ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মিজানুর রহমান বেলাল

ঠিক সন্ধ্যার আগে বোধানুভবের ভাবনাদর্শন

প্রকাশিত: ০৬:৫৮, ১১ ডিসেম্বর ২০১৫

ঠিক সন্ধ্যার আগে  বোধানুভবের ভাবনাদর্শন

কবিতা গণিত কিংবা রসায়ন বিজ্ঞানের মতো বোঝার বিষয় নয়। কবি কহলিল জিব্রান এক পত্রে কবিতা প্রসঙ্গে লিখেছেন- ‘আমি জন্মেছি সেই বিশেষ শব্দটি উচ্চারণ করার জন্য, যে শব্দের প্রাণ আছে, ডানা আছে। যতদিন না জীবন আমাকে দিয়ে সেই উচ্চরণ করিয়ে নিচ্ছে, ততদিন অবধি আমি বেঁচে থাকতে চাই।’ উপরের কথাগুলো কবি মাহবুব আজীজ নিশ্চয় জানেন। ‘ঠিক সন্ধ্যার আগে’ এই কাব্যগ্রন্থটির উৎসর্গ পর্বে বিবেকজাগ্রত বয়ানÑ ‘যে তুমি একদিন/এই কাব্য হাতে তুলে নিলে; জানবেÑ/মানুষ জীবনের কাছে এর অনেক ঋণ।/ দুঃখিত পাথর সে; তথাপি সুখী। মানবে-/....../’ কবির ভাবনাশক্তির গুণকীর্তন করতে হয়। কবির ভাবনাবলয় বিস্তৃত। মানবিক মূল্যবোধের পরিচয় মেলে। বলে রাখা ভালো, কবি মাহবুব আজীজ-এর ‘ঠিক সন্ধ্যার আগে’ প্রথম কাব্যগ্রন্থ। কবিতাগুলো সময়ের বেজে ওঠা কাব্যব্যঞ্জনা। এই কবিতা পাঠকালে পাঠক’রা পাবেন; মানুষের বিবিধ আচারণের ইঙ্গিত। যেমন : ‘....../ সব সাঙ্গ হলে পর/ পাখি আবার এ-ডাল ও-ডাল ঘুরতে থাকে।/ ঘুরতেই থাকে;/ পাখির পাখি খোঁজা আর শেষ হয় না।’ (পাখিস্বভাব), পৃষ্ঠা-১৭, এই পঙ্ক্তিগুলো পড়ে মনে হচ্ছে, যে কবির দায় থাকে পাঠক-চৈতন্যের সঙ্গেÑআন্তরিক অন্বেয়ের; দ্ব্যর্থহীন ভাষায় যিনি বলতে পারেনÑকবিতা রচনা ব্যক্তিস্বরূপের আত্মপ্রকাশ নয়, আসলে তা ব্যক্তিস্বরূপের হৃদয়ারণ্য থেকে নিষ্ক্রমণ। আবার দর্শনের বিচারে কবিতাকে সম্পূর্ণভাবে মূল্যায়ন করা যায় না। তবে দর্শনের শাখা ইসথেটিক্স বা নন্দনতত্ত্বের আলোকে কবিতাকে বহিরাঙ্গিক ও অন্তরাঙ্গিক দুইভাবেই বিবেচনা যেমন করা যায়, ঠিক তেমন করে একজন কবি মানুষের জীবনের বাস্তবতা ও কল্পনাকে তুলে আনার প্রচেষ্টাÑ ব্যক্তিস্বরূপের হৃদয়ারণ্য থেকে নিষ্ক্রমণ ভালোবাসার মতো; যে ভালোবাসা বড্ড পবিত্র। কবি মাহবুব আজীজ তাই করে দেখালেনÑ ‘ঠিক সন্ধ্যার আগে’ কাব্যগ্রন্থটির কাব্যে। আবার,‘তোমাদের উঠোনে জিরোবার একটু জায়গা দেবে?/একটু থেমে আকাশের রং চেটে খাব; সঙ্গী হবে?’ (উঠান), পৃষ্ঠা-১৬, সময় ও সমাজের বাহিরে নন কবি। সময়ের জমিনে ঘটে যাওয়া সব বাস্তব ঘটনা, কবিকে আলোড়িত-চঞ্চল করবে, পৃথিবীর প্রেম-ভালোবাসায় কবি রোমাঞ্চিত হবেন এটাই স্বাভাবিক। কবি মাহবুব আজীজ প্রিয়জনের উপর বিশ্বাস নামক শব্দের ভিতর-বাহির প্রেমপ্রামাণ্য বিলিয়ে দিয়েছেন। কবিতাটি পাঠ্যকালে যে কেউ ভাবিত হবেন। আবার, ১ ‘....../ কিচ্ছু নষ্ট হবে না; হয় নাÑ/ ভয় নেই; / পুরনো ফুলের গল্প সবাই বোঝে না।/ফেলে দিও না।’ (ফেলে দিও না), পৃষ্ঠা-১৮ ২. ‘......./ হতাশা, অভিমান, গ্লানি, ক্রদ্ধ শত্রুতা...হাসি পায়!/ কুসুম লাল আর নীলাভ মেঘ মেশানো এই সন্ধ্যায়।’ (কুসুম লাল আর নীলাভ মেঘ), পৃষ্ঠা-১৯ ৩. ‘এই দীর্ঘশ্বাস, এই হয়ে আসা সন্ধ্যা-/ বিষণœ আলোর আভা, / ক্রমশ অদৃশ্য হতে থাকা মানুষের ছায়া। / আলপথ বেয়ে বয়ে যায় ধু-ধু।’ (সীমাবদ্ধতার সূত্র), পৃষ্ঠা-২২ অভিনব অনুভবশক্তিÑপ্রাখর্য ও শব্দের ব্যবহারবিবিধ বিস্ময়কর। সমকালীন কবিদের চিন্তাদর্শের চেয়ে মাহবুব আজীজ যে নিশ্চয় ভিন্ন তা স্পষ্ট হয়েছে রূপকনৈপুণ্য। অধিক কবিতায়Ñকবির মানসশক্তি, প্রতিবাদ, ধোকাবাজির বিরুদ্ধে পঙক্তি সাজিয়েছেন। যদিও কবির উপলব্ধি ঘনত্বের উপর নির্ভর করেÑ এক্সপ্রেশনিস্ট, ইম্প্রেশনিস্ট ও স্বভাববৈশিষ্ট্য। চমৎকার কবির ভাবনাদর্শন। এমনি বিভিন্ন বিষয়কে পুঁজি করে কবিতার মধ্যে মধ্যশ্রেণীর দারিদ্র্য, গ্লানি, স্বপ্নভঙ্গ-স্বপ্নবিলাস, মানসিক সংকীর্ণতা, মনস্তাত্ত্বিক সঙ্কট, মধ্যবিত্তের স্ববিরোধী ও দ্বিধান্বিত বিষয়গুলো সূক্ষ্মভাবে ফুটে ওঠেছে কবিতার জমিনে। আবার, ক.‘....../পকেটে হাত দিয়ে দেখিÑ/জীবনটা এমনই মজার।’ (এক নিমেষে), পৃষ্ঠা ২৪, খ. ‘..../ ছুটতে ছুটতে ছুটতে/ আগুনে না পুড়ে যায় মা?’ (ভয়), পৃষ্ঠা-২৫ গ.‘...../ আগুন! আগুন! বলে প্রিয় সব নদী কাঁপে ধরধর।/দাবার চালে শুভবাদী মেঘও আজ নির্লিপ্ত পাথর।’ (প্রতিপক্ষ), পৃষ্ঠা-৩১ বলা বাহুল্য, কখনও, জীবন, কখনও, সর্বোপরি দেশকালের বৃহত্তর প্রতিবেশ বা রাজনীতির অভিঘাত ফুটে ওঠেছে। কবি মাহবুব আজীজ নাড়ির টানের কারণে নদীমাতৃক বাংলার জল<প্রকৃতির সংস্পর্শ অনায়াসেই স্বীকার করেছেন কবিতার ভেতর দিয়ে। জাতিগতভাবে অস্তিত্ব সম্পর্কে যে অস্থিরতা+হতাশা তার ইঙ্গিত স্পষ্ট মনে হয়েছে। আবার, কোন কবিতায় কবি সময়কে ধরেছেন প্রখর অনুভব দিয়ে। কবিতা লেখার ব্যাপারে বরাবরই যতœবান। প্রতিটি কবিতার মধ্যে সময়ের প্রাসঙ্গিক সমস্যাগুলো উপস্থাপন করেছেন নিজ আঙ্গিকে। তার কবিতার গতি আছে। চমৎকার চিত্রকল্প আছে। আছে মূর্ত ও বিমূর্ত অনুষঙ্গ। একদিকে প্রকৃতির রূপে মুগ্ধতার আলেখ্য প্রকাশ, অন্যদিকে দরদের উচ্ছ্বাস। শব্দের সঙ্গে শব্দের হেঁটে চলা লাইনে লাইনে, স্পন্দন ওঠে এসেছে। ছোট্ট বিষয়কে কত আবেগ দিয়ে সাজিয়েছেনÑ চিত্রকল্পের শব্দবিন্যাস। কবির এমন নান্দনিক গঠনশৈলী সরলতার মধ্যে নিবিড় বোধানুভবের মনোচিত্রাবলী। কবিতাগুলোয় চিত্রকল্প, পুরাণ, ছন্দ, ভাষার প্রকরণসহ শব্দের গায়ে শব্দের কারুকাজ অনেকটা গ্রন্থের ওজন বৃদ্ধি করেছে। ’ঠিক সন্ধ্যার আগে’এই কাব্যগ্রন্থের, প্রচ্ছদ চমৎকার। বাঁধাই, মেকাপ-গেটাপ সত্যিই দৃষ্টিনন্দন। পাঠকরা গ্রন্থটি সংরক্ষণ করলে উপকৃত হবেন নিশ্চয়।
×