ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

এনামুল হক

বরফ গলছে ॥ বদলে যাচ্ছে গ্রীনল্যান্ডবাসীর জীবন

প্রকাশিত: ০৫:২৩, ১৩ ডিসেম্বর ২০১৫

বরফ গলছে ॥ বদলে যাচ্ছে গ্রীনল্যান্ডবাসীর জীবন

গ্রীনল্যান্ডের বরফ গলছে। কমে আসছে বরফের আয়তন। সাগরে বরফের তটরেখা দূরে সরে যাচ্ছে। বরফ কমে আসার কারণে গ্রীনল্যান্ডবাসীদের পরিবর্তিত পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে হচ্ছে। তাদের জীবনধারা বদলে যাচ্ছে। গ্রীনল্যান্ডে এমনিতে যখন শীতকাল শুরু হয় সাগরের জলরাশি তখন ঠা-ায় জমে বরফ হয়ে যায়। পৃথিবীর এই উত্তরভাগের আয়তন সহসা বেড়ে যায়। দিন যত ছোট হয়ে আসে দিগন্ত ততই প্রসারিত হয়। আবার শীত বিদায়ের সঙ্গে সঙ্গে বরফ গলা শুরু হয়। বরফের তটরেখা দূরে সরে যেতে থাকে। জেগে ওঠে সাগর। কিন্তু গত কয়েক দশক ধরে গ্রীনল্যান্ডের বরফ দ্রুতহারে গলে চলেছে। সাগর সম্পূর্ণ বরফে ঢাকা পড়ে থাকছে বছরে এমন দিনের সংখ্যাও কমে আসছে। বরফ যেভাবে গলছে এবং বরফের তটরেখা প্রতিবছর যেভাবে একটু একটু করে দূরে সরে যাচ্ছে তাতে গ্রীনল্যান্ডের মানুষ আশঙ্কা করছে যে, বরফের এই তটরেখা চিরতরে দূরে সরে যাবে। তখন তাদের কী হবে? গ্রীনল্যান্ডের বরফ কমে আসার সঙ্গে সঙ্গে আরেকটা ব্যাপারও ঘটছে। একটা জীবনধারা ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। শত শত বছর ধরে গ্রীনল্যান্ডে গড়ে ওঠা একটা সংস্কৃতি মৌসুমভেদে সাগরের বরফের এগিয়ে আসা ও দূরে যাওয়ার সঙ্গে ধাতস্থ হয়েছিল। সেই সংস্কৃতি এখন হারিয়ে যাওয়ার হুমকির মুখে পড়েছে। গ্রীনল্যান্ডের অধিবাসীর সংখ্যা ৫৬ হাজার। এদের সবাই সমুদ্রের দিকে মুখ রেখে জীবনযাপন করে। এক বিশাল বসবাস অযোগ্য অভ্যন্তরভাগ থাকে তাদের পেছনে। গ্রীনল্যান্ডের অভিবাসীদের বলে ইনুইট। শীতকাল তাদের জন্য সফর, ভ্রমণ ও শিকারের সময়। এখন বিমান, হেলিকপ্টার ও দ্রুতগামী মোটরবোট চলাচলের মাধ্যম বটে। তবে ঐতিহ্যগতভাবেই এরা বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলের মানুষরা শীতকালে কুকুরটানা সেøজে চড়ে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে পাড়ি দিয়ে এসেছে। গ্রীনল্যান্ডের উত্তরভাগে উন্মান্নক ফিয়র্ড নামে একটি পাহাড়ী দ্বীপ আছে। সেখানে প্রায় আড়াই হাজার লোকের বাস। ওটা এক ছোটখাটো শহর। খাড়া সঙ্কীর্ণ রাস্তা আছে, যার ওপর দিয়ে গাড়ি চলে। ওখানে দোকান, হাসপাতাল, পানশালা, হাই স্কুলও আছে। আশপাশের অন্যান্য লোকালয়ের প্রাণকেন্দ্র এটা। এখানকার লোকদের জীবিকা শিকার মাছ ধরা। তাদের খাদ্য তালিকার একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ তিমি ও সীলের মাংস। এগুলোর রফতানি নিষিদ্ধ। তবে হ্যালিকাট নামে এক জাতের মাছের নয়। এই হ্যালিকাট প্রক্রিয়াজাত ও রফতানি করার জন্য গ্রীনল্যান্ডের অনেক লোকালয়ে মৎস্য কারখানা গড়ে উঠেছে। এই বিশেষ মাছটা সারাবছরই ধরা হয়। সাগরে যখন বরফ থাকে না তখন জেলেরা সমুদ্রের খাড়ি বরাবর লম্বা লাইন বেঁধে ছিপ ফেলে মাছ ধরে। আর শীতকালে সাগর বরফে ঢেকে গেলে ওরা হাঁটু পর্যন্ত গভীর গর্ত খুঁড়লেই পানি পেয়ে যায়। তখন সেই গর্তের পানিতে বড়শি ফেলে মাছ ধরে। কপাল ভাল হলে এভাবে একজন জেলে দিনে সিকি টন মাছ ধরে নৌকা বা কুকুরটানা সেøজে করে মৎস্য কারখানায় গিয়ে কয়েক শ’ ডলার রোজগার করতে পারে। মাছ ধরা অনেক পরিবারের জন্য আয়ের ভাল উৎস হলেও আবার এখনও কিছু লোক আছে যারা সরকারের ভর্তুকির ওপর চলে। গ্রীনল্যান্ডে খনিজসম্পদ ও উপকূলীয় তেল আছে। তবে এখনও সেগুলো অনুধাবনের ব্যবস্থা করা হয়নি। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এসব লোকালয়ের অর্থনীতির ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। শীত ও বসন্তের মেয়াদ দীর্ঘায়িত হয়েছে। বরফ যতটা পুরু হয়ে উঠেছে তাতে নৌকাগুলো পোতাশ্রয় থেকে রওনা দিতে পারছে না। আবার তা এত গুরুত্ব নয় যে, এর ওপর সেøজ বা সেøামোবাইল চলতে পারবে। এই অনিরাপদ বরফের কারণে মাছ ধরা ব্যাহত হচ্ছে। তবে শুধু এ কারণে নয়, আরও অন্যভাবেও এ অঞ্চলের মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, উন্মান্নক খাড়ির বরফ শীতকালের চরম অবস্থায় মাত্র এক ফুট পুরু থাকে। ডিসেম্বর বা জানুয়ারিতে সাগরে বরফে জমাট বাঁধার পরিবর্তে ফেব্রুয়ারিতে জমাট বাঁধে এবং এপ্রিল মাসে গলতে শুরু করে। বরফ কমে যাওয়ায় শিকারের মৌসুম খাটো হয়ে এসেছে। অথচ এই শিকারের ওপর নির্ভর করেই এখানকার মানুষ জীবিকা নির্বাহ করে। বরফের পুুরুত্ব কমে যাওয়ায় সেøজ চলছে না। নির্ভর করতে হচ্ছে যন্ত্রচালিত নৌকার ওপর। এতে শিকার ঠিকমতো করা যাচ্ছে না এবং প্রাপ্তিও ভালমতো জুটছে না। সেøজ গাড়িতে করে একজন শিকারি নিঃশব্দে চুপিসারে শিকারের কাছাকাছি পৌঁছতে পারে। কিন্তু মোটরচালিত নৌযান ব্যবহার করলে সেটির শব্দের কারণে অত কাছে পৌঁছতে পারে না। ফলে শ্বাস নিতে পানির ওপর ক্ষণিকের জন্য মাথা তুলে দেয়া সীলকে দূর থেকে দেখে নৌযানের শিকারি যখন গুলি ছোড়ে সেই গুলি প্রায়শই ঠিকমতো বিদ্ধ হয় না। আবার যদি ঠিকমতো বিদ্ধ হয় তারপরও কথা আছে। গুলিতে মারা পড়া সীল অনেক সময় তুলে নেয়া সম্ভব হয় না। কারণ ওটা সাগরের লবণাক্ত পানির স্তরের ওপর বরফগলা স্বাদু পানির স্তরের মধ্যেই ডুবে যায়। উন্মান্নক ফিয়র্ডের চারপাশের বরফ দ্রুত গলছে। ফলে এই স্বাদু পানির স্তরও গভীর হচ্ছে। মরা সীল ওই স্তর দিয়ে এত নিচে তলিয়ে যায় যে, অনেক সময় সেগুলো আয়ত্তের বাইরেই চলে যায়। জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার যে গ্রীনল্যান্ডের কুকুরও হয়েছে ও হচ্ছে তা হয়ত অনেকের জানা নেই। গ্রীনল্যান্ডের কুকুর বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন জাতের কুকুরগুলোর অন্যতম। সহস্র্র বছর আগে ইনুইটরা সাইবেরিয়া থেকে গ্রীনল্যান্ডে আসার সময় এসব কুকুরও তাদের সঙ্গে এসেছিল। এরা এত হিংস্র যে, মেরু ভালুকের সঙ্গেও লড়তে ছাড়ে না। এরা শুধু যে পোষ মানে তাই নয়, বরফের ওপর দিয়ে ভারি বোঝাসহ সেøজও টানতে পারে। কিন্তু বরফের মৌসুম সংক্ষিপ্ত হয়ে আসার কারণে অনেক শিকারি ইনুইট সারাবছর ধরে কুকুরের পাল আর রাখতে পারছে না। বিশেষ করে সেøামোবাইল সহজলভ্য হয়ে ওঠায় আরও নয়। কেউ কেউ চরম পথটা বেছে নিচ্ছেÑ কুকুরগুলোকে মেরে ফেলছে। এভাবেই জলবায়ুর পরিবর্তন গ্রীনল্যান্ডের জীবন ও পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে চলেছে। ৫০ বছর আগের গ্রীনল্যান্ড আর আজকের গ্রীনল্যান্ডের মধ্যে অনেক পার্থক্য। ১৯৬৫ সালে ইনুইট পরিবারগুলোর ছিল বলতে দাড়টানা নৌকা, হারপুন ইত্যাদি। এখন তাদের জীবনে আধুনিক উপকরণের ছড়াছড়ি। আছে এলইডি টিভি, আইপ্যাড, কম্পিউটার। শিকারের কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে বাইনোকুলার লাগানো রাইফেল। তবে জলবায়ুর পরিবর্তন তাদের বসতির মৌলিক সমস্যাবলীকে বাড়িয়ে তুলেছে। সনাতন অর্থনীতি যথা শিকার ও মাছ ধরা দিয়ে এখন আধুনিক জীবনযাপন করা এবং আধুনিক জীবনোপকরণ সংগ্রহ করা কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়ছে। সাগরের বরফ মুছে যাওয়ার অনেক আগেই এই অর্থনৈতিক ও সামাজিক চাপেই ইনুইটরা তাদের বসতি পরিত্যাগ করতে, নিজেদের লোকালয় ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হতে পারে। গ্রীনল্যান্ডের আরেকটি ব্যাপার আছে যেটা সমাজবিজ্ঞানীদের কাছে গবেষণার বিষয়। তা হলোÑ সেখানে আত্মহত্যার হার বিশ্বের অন্যতম সর্বোচ্চ। দশের কোঠার শেষ দিক এবং বিশের কোটার প্রথম দিকের ছেলেরাই বেশি আত্মহত্যা করে থাকে। এর বিবিধ কারণ আছে বলে মনে করেন গবেষকরাÑ যেমন আধুনিকায়ন, একাকীত্ব, এ্যালকোহল আসক্তি এবং গ্রীষ্মকালে সর্বক্ষণ সূর্যালোকের উপস্থিতির কারণে ঘুমের প্যাটার্নের ব্যাঘাত ঘটা। তবে উন্মান্নক ফিয়র্ডের মতো সুদূরের লোকালয়ের তরুণদের মধ্যে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের ভাবনা আত্মহত্যার একটা বড় কারণ হিসেবে চিহ্নিত। একটা সময় এই গ্রীনল্যান্ডের মানুষ শিকার করে ও মাছ ধরে কোনভাবে জীবনধারণ করত। সে অবস্থা থেকে এক শতাব্দীর ব্যবধানে তারা ফেসবুকের জীবনে চলে এসেছে। এখন তাদের এয়ারলাইন আছে, খনি কোম্পানি আছে। তথাপি জলবায়ুর পরিবর্তন তাদের মৌলিক জীবনধারার প্রতি হুমকি সৃষ্টি করছে। সেই জীবনকে বদলে দিতে চাইছে। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক অবলম্বনে
×