিকই ছিল। কিন্তু ৩৬ রানে গিয়ে যেই সৌম্য (৯) ও দলের হয়ে এ ম্যাচে সর্বোচ্চ রান করা সিমন্সকে (২৫) আউট করে দেন রনি, কুমিল্লা আবার ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। কুমিল্লা সমর্থকরা তখনই উৎসবে মাততে শুরু করে দেন। ৪৫ রানে গিয়ে যখন মিঠুন ও রানের খাতা খোলার আগেই সাকিবকে আউট করে দেন জাইদি উৎসবে যেন আরও রঙ ছড়ায়। কুমিল্লার জয় যেন তখন সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। এরপর এক এক করে জাইদি, মাশরাফি ও রনি মিলে রংপুরকে অলআউট করে দেন। মাত্র তিনজন ব্যাটসম্যান দুই অঙ্কের ঘরে পৌঁছাতে পারেন। সিমন্স ২৫, নবী ১২ ও পেরেরা ১১ রান করতে সক্ষম হন। ১৭ ওভারের মধ্যে ৯১ রান করতেই গুটিয়ে যায় রংপুর।
কুমিল্লার সবচেয়ে আনন্দের বিষয় হচ্ছে এমন ম্যাচে এসে মাশরাফিও বল হাতে নেন। টানা চার ম্যাচের তিনটি ম্যাচে বলই করেননি মাশরাফি। শুধু মাঠে থেকে দলকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। এক ম্যাচে যাও বল হাতে নিয়ে ১ ওভার করেছে। শনিবার রংপুরের বিপক্ষে ৪ ওভার পুরো বল করেন। ১৩ রান দিয়ে ১ উইকেটও নেন। তবে সবার মুখে মুখে ম্যাচ শেষে একটি নামই শোনা গেছে, আসহার জাইদি। ব্যাট-বল হাতে কুমিল্লাকে যিনি জিতিয়েছেন। পাকিস্তানী বংশদ্ভূত বৃটিশ এ নাগরিক ম্যাচ সেরাও হয়েছেন। কুমিল্লাকে ফাইনালেও তুলেছেন।