ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

চঞ্চল শাহরিয়ার

চলেই গেলেন

প্রকাশিত: ০৭:০০, ১১ ডিসেম্বর ২০১৫

চলেই গেলেন

জাতীয় দৈনিক পত্রিকার পাতায় যখন পড়লাম ষাট দশকের জনপ্রিয় কবি ওমর আলী আর নেই, মনটা কেঁদে উঠলো তখন আরো একবার। কারণ কবি ওমর আলীর অসুস্থতার খবর আগেই জেনেছিলাম। এরমধ্যে পাবনা শহরেও গেলাম বেশ কয়েকবার। যাচ্ছি যাবো করে তবু প্রিয় কবির কাছে যাওয়া হয়নি। খুবই অনুশোচনায় ভুগছি আজ। ষাট দশকের অন্যতম কবি, এদেশে শ্যামল রঙ রমণীর সুনাম শুনেছি খ্যাত কবি ওমর আলী আমাদের সবারই খুব প্রিয় মানুষ। লেখালেখি শুরুর পর থেকেই বাংলাদেশের সমস্ত জাতীয় দৈনিক, সাপ্তাহিকের পাতায় কবি ওমর আলী প্রচুর কবিতা পড়ার সুযোগ হয়েছে আমাদের। ১৯৯৩ সালের অক্টোবরে আমরা একদল তরুণ কবি মিলে বের করেছিলাম ‘হৃদয়’ নামে একটি সাহিত্য পত্রিকা। কবিতা চেয়েছিলাম প্রিয় কবি ওমর আলীর কাছে। আমাদের কবি বিমুখ করেননি। ডাকযোগে পাঠিয়েছিলেন ‘হৃদয়’ পত্রিকার জন্য কবিতা। বলার অপেক্ষা রাখে না, খ্যাতিমান এই কবির কবিতা পেয়ে আমাদের ‘হৃদয়’ পত্রিকা খুব সমৃদ্ধ হয়েছিল। পরবর্তীতে ‘হৃদয়’ পত্রিকায় লেখা পাঠিয়ে আমাদের উৎসাহিত করেছিলেন বাংলাভাষার প্রধান কবি শামসুর রাহমান। এইসব স্মৃতি বুকে নিয়ে এইসব ভালোবাসা বুকে নিয়ে কতোকাল হলো আমরা কবিতার ভুবন চষে বেড়াচ্ছি। বাংলাদেশে যেসব তরুণ কবি কবিতা চর্চা করেন তারা কবি ওমর আলীর নাম শোনেননি এমন কবি পাওয়া মুশকিল। সারা জীবন দেখলাম কবি ওমর আলীর নাম উচ্চারিত হওয়ার সাথে সাথে যে কেউ মৃচুক হেসে বলে ফেলেন, এদেশে শ্যামল রঙ রমণীর সুনাম শুনেছি। উনিশ শ’ ষাট সালে প্রথম প্রকাশিত ‘এদেশে শ্যামল রঙ রমণীর সুনাম শুনেছি’ কাব্যগ্রন্থটির নাম কিংবদন্তির মতো। সারা পৃথিবীর বাংলাভাষী পাঠক-পাঠিকার মন দখল করে আছে। প্রথম প্রকাশের পঞ্চান্ন বছর পরও যার আবেদন এখনও সমান অটুট। একজন সিদ্ধ পর্যটকের মতো কবি ওমর আলী দেশকে দেখেছেন। আবিষ্কার করেছেন শ্যামল রঙ আর বঙ্গ রমণীর ভালোবাসার উপহার। এক হাতে আতুড়ে শিশু আর অন্য হাতে রান্নার উনান দেখে যেমন বিমুগ্ধ হয়েছেন কবি, তেমনি পঞ্চমুখ হয়েছেন রমণীর সুনামে। কবি তাই মুগ্ধ হয়ে লিখছেনÑ ‘এদেশে শ্যামল রঙ রমণীর সুনাম শুনেছি আইভি লতার মতো সে নাকি সরল, হাসি মাখা সে নাকি স্নানের পরে ভিজে চুল শুকায় রোদ্দুরে রূপ তার এ দেশের মাটি দিয়ে পটে আঁকা।’ (এদেশে শ্যামল রঙ রমণীর সুনাম শুনেছি, পৃষ্ঠা-৯) পদ্মার চর নিয়ে কবি ওমর আলীর আবেগের পাশাপাশি দুঃখ বোধও কম ছিল না। ফেরার সময় কাব্যগ্রন্থে ‘একবার শহরে আসো’ কবিতায় কবি লিখছেনÑ ওহ্্ ছকিরদ্দি ভাই, তুমি কেন পদ্মা নদীর তীরে কিশোরপুরে নতুন জেগে ওঠা চর দখলের কাইজা করতে গেলে রক্ত ক্ষয়া কাইজা করতে গেলে... (ফেরার সময়, পৃষ্ঠা ৪১) নারী, নদী আর প্রকৃতির জন্য কবি ওমর আলীর মন যেমন কেঁদেছে কাব্য ভাবনাকে ভিন্ন রূপ দিতে গিয়েও বৃক্ষরাজির জন্য অনুতপ্ত হয়েছেন। ‘উড়ন্ত নারীর হাসি’ কাব্যগ্রন্থের ‘কবিতা লেখার সমস্যা’ কবিতায় তার উচ্চারণ এ রকমÑ ‘বৃক্ষ তার আকার ইঙ্গিতে বলে আমি যেন তাকে নিয়ে না কবিতা লিখি, অকৃতজ্ঞ মানুষ বৃক্ষের ছায়ায় গ্রীষ্মে পরিতৃপ্ত হয় আর ফল খায় তবুও বৃক্ষের খুনী হয় বৃক্ষকে পুড়িয়ে ছাই করে। (উড়ন্ত নারীর হাসি, পৃষ্ঠা ১১১) বৃষ্টিভেজা মাটির গন্ধে বেড়ে ওঠা কবির আকাক্সক্ষা অনেক। ইঞ্জিনচালিত নৌকা দেখে কবি তবু হতবাক। ঐতিহ্য হারিয়ে যাচ্ছে। কবির সে কী বেদনা। না দেখলে বোঝা যায় না। কবি ওমর আলী ভাবছেন, আমি কি স্বাধীনতা পাবো? দিনের আলোতে ভয় আর রাতে ভুতুড়ে ভয়াল অন্ধকার। তবু কবিতার অক্ষরের অনুরাগে প্রিয় নদী, প্রিয় নারী, প্রিয় স্বদেশকে মমতায় জড়িয়ে রেখেছেন চিরকাল তার কাব্য ভাবনায়। বাংলা একাডেমি পুরস্কার প্রাপ্ত কবি ওমর আলীর জন্ম ১৯৩৯ সালের ২০ অক্টোবর। পাবনা সদর থানার চর শিবরামপুর গ্রামে। মৃত্যু ৩ ডিসেম্বর ২০১৫। নিজ বাস ভবন পাবনার কোমর পুরে। কবি ও অধ্যাপক ওমর আলীর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা পঁয়ত্রিশের অধিক। কবি একবার লিখেছিলেন, প্রকৃতির খেয়ালই বলো আর যাই বলো আমিও কিছু কিছু ভুল করেছি। কি লিখতে যেয়ে কি লিখেছি। প্রিয় কবি, কোন ভুল আপনি আমাদের কাছে করেননি। কোন ভুল কিছু আপনি লেখেননি। সারা জীবন ধরে বাংলা সাহিত্যে যা দিয়েছেন তা আমরা মাথায় করে রেখেছি।
×