ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বীরেন মুখার্জী

জীবনাগ্রহ থেকে উৎসারিত বোধ

প্রকাশিত: ০৬:৫৯, ১১ ডিসেম্বর ২০১৫

জীবনাগ্রহ থেকে উৎসারিত বোধ

জীবন এক বহুমাত্রিক ঘটনার সন্নিবেশ। ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয় প্রবণতা জীবদ্দশায় মানুষকে ছুঁয়ে যায়। ইতিবাচক প্রতিক্রিয়ায় মানুষের আচরণে উৎফুল্ল ভাব প্রকাশ পেলেও নেতিবাচক প্রবণতায় মানুষকে মুষড়ে পড়তে দেখা যায়। মানুষ তবু প্রতিনিয়ত জীবনকে খোঁজে তার চারপাশের বিপন্নতা, সংশয়, অবিশ্বাস ইত্যাদির ভেতর। অবিশ্বাসে স্খলিত মানুষ যেমন বার বার জড়িয়ে নিতে চায় বিশ্বাসের পরিধেয়, তেমনি সংশয়ের মেঘে আচ্ছন্ন থেকেও সূর্যকরোজ্জ্বল দিনের প্রত্যাশা করে। পীড়িত নৈঃশব্দ্যের মধ্যেও শুনতে পায় আত্মার কলরব, ডাক শোনে প্রণয়ের। আর শিহরিত হয় পিপাসা-কাতর হৃদয়ের ভয়ার্ত রোমাঞ্চে। শূন্যতার বোধে বিলীন হয়েও জীবনের অভীপ্সা থেকে কিছুতেই বিচ্যুত হয় না মানুষ। সৃজনশীল মানুষের ক্ষেত্রে এই প্রবণতা ব্যাপকভাবে প্রভাব বিস্তার করে তার রচনায়। বিনয় মজুমদারও এমনি এক কবিসত্তা, যিনি পরিব্যাপ্ত আঁধারে খুঁজে ফিরেছেন জীবনের উদ্দীষ্ট লক্ষ্য। তার কবিতা পাঠে মানুষের অস্তিত্ব সঙ্কটজনিত যে জীবনদর্শন স্পষ্ট, তা বোধ করি প্রবল জীবনাগ্রহ থেকে উৎসারিত বোধের সমাহার। তার ‘ফিরে এসো, চাকা’, ‘বাল্মীকির কবিতা’, ‘আমাদের বাগানে’, ‘আমি এই সভায়’, ‘এক পঙ্ক্তির কবিতা’, ‘আমিই গণিতের শূন্য’, ‘এখন দ্বিতীয় শৈশবে’, ‘কবিতা বুঝিনি আমি’, ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’, ‘নক্ষত্রের আলোয়’, ‘গায়ত্রীকে’, কিংবা ‘হাসপাতালে লেখা কবিতাগুচ্ছ’Ñ যে দিকেই চোখ ফেরানো যায়, জীবন অন্বেষণের নানামাত্রিক চিত্রই যেন দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। তার কবিতা থেকে পাঠ নেয়া যেতে পারেÑ ‘যাক, তবে জ’লে যাক, জলস্তম্ভ, ছেঁড়া ঘা হৃদয়। সব শান্তি দূরে থাক, সব তৃপ্তি, সব ভুলে যাই। শুধু তার যন্ত্রণায় ভ’রে থাক হৃদয় শরীর। তার তরণীর মতো দীর্ঘ চোখে ছিলো সাগরের গভীর আহ্বান, ছায়া, মেঘ, ঝঞ্ঝা, আকাশ, বাতাস। কাঁটার আঘাতদায়ী কুসুমের স্মৃতির মতন দীর্ঘস্থায়ী তার চিন্তা; প্রথম মিলনকালে ছেঁড়া ত্বকের জ্বালার মতো গোপন, মধুর এ-বেদনা। যাক, সব জ্ব’লে যাক, জলস্তম্ভ, ছেঁড়া ঘা হৃদয়।’ বিনয়ের বিখ্যাত ‘ফিরে এসো, চাকা’ কবিতাগ্রন্থের ‘২২জুন, ১৯৬২’ শীর্ষক কবিতাটির মর্মার্থ, গভীর অস্তিত্ব সঙ্কটের নির্দেশক, যা লেখাই বাহুল্য। কবিতায় যে হতাশার বিন্যাস তা অপ্রাপ্তির দহনে জর্জরিত এক আত্মস্মৃতি হিসেবেও প্রতীয়মান। আবার কবিতাটির সূচনাবিন্দু থেকে সমাপ্ত রেখা পর্যন্ত কবি নিজের উদ্দেশ্যেই যেন কথা বলেছেন, নিজেকে সান্ত¡না দিতে প্রয়োগ করেছেন সঞ্চিত অভিজ্ঞতা। তিনি অবলীলায় উচ্চারণ করেছেন অপ্রাপ্তির বেদনাÑ‘প্রথম মিলনকালে ছেঁড়া/ত্বকের জ্বালার মতো গোপন, মধুর এ-বেদনা।’ বিনয় মজুমদার জীবনের নানা অপ্রাপ্তি-হতাশার মধ্যে বসবাস করেও জীবনের যে ‘আদিরসাত্মক’ সত্য খুঁজে চলেছেন, তা এই কবিতাটিতে নানামাত্রিক ব্যঞ্জনা নিয়েই প্রতিফলিত। অস্বীকারের উপায় নেই যে, বিনয়ের কবিতা তীব্র প্রেমানুভবে জারিত পঙ্ক্তিমালা। তার কবিতায় যেমন নীলাকাশের গায়ে নক্ষত্ররা কথা বলে। তেমনি গাঢ় রাত্রিতে কবি খোঁজেন অন্ধকারের সৌন্দর্য। তবে কবিতার অবয়ব সৃষ্টিতে তিনি কখনো কৌশলী নন। হৃদয়ের আকুতি দিয়ে এঁকেছেন কবিতার চোখ। নিসর্গ ও প্রেম যেন পরস্পরের সম্পূরক হয়ে হাঁটে তার কবিতায়Ñ ‘আমরা যা করি তার সবই এই আঁকাআঁকি কোনটাই মূল নয় সবই ছবি করে আঁকা।’ আঁধারে নিজের হাত দেখা না গেলেও কিন্তু তারা দেখা যায়।’ বিনয়ের কবিতার মানসযাত্রায় সৃষ্টির মূল সূত্রগুলি জীবনের সত্যে পর্যবসিত হয়। কেননা, বিরহের আগুনে পুড়ে পুড়ে মানুষ খাঁটি হয়, জীবনের শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে। নারী প্রেরণা কাউকে পূর্ণ করে, আবার কাউকে ভাসিয়ে দেয় নিঃসীম শূন্যে। বিনয় মজুমদার শূন্যেই পুড়েছেন। পুড়ে পুড়ে খাঁটি হয়েছেন আর অক্ষরে অক্ষরে গেঁথেছেন জীবনের বোধগুলো। যে পথে কথারা বাক্সময় হয়ে ওঠে, সেই পথে হেঁটেই আত্মসিদ্ধি লাভে সচেষ্ট থেকেছেন। তার কবিতাভাষ্যে গভীরভাবে সঞ্চালিত করেছেন, আত্মত্যাগ, দুঃখবোধ, মৃত্যুচেতনা, বিচ্ছিন্নতাবোধ, নিঃসঙ্গচেতনা, স্মৃতিমুগ্ধতা, যা তাকে ক্রমেই আত্মমুখীন করে তুলেছেÑ ‘বিপন্ন মরাল ওড়ে, অবিরাম পলায়ন করে, যেহেতু সকলে জানে তার সাদা পালকের নীচে রয়েছে উদগ্রউষ্ণ মাংস আর মেদ;’ বিনয় মজুমদারের কবিতার সরলপাঠে একটি বিষয় স্পষ্ট যে, তিনি সমাজ-মানুষের কাছে যেমন অবহেলা পেয়েছেন তেমনি বঞ্চিত হয়েছেন নারীসঙ্গ। সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন জাগতে পারে, কী পেয়েছেন এই কবি? আপাতসরল বিবেচনায় ‘জীবনের অধিকাংশ সময় না খেয়ে রোগে-শোকে ভুগে এক নির্জনতার মধ্যে শেষ হয়ে গেছেন’ তিনি। অথচ তিনি জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ছিলেন যৌক্তিক এবং সূত্রসন্ধানী। ‘আত্মপরিচয়ে’ তিনি কবিতাযাপনের নানা দিক উন্মোচন করেছেন। কবিতার উৎপত্তি বিষয়ে বলেছেনÑ ‘চারিপাশে যে সকল দৃশ্য দেখি, আমরা সকলেই দেখি, তার হুবহু বর্ণনা লিখলে কবিতা হয় না। সেই দৃশ্য আদৌ কেন আছে, কী কারণে বিশ্বে তার থাকার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে, বিশ্বের নিয়মাবলী ও গঠন প্রকৃতি ঐ দৃশ্যে কতটুকু প্রকাশিত হয়েছেÑ এইসব বর্ণনার সঙ্গে যুক্ত করে না দিলে আধুনিক কবিতা হয় না। কিন্তু যুক্ত করতে হলে ঐসব জানা থাকা দরকার! এইসব দার্শনিক বিষয় ভাবতে ভাবতে আমার সময় চ’লে যেতো মাসের পর মাস।’ ফলে কবিতায় দর্শনের প্রয়োজন কিনা সে বিষয়টিও প্রশ্ন হয়ে দেখা দেয়। অবশ্য বিনয়ই এ প্রশ্নের মীমাংসা করেছেনÑ ‘...দর্শনের উপস্থিতি কবিতায় একেবারে প্রত্যক্ষ না-হলেও চলে, হয়তো তার আভাস-মাত্র থাকলেই হয়। কিন্তু আভাসই হোক আর যাই হোক, উপস্থিতি অবশ্যই প্রয়োজন। এই উপস্থিতিই পাঠকের মনকে ভাবাবেগে আন্দোলিত করে, রসাপ্লুত করে, কবিতাকে চিরস্থায়ী করে।’ ফলে বিনয়ভাষ্য অনুযায়ী, পাঠকের মনকে ভাবাবেগে আন্দোলিত করতে রপাপ্লুত করতে এবং কবিতাকে চিরস্থায়ী রূপ দিতে দর্শনযুক্ত কবিতা রচনারও প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যায় না। বিনয়ভাষ্যেই এর মীমাংসা রয়েছেÑ ‘ফিরে এসো, চাকা’র এ কবিতাটির দর্শন সম্পর্কে কবি বলেছেন, এখানে ফুল ও কাঁটা ব্যবহৃত হয়েছে অভিজ্ঞতার সঙ্গে তুলনা করার জন্য। ফুল যেমন সুন্দর, নক্ষত্রও ঠিক এরকম একটি সুন্দর দৃশ্য। তার মানে অভিজ্ঞতাগুলোও সুন্দর। তবে এও সত্য যে ফুলের সৌন্দর্যের সঙ্গে কিন্তু কাঁটা থেকে যায়। এভাবে সুন্দর অভিজ্ঞতা হতে গিয়ে নির্মম বাধা আসেÑ এ হয়তো নিয়ম। এই দার্শনিক তত্ত্ব বোঝাবার জন্যই ফুলের উপস্থিতি। অর্থাৎ উপমা দেয়া মানে খানিকটা দর্শন এনে হাজির করা। শুধু ‘ফিরে এসো, চাকা’ নয়, বিনয়ের প্রায় সব কবিতা এমন দর্শনের উপস্থিতি লক্ষণীয়। আর বস্তুবিশ্বের পরিপ্রেক্ষিতে দুঃখবাদের সমীকরণ মেলাতে মগ্ন থাকতে দেখা যায়। তার ‘একটি উজ্জ্বল মাছ’ কবিতায় গণিতের সমীকরণে জীবনের উপলব্ধির চিত্র উজ্জ্বলভাবে উপস্থিত। ‘একটি উজ্জ্বল মাছ একবার উড়ে দৃশ্যত সুনীল কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে স্বচ্ছ জলে পুনরায় ডুবে গেলোÑ এই স্মিত দৃশ্য দেখে নিয়ে বেদনায় গাঢ় রসে আপক্ব রক্তিম হলো ফল।] কবি বিনয় মজুমদারের কবিতা কিংবা তার নামের সঙ্গে ‘গায়ত্রী’ নামটি প্রাসঙ্গিকভাবেই উচ্চারিত হয়। গায়ত্রীকে ভালোবেসেছিলেন বিনয় মজুমদার। তবে এই ভালোবাসা ছিল নীরব ও একমুখী। গায়ত্রীর সাড়া না তীব্র মানসিক যন্ত্রণাকাতর হয়ে পড়তে দেখা যায় কবিকে। প্রত্যাখ্যাত হয়ে তিনি ছটফট করেছেন শরবিদ্ধ হরিণের মতো। আর শব্দসমবায়ে কবিতায় তুলে এনেছেন সেই হৃদয়ার্তি। দর্শনসহযোগে ব্যাখ্যা করেছেন জীবনাভিজ্ঞতার নির্যাস। তার কবিতা থেকেই পাঠ নেয়া যাকÑ ‘তুমি আর আমি কিন্তু দুজনেই বুড়ো হয়ে গেছি। আমার মাথার চুল যে রকম ছোটো করে ছাঁটা ছবিতে দেখেছি আমি দৈনিক পত্রিকাতেই; যখন দুজনে যুবতী ও যুবক ছিলাম তখন কী জানতাম বুড়ো হয়ে যাব?’ আবার, ‘এখন অপেক্ষা করি, বালিকাকে বিদায় দেবার বহুপরে পুনরায় দর্শনের অপেক্ষার মতোÑ হয়তো সর্বস্ব তার ভরে গেছে চমকে চমকে। অভিভূত প্রত্যাশায় এরূপ বিরহব্যথা ভালো। বিরহপ্রবণতার মধ্যে সমর্পিত থাকতে থাকতে কবি এক সময় বিরহকে মেনে নিতে বাধ্য হন। উচ্চারণ করেনÑ ‘অভিভূত প্রত্যাশায় এরূপ বিরহব্যথা ভালো’ কিংবা, ‘এই পরিণাম কেউ চাই না, হে মুগ্ধ প্রীতিধারা,/গলিত আগ্রহে তাই লবণ অর্থাৎ জ্যোৎস্নাকামী’। আবার এ-ও জীবনের এক নিষ্ঠুর ও পরমসত্য, মানুষের বার্ধক্যবস্থায় উপনীত হওয়া। যৌবনে মানুষ এটাকে পাত্তা না দিলেও একসময় ঠিকই এই চরমসত্যকে মেনে নিতে বাধ্য হন। বিনয়ও নিয়েছেন। জীবনের নানামাত্রিক ঘাত-প্রতিঘাতে সমর্পিত হয়েও খোঁজ করেছেন প্রকৃত জীবনের। বিনয়ের প্রবল জীবনাগ্রহের বিষয়টি তার কবিতাকে করে তুলেছে জীবনেরই পরিপূরক।
×