ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মোস্তাফা জব্বার

ডিজিটাল রূপান্তর ও ডিজিটাল অপরাধ

প্রকাশিত: ০৫:২৪, ১৩ ডিসেম্বর ২০১৫

ডিজিটাল রূপান্তর ও ডিজিটাল অপরাধ

এই কলামে একই শিরোনামে একটি লেখা প্রকাশের পর নিরাপত্তাজনিত কারণে ফেসবুক বন্ধ করে দেয়া হয়। সেজন্য আমি এর ধারাবাহিকতা না রেখে ফেসবুক নিয়ে লিখেছি। এখন যখন ফেসবুক খুলে দেয়া হয়েছে তখন আমাদের নজরটা একটু বিস্তৃতভাবে দেশের ডিজিটাল রূপান্তর ও ডিজিটাল অপরাধের ওপর নিবদ্ধ হতে পারে। যারা ভেবেছিলেন যে ফেসবুকই আমাদের একমাত্র জাতীয় সমস্যা তাদের জন্য আমার এই ধারাবাহিক লেখাটি। আশা করছি এই লেখার সবগুলো কিস্তি পাঠ করলে সারা দুনিয়ার ডিজিটাল রূপান্তরের সঙ্গে যুক্ত ডিজিটাল অপরাধ সম্পর্কে আরও স্পষ্ট ধারণা তৈরি হবে। লেখার শুরুতে আমি টেলিকম প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিমকে কেবল ফেসবুক খুলে দেয়ার জন্য নয়- এর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ফলপ্রসূ আলোচনা করার জন্য অভিনন্দিত করছি। ॥ দুই ॥ ইন্টারনেটের প্রসার : প্রেক্ষিতটা এরকম। ১৯৬৯ সালের আরপানেট থেকে ১৯৯১ সালে ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবের আবির্ভাব এবং দিনে দিনে এর প্রসার পুরো দুনিয়াকে একটি নতুন সভ্যতা উপহার দিয়েছে। কেউ কেউ এই সভ্যতাকে ইন্টারনেট সভ্যতা বলে থাকেন। ২০০৫ সালে যেখানে মাত্র ১১৫ কোটি মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করত সেখানে ২০১৪ সালের হিসাবে সেই সংখ্যা ২৯২ কোটি ৫২ লাখ ৪৯ হাজার ৩৫৫ উঠেছে। বাংলাদেশে হঠাৎ করেই ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে। আমাদের ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা এখন ৪.৬১ কোটি। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ইন্টারনেটের ব্যবহারকারী যা ছিল (মাত্র ১২ লাখ) এখন সেটি তার চাইতে বহুগুণ বেশি। এর পেছনে ইন্টারনেট ব্যান্ডউইদথের দাম কমা, ইন্টারনেটে প্রয়োজনীয় কনটেন্টস পাওয়া এবং ফেসবুকের মতো সামাজিক নেটওয়ার্ক ও ব্লগিং-এর যথেষ্ট অবদান রয়েছে। যে কেউ এখন দেশের সকল প্রান্তের বিপুল পরিমাণ মানুষকে ইন্টারনেটে সংযুক্ত হওয়া অবস্থায় দেখতে পাবেন। এক সময়ে যা কেবল কিছুসংখ্যক মানুষের সাময়িক কার্যকলাপ হিসেবে গণ্য হতো এখন সেটি দেশের প্রায় সকল এলাকার মানুষেরই প্রাত্যহিক ক্রিয়া-কর্মে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশের ডিজিটাল রূপান্তরের ক্ষেত্রে এটি একটি বড় ধরনের মাইলফলক অগ্রগতি। সরকার ২০০৬ সালে সাবমেরিন কেবলের সঙ্গে দেশটিক যুক্ত করে এর ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়াতে ব্যর্থ হলেও সাম্প্রতিককালে সেই অবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন আমাদের উৎসাহিত করছে। এই খাতে সরকারের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের যুক্ত হওয়াটাও নিঃসন্দেহে একটি বড় ধরনের সফলতা। একই সঙ্গে বিগত কয়েক বছরে মোবাইলের সংযোগের সংখ্যা ব্যাপকভাবে বাড়ার বিষয়টিও ইতিবাচক। মোবাইলের সংযোগ বৃদ্ধি এবং মোবাইল ও ওয়াইম্যাক্স কোম্পানিগুলো অত্যন্ত আক্রমণাত্মকভাবে ইন্টারনেট কানেকশন বাজারজাত করার ফলেও ইন্টারনেট ব্যবহারের পরিমাণ বেড়েছে। আমরা প্রত্যাশা করতে পারি যে, এই প্রবৃদ্ধি আরও দ্রুত হবে এবং দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারের পরিমাণ অনেকের ধারণার বাইরে চলে যাবে। এটি অবশ্যই একটি শুভ লক্ষ্মণ। তবে আমি মনে করি ইন্টারনেটের প্রসারটি কেবল ব্যবহারকারীর সংখ্যাতে নয় বস্তুত এর মধ্যে থাকা কনটেন্টই হচ্ছে এর সবচেয়ে বড় শক্তি। অতীতে একটি দেশের অগ্রগতির মাপকাঠি হিসেবে ফিক্সড টেলিফোন কানেকশনকে বিবেচনা করা হতো। বলা হতো টেলিঘনত্ব কেমন তার ওপরে একটি দেশের অগ্রগতির সূচক নির্ধারণ করা হয়। এখন সেটি ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের ব্যবহার দিয়ে বিবেচনা করা হয়। এমনকি এটিও বিবেচনা করা হয় যে, কোন দেশের ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের প্রসার শতকরা ১০ ভাগ বাড়লে তার জিডিপি বাড়ে শতকরা ১.৩ ভাগ। বিষয়টি এরকম বিধায় আমরা বুঝতে পারছি যে, আমরা ইন্টারনেট ব্যবহারে এগিয়ে গেলেও কার্যত যাকে মাপকাঠি হিসেবে বিবেচনা করা হয় সেই ব্রডব্যান্ড ব্যবহারের ক্ষেত্রে আমাদের তেমন বড় অগ্রগতি নেই। মাত্র দুটি ওয়াইম্যাক্স কোম্পানি ও ৫টি মোবাইল অপারেটর সীমিত পর্যায়ের ব্রডব্যান্ড সংযোগ প্রদান করে। জুন ২০১৫ এর হিসাব অনুসারে সেই সংখ্যা ১৪ লাখ ৪৮ হাজার। শুধু তাই নয়, এসব সংযোগ আবার একেবারেই বড় শহরকেন্দ্রিক। গ্রামের মানুষ কোনভাবেই ব্রডব্যান্ড সেবা পায় না। মনে করা হয়েছিল যে, থ্রিজি মোবাইল সংযোগ পাওয়া গেলে আমরা ব্রডব্যান্ডের যুগে খুব সহজেই পৌঁছাতে পারব। কিন্তু থ্রিজির আগমনের পরও ব্রডব্যান্ডের প্রসার তেমনভাবে ঘটেনি। সারা দুনিয়ার প্রায় ৩৬১ কোটি ইন্টারনেট ব্যবহারকারী রয়েছে। ফলে ইন্টারনেট নির্ভর জীবনযাপনে নিরাপত্তার বিষয়টি এখন আর কোনভাবেই কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। এই খাতে অপরাধ যেমন বাড়ছে নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগও তেমন করেই বাড়ছে। মোবাইল ফোন : মোবাইল ফোনের ইতিহাস অনেক দূরে বিস্তৃত। ১৯২১ সালে ডেট্রয়েট পুলিশের মোবাইল রেডিও স্থাপন থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এর ব্যবহার বা ১৯৪৬ সালের ১৭ জুন বেল ল্যাবের মোবাইল সেবা চালু ইত্যাদি নানা প্রসঙ্গ এর সঙ্গে যুক্ত। মোবাইল রেডিও, ওয়াকি টকি, পেজার এসব অনেক প্রযুক্তি অতিক্রম করে আমরা আজকের দিনের সেলফোন প্রযুক্তিতে এসেছি। বাংলাদেশে ১৯৮৯ সালে প্রথম সেলুলার ফোনের লাইসেন্স প্রদান করা হয়। তারা সিটি সেল মোবাইল সেবার প্রচলন করে। এরপর ৯৬ সালে গ্রামীণ ও অন্যরা আসার পর দেশে মোবাইল ফোনের বিপ্লবটা সংঘটিত হয়। ২০১৫ সালে বিশ্বের অনুমিত জনসংখ্যা ৭২৬ কোটি ৪৬ লাখ। এর মাঝে মোবাইল সংযোগের সংখ্যা জনসংখ্যার পরিমাণের কাছাকাছি। বহু দেশে জনস্যখার চাইতে সংযোগের পরিমাণ বেশি। মোবাইল ও ইন্টারনেটের প্রভাব ও জীবনধারা : খুব সঙ্গত কারণেই মোবাইলের ব্যবহারের সঙ্গে আমাদের সংস্কৃতির মান যুক্ত আছে। আরও একটি বিষয় উপলব্ধি করা জরুরী। আমরা ব্যাপকহারে ইন্টারনেট ব্যবহার করার আগে মোবাইল ব্যবহার করা শুরু করেছি। এমনকি কম্পিউটারের অনুপ্রবেশের চাইতেও বহুগুণ বেশি হয়েছে মোবাইল বা ইন্টারনেটের অনুপ্রবেশ। যদিও ১৯৬৪ সালে আমাদের দেশে কম্পিউটার এসেছে এবং ১৯৮৭ সালে কম্পিউটারে বাংলা প্রয়োগ, ডিটিপি বিপ্লব ও মেকিন্টোসের ইন্টারফেসের বদৌলতে আমাদের কম্পিউটার ব্যবহারের মাত্রা গতি পেয়েছে, তথাপি মোবাইলই হলো প্রথম ডিজিটাল প্রযুক্তি যেটি আমাদের দৈনন্দিন জীবনে প্রবেশ করেছে। সমাজের সকল স্তরে এভাবে আর কোন ডিজিটাল প্রযুক্তি প্রবেশ করেনি। আমরা রেডিও-টিভির কথা ধরতে পারি। সেইসব প্রযুক্তি অনেক আগেই এসেছে। কিন্তু যেভাবে মোবাইল এসেছে সেভাবে আর কেউ আসেনি। রেডিও-টিভি ছিল একপাক্ষিক কর্মকা-। এসব থেকে আমরা তথ্য পেতাম। কিন্তু মোবাইল হলো দ্বিপাক্ষিক, ইন্টারএ্যাকটিভ ও যোগাযোগ মাধ্যম। ফলে এটি কেবল ফোনের প্রযুক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এটি এসএমএস-এর সহায়তায় ডাটা আদান প্রদানে আমাদের যুক্ত করেছে। এতে সাউন্ড ও ভিডিও যুক্ত হয়েছে এবং ইন্টারনেটের সহায়তায় ডিজিটাল সভ্যতা বা জ্ঞানভিত্তিক সভ্যতার মাঝে নিয়ে গেছে। আমি নিজে বিশ্বাস করি, মোবাইলের মতো একটি যন্ত্র যাতে ইন্টারনেট ও কথা বলার সুযোগ থাকবে সেটিই হবে আগামী দিনের ডিজিটাল যন্ত্র। যাহোক ইন্টারনেটই যে সকল প্রযুক্তির কেন্দ্র হবে সেটি নিয়ে কারও কোন সন্দেহ থাকার কথা নয়। ফোন ব্যবহারের ক্ষেত্রে মোবাইলের বদৌলতে টেলিঘনত্বের মাপকাঠিতে অনেক ওপরে আছি আমরা। আমাদের মোবাইলের ব্যবহারও অবিশ্বাস্য গতিতে বেড়েছে। কোন সন্দেহ নেই যে, উভয় ক্ষেত্রেই আমাদের অল্প বয়সের মানুষ এতে বেশি করে যুক্ত হচ্ছেন। মোবাইল ও ইন্টারনেট নামক ডিজিটাল যুগের দুটি যোগাযোগ মাধ্যমের প্রসারের ফলে দেশের সার্বিক অগ্রগতি হবে এটি অর্থনীতিবিদদের সাধারণ বক্তব্য। সার্বিকভাবে ইন্টারনেটের প্রভাব এখন আর আগের মতো ই-মেইল, ফেসবুক, টুইটার বা গুগল সার্চের মাঝেই সীমিত নয়। বিশেষ করে থ্রিজি বা ৪জি প্রযুক্তির বদৌলতে ইন্টারনেট একটি ডিজিটাল জীবনধারা গড়ে তুলছে। আমি এক কথায় বলব মানবসভ্যতা এর আগে আর কখনও এমন গভীর প্রভাব বিস্তারকারী প্রযুক্তির মুখোমুখি হয়নি। মোবাইল ও ইন্টারনেট জীবনধারায় কি প্রভাব ফেলবে সেই আলোচনা করতে হলে প্রথমেই বুঝতে হবে এসব প্রযুক্তি মানুষের জীবনযাপনে কি পরিবর্তন এনেছে। উনিশ শতকের আশির দশকের মাঝামাঝিতে আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেলের টেলিফোন এবং ১৯৬০ সালে পরস্পরের তথ্য বিনিময়ের নেটওয়ার্ক কালক্রমে ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব হয়ে এখন যখন মোবাইল ও ইন্টারনেটের সভ্যতা তৈরি করেছে তখন বস্তুত এটি জীবনের প্রায় সকল অলিন্দে প্রবেশ করে বসে আছে। মোবাইল তো বটেই ইন্টারনেট এখন জীবনের সকল যোগাযোগ, ব্যবসা-বাণিজ্য, ভাববিনিময়, তথ্য-উপাত্ত বিনিময় ও সামাজিক-ব্যক্তিগত যোগাযোগের মাধ্যম। এটি এখন কেবল কথা বা লেখা বিনিময় করে না, সাউন্ড, ভিডিও-এর পাশাপাশি একটি চমৎকার ইন্টারএ্যাকটিভ মাধ্যম হিসেবে এই প্রযুক্তি গড়ে উঠেছে। থ্রিজি প্রযুক্তির মোবাইল থেকেই আমরা বাংলাদেশ টেলিভিশনসহ স্যাটেলাইট টিভিগুলো মোবাইল ফোনে দেখবো। ইন্টারনেট মাধ্যমটি এখন টিভি দেখার, ভিডিও দেখার, গান শোনার, সিনেমা দেখার এবং লেখাপড়া করার শ্রেষ্ঠতম মাধ্যম। এই মাধ্যমটি এখন ব্যবসাবাণিজ্যের বা শিল্প কলখানার কেন্দ্রবিন্দু। এমনকি ইন্টারনেট এখন রাজনীতির সবচেয়ে বড় মাধ্যম। রাজনীতিবিদ-মন্ত্রী, সাংসদরা এখন ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে তার মনের ভাব প্রকাশ করছেন। ওবায়দুল কাদের ১৩ সেপ্টেম্বর ১২ জানান যে তিনি রেলমন্ত্রী থাকছেন না। এর সঙ্গে রয়েছে গণজাগরণ মঞ্চের জন্ম, বিস্তার ও বিকাশ এবং হেফাজতে ইসলামসহ নানা প্রান্তের মানুষের ডিজিটাল অপরাধ বিষয়ক বক্তব্য। এখন বাংলাদেশ সম্ভবত এই বিষয়টি নিয়েই অনেক বেশি আলোড়িত। সম্প্রতি সাংবাদিক প্রবীর সিকদারের মুক্তির দাবি অনেক বেশি জোরদার হয়েছে ইন্টারনেটেই। আমরা এসব বিষয়ে একটু গভীরতার সঙ্গেই আলোকপাত করব। সংস্কৃতি যদি জীবনবোধ, জীবনধারা, জীবনাচার, সমাজ, সভ্যতা, আনন্দ-বিনোদন থেকে শিক্ষা-সাহিত্য, ব্যবসা ইত্যাদির সব কিছুকে বোঝায় তবে অন্য সকল মাধ্যম হলো আংশিক বাহক, কেবল ইন্টারনেটই এখন সংস্কৃতির সবটাকে ধারণ করে। খুব সহজেই যে কেউ এটি অত্যন্ত স্পষ্টভাবে ধারণা করতে পারেন যে, সংস্কৃতির পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী হিসেবে ইন্টারনেটনির্ভর। আমাদের এটি বোঝা উচিত যে, আমরা যেসব উপাদান দিয়ে সংস্কৃতির রূপান্তরকে বিবেচনা করে থাকি তার সবগুলোই এখন ইন্টারনেটকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে। আমরা যদি আরও কয়েক বছর পরের কথা বিবেচনা করি তবে যেসব সাংস্কৃতিক মাধ্যমগুলো এখনও আলাদা আছে যেমন, সিডি-ডিভিডি, বই, রেডিও, টিভিÑ সেগুলোর চাইতে বেশি প্রভাবশালী হয়ে উঠবে ইন্টারনেট। অন্য অর্থে বলা যায় যে, এসব মাধ্যম টিকে থাকলেও তার ভিত্তি হিসেবে ইন্টারনেটই থাকবে। আমি এই কারণেই মনে করি ভবিষ্যতে সংস্কৃতির মানদ- বিবেচনা করার সময় প্রথমেই ইন্টারনেটকেই ভাবতে হবে।
×