ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

রফিকুজ্জামান রণি

কবি ওমর আলী ‘এ দেশে শ্যামল রঙ রমণীর সুনাম শুনেছি’

প্রকাশিত: ০৭:০০, ১১ ডিসেম্বর ২০১৫

কবি ওমর আলী ‘এ দেশে শ্যামল রঙ রমণীর সুনাম শুনেছি’

‘আমার সুন্দরী বাংলাদেশ পদ্ম পুকুরের ঘাটে কখনো স্নানের বেলা ঘষে মেজে পা দুখানা ধোয় দীঘল মেঘের রাশি কালো হাঁটু তার ছোয় পথ নেচে নূপুরের সুর তোলে সে যখন হাঁটে আম কাঁঠালের বনে পাখি নিয়ে দিন তার কাটে উষ্ণ খড়ের নিচে আমার বাংলাদেশ ঘুমায়।’ গ্রামীণ সংস্কৃতি, ইতিহাস-ঐতিহ্য আর লোকপুরাণের নিবিড়তম শিল্পান্বেষীদের মধ্যে রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ এবং পল্লীকবি জসীমউদ্দীন ছিলেন দুটি স্বতন্ত্র ও ভিন্ন কক্ষপথের কবি-নক্ষত্র। প্রবাদপ্রতিম এই মহান দুই কবির কাব্যের বিশুদ্ধ আলোয় গা’ ভাসিয়ে উত্তরকালে এগিয়ে গেছেন অগণন শব্দভাস্কর। এক্ষেত্রে আবুল হোসেন, শামসুর রাহমান, আল-মাহমুদ, আবুল হাসান, ফজল শাহবুদ্দীন, ওমর আলীসহ অজস্র কবির নাম উল্লেখ করা যায়। তবে বাংলা-সাহিত্যের জীবন্ত কিংবদন্তি আল-মাহমুদ আর ওমর আলী র্দীঘপরিক্রমায় সে পথের সারথি হয়েছেন বটে কিন্তু জীবনানন্দ দাশ ও জসীমউদ্দীনের মাঝামাঝি পর্যায়ে দাঁড়িয়ে কবি আল-মাহমুদ নিজেই নির্মাণ করেছেন ভিন্নতর এক কবিতার জগৎ, ক্লাসিক্যাল শব্দের গৃহ। এ ক্ষেত্রে আল-মাহমুদের মতো একেবারেই ব্যতিক্রমসিদ্ধ বলয় সৃষ্টিতে কবি ওমর আলী শতভাগ সাফল্য না পেলেও তাঁর কাব্য-উদ্যান ছিল স্বকীয় বৃক্ষে ঠাসা এবং সুগন্ধি ফুলে ভরা। দ্বিধাহীনভাবেই ‘বলা যেতে পারে ওমর আলী ত্রিশের যে স্রোত ত্রিশের সীমানা পেরিয়ে ষাটেও দিব্যি প্রভাব-রাজত্ব বিরাজ করে চলছিল, ওমর আলী সে ধারা থেকে সম্পূর্ণভাবে বেরিয়ে আসা স্বতন্ত্রধারার এক কবি। যেখানে তাঁর দেশ-মাটি-মানুষই প্রধান ও আরাধ্য। তাঁর হাতেই এখান থেকে বাংলা কবিতা আর এক নতুন বাঁক পায়।’ তবে জীবনানন্দ দাশ ও জসীমউদ্দীনের কবিতার ধারাকে যে ওমর আলীর লেখা অনেক বেশি সম্প্রসারিত করেছে এ কথা খুব সহজেই উপলব্ধি করা যায়। দুজন অগ্রজ কবির পদাঙ্ক অনুসরণ করেই তিনি গ্রাম-বাংলার প্রকৃতি, পরিবেশ-প্রতিবেশকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন এবং তা প্রাণবন্ত ও বাস্তবচিত্রে তুলে ধরার প্রয়াসী হয়েছেন। ‘ওমর আলীই একমাত্র কবি যিনি গভীর মমতায় গ্রাম আর গ্রামের মাটিকে কবিতায় গ্রহণ করেছিলেন আপদমস্তক।’ গল্পের ঢংয়ে কবিতা বলে কবিতাকে দুর্বোধ্যতার জাল থেকে মুক্ত করার জন্যে নিরন্তর পরিশ্রম করে গেছেন তিনি। ওমর আলীর কবিতায় ‘পরিবেশ পটভূমির বর্ণনার ক্ষেত্রে পাবনার বিভিন্ন অঞ্চল প্রাধান্য পেয়েছে। যেমন, ঘোষপুর, কোমরপুর, শীতলাই, রাঘবপুর, মহেন্দ্রপুর। এছাড়া অন্যান্য স্থানের মধ্যে শিলাইদহ, পোড়াদহ, ঈশ্বরনী, সাখটা থানা, ত্রিশাল, আতাইকুলা, ভেড়ামারা ইত্যাদি।’ ফলে তাঁর কাব্যের ভাষার মতো নায়ক-নায়িকাদের জীবনাচরণও অনাড়ম্বর এবং তাদের নাম-পদবিও গ্রামীণ সমাজের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। যেমন সালমা, রতœা, রেবা, হাসিনা, ফরিদা, রমজান আলী, গণেশ, সালাম, মালেকা, বিমলা, সূর্যভান, পরীবানু ইত্যাদি। জসীমউদ্দীনের রুপাই, আসমানী আর ডালিম গাছের মতোন ওমর আলীর কবিতার নায়ক-নায়িকা এবং সামাজিক উপাদানগুলোও সমাজবাস্তবতার মধ্য থেকেই আহরণ করে নিয়েছেন তিনি। ওমর আলীর কবিসত্তাকে জাগ্রত করেছে বাঙালীর অস্তিত্বের সঙ্গে মিশে থাকা অনন্তকালের লোককাহিনী, রূপকথা, বত্রিশ-পুতুলের গল্প, ভূত-প্রেতœীর গালগল্প আর চিরসজীবতায় ছাওয়া গ্রাম-বাংলার প্রকৃতি-নিসর্গ। তাছাড়া আরব্য রজনীর গল্প আলিফ লায়লা, ঈশপের গল্প, পঞ্চতন্ত্র ও গোপাল ভাঁড়ের গল্পের প্রভাবও তাঁর লেখনীশক্তিকে অনেক বেশি ঋদ্ধ করেছে। কবিতায় আশ্চর্য দর্শনতত্ত্বমূলক সংলাপ আর আঞ্চলিক ভাষার সুক্ষ্ম ব্যবহার তাঁকে দিয়েছে রাতারাতি কবিখ্যাতি। সংলাপের আশ্চার্য নৈপুণ্যতা অর্জনের ক্ষেত্রে তিনি আরবি ভাষার কবি কাহলিল জিবরান ও মার্কিন কবি স্টিফেন ক্রেনের আদর্শকেই অনুসরণ করেছেনÑ এ কথা দ্বিধাহীনভাবে স্বীকারও করেছেন তিনি। ওমর আলীর ‘একদিন একটি লোক’ শিরোনামের বিখ্যাত সংলাপধর্মী কবিতাটির চমকপ্রদ উপস্থাপন, সুনিবিড় অন্ত্যমিল এবং শ্লেষমাখা মানবিক ক্ষোভের দৃশ্যপট পাঠককে দারুণভাবে আকৃষ্ট করেÑ ‘একদিন একটি লোক এসে বললো ‘পারো?’ বললাম, ‘কি?’ একটি নারীর ছবি এঁকে দিতে, ‘সে বললো আরো।’ ‘সে আকৃতি অদ্ভুত সুন্দরী, দৃপ্ত, নিষ্ঠুর ভঙ্গিতেÑ পেতে চাই নিখুঁত ছবিতে।’ ‘কেন?’ আমি বললাম শুনে। সে বললো, ‘আমি সেটা পোড়াবো আগুনে।’ [এদেশের শ্যামল রঙ রমণীর সুনাম শুনেছি] ওমর আলী এদেশের সাধারণ মানুষের মুখের কথাকে কবিতায় রূপ দিয়েছেন। তাঁর মতো এতো চমৎকারভাবে আর কে বলতে পেরেছেনÑ ‘লোকটা সুতি কাপড় পরেনি, পরেছে শুধু মাটি।’ বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম যখন তেজদীপ্তকণ্ঠে গর্জনসূচক ধ্বনি তুলে বলে ওঠেনÑ ‘এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরি আরেক হাতে রণতূর্য’ তখন ওমর আলী গ্রাম্যবধূর জীবন ছবি আঁকতে আঁকতে একেবারেই স্বাভাবিককণ্ঠে গেয়ে ওঠেন ‘এক হাতে আঁতুর শিশু অন্য হাতে রান্নার উনুন।’ অন্যান্য কবিরা যখন সহজাতভাবেই কল্পনাপ্রবণ আর আবেগনিমগ্ন হয়ে ওঠেন তখন তিনি বাস্তবতার আঁধারে হাত বাড়িয়ে কবিতাকে ছেঁকে আনার কাজে নিজেকে নিয়োজিত করে রেখেছেন। তাঁর কবিতা পড়লেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে চিরচেনা গ্রাম-বাংলার সহজ-সরল মানুষের জীবনের জলছবি। তাঁর এক একটা কবিতাই যেন এক একটা বাংলাদেশ! প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী এসএম সুলতানের চিত্রকর্মের মতো এদেশের সহজ-সরল, সাদামাটা নারীদের জীবনছবি তিনি এঁকেছেন কবিতার তুলিতে। ওমর আলীর কবিতার বহুরৈখিক স্বর ও সামাজিক উপাদান সস্পর্কে ড. রকিবুল হাসান ‘ওমর আলীর কবিতা : ঐতিহ্যের প্রলুব্ধতা ও আধুনিকতার সম্বিৎ’ প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন,Ñ‘ওমর আলীর কবিতার বিষয়বস্তু গ্রামীণজীবন-সমাজ ও পরিবেশ নির্ভর হলেও, চেতনাগতভাবে বহুমাত্রিকতা আছে। দৈনন্দিন জীবন থেকে শুরু করে রাষ্ট্র-দেশ-কাল-অর্থনীতি-রাজনীতি সবকিছু তাঁর কবিতায় প্রসঙ্গ-অনুষঙ্গ হয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা মাটির সঙ্গে থেকেছেন তিনি, মাটির মানুষকে স্পর্শ করে থেকেছেন/.../ তাঁর সব কবিতাগ্রন্থ গ্রামের নিখাদ গন্ধেভরা। একই সঙ্গে গ্রামের মানুষের আনন্দ-বেদনা, দুঃসহ জীবন যন্ত্রণাকে সূক্ষ্মভাবে দেখেছেন, দেশ-কাল-সমাজ-স্বাধীনতা, জৈবিকতা-প্রবৃত্তি নানা বিষয় উপজীব্য করেছেন কবিতায়। বেদনার্ত মানুষের সঙ্গে একাত্ম হয়ে তাদের দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রণা নিজের করে পাশে থেকেছেন।’ গ্রামীণ সমাজের নারীদের ছোট ছোট স্বপ্ন, ¯েœহ-মমতা, চাওয়া-পাওয়া, গৃহের মায়া, পরিবারের প্রতি ভালোবাসা, সন্তান উৎপাদনের গর্বের কথাচিত্র তাঁর কবিতায় ক্যামেরার মতো এসে ধরা দেয়। গ্রাম-বাংলার হাসিখুশি মুখ নিয়ে লজ্জায় আনত হয়ে যাওয়া মেয়েদের তিনি তুলনা করেছেন আইভি লতার সঙ্গে। তাদের এই বাঁধভাঙা রূপযৌবন, আচরণ-সারল্য যে এদেশেরই কোন নদ-নদীর চলৎগতির প্রভাব থেকে জন্ম নিয়েছে সে ব্যাপারেও কবি নিশ্চিত। শরীরে হালকা লতার মতো ঝুলে থাকা শাড়ি, গোবর মাখানো আঙুল আর হতদরিদ্র কৃষাণের গৃহলক্ষ্মী হয়েও যখন তারা সন্তুষ্ট থাকে এবং কর্মব্যস্ততাকে পরম আপন করে নিয়ে আবাদজীবী স্বামীর সঙ্গে জীবনটাকে মানিয়ে নেয়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে থাকেÑ তখন কবির বুক অপার আনন্দে ভরে ওঠে। মায়ের জাতি নারী সমাজের জীবনের এতো নির্মোহ নমনীয়তা দেখলে তাঁর বিস্ময়ের অবধি থাকে না। জনশ্রুতিতে ভেসে বেড়ানো এদেশের রমণীদের প্রশংসা বাক্যগুলো গল্পচ্ছলে তিনি কবিতায় স্থান দিয়েছেন এবং জানিয়ে দিয়েছেন কবিতার পাঠককেÑ এদেশের শ্যামল রঙ রমণীর সুনাম শুনেছি আইভি লতার মতো সে নাকি সরল, হাসিমাখা; সে নাকি ¯œানের পরে ভিজে চুল শুকায় রোদ্দুরে রূপ তার এদেশের মাটি দিয়ে যেন পটে আঁকা। সে শুধু অবাক হয়ে চেয়ে থাকে হরিণীর মতো মায়াবী উচ্ছল দুটি চোখে, তার সমস্ত শরীরে এদেশেরই কোন এক নদীর জোয়ার বাঁধভাঙা হালকা লতার মতো শাড়ি তার দেহ থাকে ঘিরে। সে চায় ভালোবাসার উপহার সন্তানের মুখ, এক হাতে আঁতুর শিশু, অন্য হাতে রান্নার উনুন, সে তার সংসার খুবই মনেপ্রাণে পছন্দ করেছে; ঘরের লোকের মন্দ আশঙ্কায় সে বড় করুণ। সাজানো গোছানো আর সারল্যের ছবি রাশি রাশি ফোটে তার যতো গড়া সংসারের আনাচে-কানাচে এদেশে শ্যামলরঙ রমণীর এ ব্যাপারে খ্যাতি; কর্মঠ পুরুষ সেই সংসারের চতুষ্পার্শ্বে আছে।’ ওমর আলী শব্দকে পরিয়েছেন মৃত্তিকার পোশাক। আর সেকারণেই তাঁর কবিতায় গ্রাম-বাংলার রন্ধ্র্রে রন্ধ্রে জড়িয়ে থাকা দুঃখ-কষ্টের কথা যেমন ঠাঁই পেয়েছে তেমনিভাবে পেয়েছে হাসি-আনন্দের গল্পও। একই সঙ্গে চিত্রিত হয়েছে গ্রাম্য-লম্পট, দুশ্চরিত্রবান মানুষের চিত্রও। হতদরিদ্র ঘরের মেয়েরা যুবতী হয়ে ওঠার আগেই যে কতোশত বিড়ম্বনার শিকার হতে হয় সে কথাও স্পষ্ট হয়ে ধরা দেয় তাঁর কাব্যে। ক্উেবা আবার যুবতী হতে না হতেই কলিতেই ঝরে পড়ে, অকালেই নিঃশেষ হয়ে যায় হায়েনার থাবায়। বিয়ে না হওয়া অথবা বিয়ে হওয়ার আগেই প্রতারণা-প্রবঞ্চনার শিকার হওয়া অথবা মানবরূপী পশুর হাতে সতীত্ব খোয়ানো তরুণীদের কথাও তাঁর কবিতার জায়গা পেয়েছে। নারীত্বের পূর্ণ স্বাদ গ্রহণ করতে না পারা তরুণীদের দীর্ঘশ্বাসের ধ্বনিই যেন তাঁর কাব্যের দেয়ালে বার বার প্রতিধ্বনিত হয়ে ওঠেÑ ‘কুমারী আরো বেশি লাবণ্য কুমারী হবার আগেই তার ললিত যৌবনের ক্ষয় কিংবা নতি দেখতে শুরু করে কিংবা অনেকেই যুবতী হতে হতে আর যুবতী হয় না।’ বাংলাসাহিত্যে আঞ্চলিকভাষার কাব্যসৃষ্টিকারীদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি ওমর আলী। প্রমিত এবং আঞ্চলিকভাষার যুগলস্পর্শে গ্রাম-বাংলার মানুষের হাসি-কান্না, মান-অভিমানের দৃশ্য তাঁর কবিতায় সুনিপুণভাবে ওঠে এসেছে। ফলে সে কবিতা শুধুমাত্র একটি অঞ্চলের মানুষেরই জীবনগাথা হয়ে পড়ে থাকেনি, ভাষার তারতম্য থাকলেও সেটা হয়ে পড়েছে পুরো বাংলাদেশেই সমাজচিত্র। কবির আঞ্চলিকভাষায় রচিত ‘আমি কিন্তু যামুগা’ শিরোনামের বিখ্যাত ও বহু নন্দিত কবিতাটি পাঠ করলেই অনুমান করা যায় আতশ কাঁচের মতো তাঁর দৃষ্টিশক্তি কতোটা প্রখর, তীক্ষ্ম। এদেশের সরলসোজা সাধারণ ঘরের নর-নারীদের পারিবারিক খুনসুটি, বোকাটেপনা ও নান্দনিক বিবাদের দৃশ্য কবিতার ভাষায় অত্যন্ত নিখুঁতভাবে তুলে ধরেছেন তিনিÑ ‘আমি কিন্তু যামুগা। আমারে যদি বেশি ঠাট্টা করো। হুঁ, আমারে চেতাইলে তোমার লগে আমি থাকমু না। আমারে যতোই কও, তোতা পাখি, চান, মণি, সোনা। আমারে খারাপ কথা কও ক্যান, চুল টেনে ধরো। আমারে ভ্যাংচাও ক্যান, আমি বুঝি কথা জানিনাতো। আমার একটি কথা নিয়ে তুমি অনেক বানাও। তুমি বড় দুষ্ট, তুমি আমারে চেতায়ে সুখ নাও, অভিমানে কাঁদি, তুমি তখন আনন্দে হাসতে থাকো। শোবোনা তোমার সঙ্গে, আমি শোবো অন্যখানে যেয়ে আর এ রাইতে তুমি শুয়ে রবে একা বিছানায় দেখুম ক্যামনে তুমি সুখী হও আমারে না পেয়ে না, আমি এখনি যাইতেছি চলে অন্য কামরায়।’ [এদেশের শ্যামল রঙ রমণীর সুনাম শুনেছি] আশ্চর্য হলেও সত্য যে, ওমর আলীর অন্যতম সেরা সৃষ্টি ‘আমি কিন্তু যামুগা’ শিরোনামের আঞ্চলিক ভাষার এই কবিতাটি তাঁর এক বন্ধুর অনুরোধে লেখা! কবির বন্ধু লুৎফুর রহমান চৌধুরীর অনুরোধে তাঁর আরেক বন্ধু দেওয়ান আবদুল কাদের বিয়ের পর নবদম্পত্তির সাংসারিক মধুর সংলাপগুলোই এতে ঠাঁই পেয়েছে। অথচ কালের বিচারে অনুরোধ রক্ষার কবিতাটিই হয়ে গেল কবির অন্যতম শ্রেষ্ঠ রচনার একটি! এক্ষেত্রে মধ্যযুগের শ্রেষ্ঠ কবি সৈয়দ আলাওলের সঙ্গে তাঁর আশ্চর্য মিল! কেননা, আরাকান রাজা সাদ থদোমিন্তরের রাজত্বকালে (১৬৪২-৫২) রাজ্যের মন্ত্রী কোরেশী মাগন ঠাকুরের নির্দেশে ১৬৫১ খ্রিস্টাব্দে সৈয়দ আলাওল রচনা করেছিলেন ‘পদ্মাবতী’ কাব্য। কালের বিচারে সেটাই এখন মধ্যযুগের শ্রেষ্ঠকাব্য হিসেবে গণ্য করা হয়। আলাওল যেমন প্রমাণ করে দিয়েছেন ফরমায়েসি লেখাকেও কালজয়ী করে তোলা সম্ভব। তেমনিভাবে ওমর আলীও দেখিয়ে দিলেন অনুরোধ রক্ষায় রচিত লেখাও কখনো কখনো সমকালকে ছাড়িয়ে মহাকালের দিকে পেখম মেলতে পারে। রোমান্টিক ধারার কবিতাচর্চার ক্ষেত্রেও সিদ্ধহস্ত ছিলেন ওমর আলী। তবে সেখানেও গ্রাম এবং গ্রামের মানুষই প্রাধান্য পেয়েছে। মননের দিক থেকে সর্বদাই তিনি ছিলেন গ্রামীণ জনপদের আধুনিক বাউল। প্রয়োজনীয়তার কারণেই মূূলত ওমর আলী জীবনের বিশেষ একটা মুহূর্ত শহরে কাটিয়েছেন, তবে জীবনের বেশিরভাগ সময়ই তাঁর কেটেছে গ্রামে। গ্রাম-বাংলার আলোছায়া, ধুলাবালিতেই তাঁর মনভ্রমরা পড়ে থাকতো সবসময়। নগরজীবনেও গ্রামের মেঠোপথ যেন তাঁর সান্নিধ্যের লোভে বুক চিতিয়ে রাখতো সর্বদা। শহরের জীবনধারা গ্রামে নয়, বরঞ্চ গ্রামের জীবনধারাকেই তিনি শহরের মানুষের কাছে ফেরি করে বেড়িয়েছেন কবিতার আদলে এবং বার বার মৃত্তিকা ফুঁড়ে কুড়িয়ে এনেছেন কবিতার নুড়ি। ফলে শহরে এসেও সাধারণভাবে জীবনযাপন করেছেন তিনি। ব্যক্তিজীবনেও ছিলেন যথেষ্ট সহজ-সরল আর নির্লোভী মানুষ। তাঁর রোমান্টিকতাও যে গ্রামকে ছুয়েছিল ‘এখন পালাও দেখি’ অথবা ‘তোমার চিঠি তোমার অক্ষরের চুমো!’ কবিতার দিকে তাকালেই তার প্রমাণ মেলেÑ ‘এখন পালাও দেখি বন্ধ করে দিয়েছি দরোজা! এ রাত্রিতে, আমার দুহাত থেকে পারো না পালাতে। বরং সেটাই মেনে নেয়া ভালো, যা নির্ঘাত সোজা। আমার আলিঙ্গনে বেঁধে থাকো এ সুন্দর রাতে। মিছেমিছি কেন তুমি রাগ করে চলে যেতে চাও! বেশ তো, আমার সঙ্গে আজ রাতে কথা বলবে না। হয়েছে তোমার রাগ, আলাদা কি হবে বিছানা? অন্যখানে শুতে যাবে, কিছুতেই হবে না, হবে না! চামেলী, মালতী আর রজনীগন্ধার সুরভিতে তোমার বিত্বল দেহ, সে সুরভি সারা ঘরময় আর সে সুরভি যেন কেঁপে ওঠে তোমার নীবীতে রাত্রিতে তোমাকে ছেড়ে একা থাকা,...বড় কষ্ট হয়! হে অভিমানীনী, আমি অসহায়, বড়ই কাতর, প্রেয়সী, মিষ্টি হেসে ক্ষমা করো, তুমি নও পর।’ অথবাÑ ‘তোমার আলোতেই আমাকে আলোকিত করবো আমার আলাদা চোখের কীইবা আর প্রয়োজন আছে! তোমার চোখই আমার চোখ তোমার আলোই আমার আলো তোমার ব্লাউজ একবারই শুধু হেসে উঠেছিল খিল খিল করে তুমি তখনই নখের আঁচড়ে চোখ পাকানো নিষেধ টেনেছিলে।’ মাটি মানুষ প্রকৃতির কবি ওমর আলীর মৃত্যু হয়েছে কিন্তু বেঁচে আছে তার কবিতা। কবিতার মধ্যে বেঁচে থাকবেন তিনি।
×