ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

খান সারওয়ার মুরশিদ ॥ যেমন দেখেছি

প্রকাশিত: ০৬:৫৮, ১১ ডিসেম্বর ২০১৫

খান সারওয়ার মুরশিদ ॥ যেমন দেখেছি

খান সারওয়ার মুরশিদের সঙ্গে আমার পরিচয় ছোটবেলা থেকেই। পরিচয় বলতে- ছোটবেলায় দেখতাম আমার বাবার কাছে আসতেন। নূরজাহান খালা, খালু এবং দুজনকে দেখে দেখেই বড় হওয়া। তারপর, বিশেষ করে আমার সঙ্গে ১৯৮২ সালে বাংলাদেশে ফিরে আসলেন। তখন তিনি কমনওয়েলথ এ্যাসিস্টেন্ট সেক্রেটারি জেনারেল। একটু অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। উনি ঢাকায় এসে আমাদের বাসাতে উঠেছিলেন। আমাদের সঙ্গেই ছিলেন। তারপর থেকেই উনার সঙ্গে এমন একটা প্রাণের যোগাযোগ, কি বলব, বিশেষ করে আমার মায়ের সঙ্গে। পরিবারের সবার সঙ্গে তো ছিলই। কিন্তু আমার সঙ্গে এমন একটা সম্পর্ক হয় যে, নাইনু আপা বলতে পারবে, কুমার ভাই আছে, রুমা আপাও দেখেছে যে মাঝে মাঝে আমরা তিন/চার ঘণ্টা আবার কখনও কখনও চার/পাঁচ ঘণ্টা কথা বলতাম। কখনও কখনও নির্দিষ্ট বিষয়ে কথা বলেছি। কখনও কোন বিষয় ছিল না। সপ্তাহে দু’চারদিন তো এমনই হতো। কত রকম কথা বলতাম! সবই ছিল আমাদের দেশ, না হলে কোন বই নিয়ে। উনি যে কি ধরনের পরিপূর্ণ মানুষ ছিলেন, যে কথা একটু আগে মন্ময় বলে গেল- উনি আন্তর্জাতিক একজন মানুষ ছিলেন, আমার কাছে ঠিক ওই রকমই মনে হতো। আর খালুর সঙ্গে আমার সম্পর্কটা- কি বলব, একটু অন্যরকম ছিল। ছেলেমেয়ের সঙ্গে ঝগড়া হলে সেটাও রিমি মেটাবে। নাইনু আপা বা কারও সঙ্গে রাগারাগি হলে খালু ফোন করে বলতেন বা নাইনু আপা ফোন করে বলতেন অথবা ফেরদৌস ভাই ফোন করে বলতেন। তারপর আবার এমন হতো যে নূরজাহান খালাম্মার সঙ্গেও হয়তো খুঁটিনাটি কিছু হয়েছে, সেই বিষয়টিও আমাকে জানাতেন। যেমনÑ একটি খুব মজার কথা বলি, উনাদের বাসায় কোন কাজের লোক নেই। দুপুরবেলায় রান্না করতে হবে। খালু আমাকে ফোন করে বললেন- রিমি আমার খাবার পাঠাও। খালাম্মা বলতেন- এই তুমি জানো না কি মেয়েটি কি করছে? ও ব্যস্ত কি ব্যস্ত না, তুমি বলে ফেললে খাবার পাঠাও। খালু আবার ফোন করেছেন- এই বল, আমি তোকে যেটা বললাম সেটা ঠিক করেছি কি না। তারপর একবার, এটা খুবই মজার ঘটনা, আমি অনেকদিন ধরে উনার একটা সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। তো ওটা প্রকাশিত হয়েছে একটা বইয়ে। আমরা এই নিয়ে যখন কথা বলেছিলাম তখন হঠাৎ নূরজাহান মুরশিদ খালাম্মা ঘরে ঢুকে বললেনÑ ওমা তুমি এখানে বাসায় বসে রিমির সঙ্গে কথা বলছো! আমি এতোক্ষণ বাংলা একাডেমির অনুষ্ঠানে ভেবেছিলাম তুমি ছিলে আমার পাশে বসে। তো খালু বললেনÑ নূরজাহান, তুমি কাকে তোমার স্বামী ভেবে পরপারে যুদ্ধে নেমে বসেছিলে। খালু কিন্তু এই রকম মজা করে কথা বলতেন। তো আমরা মাঝে মাঝেই খুব হাসতাম। খালু ফুল ভীষণ ভালোবাসতেন। আর জগতে বাতিকগ্রস্ত কিছু মানুষ থাকে। আমি বাতিকগ্রস্ত একেবারেই ফুল গাছের। তো আমার গাছে প্রচুর ফুল হতো এবং এখনও আমি ফুলের কুড়ি পছন্দ করি। নিজের হাতেও ফুল গাছ লাগাই। তো খালু করতেন কি শোন, আমাকে কিন্তু জিজ্ঞেস করবে না এটা পছন্দ হয়েছে, ওটা পছন্দ হয়েছে; আর তোর মালিকে ডাক, এটা বাসায় চলে যাবে। আমায় বাসায় থাকবে সাতদিন। আমি দেখব, তারপর ওটা ফেরত আসবে। এই রকম করতেন। আমার একটা জিনিস খুব ভালো লাগে যে, নূরজাহান খালাম্মার শেষ সময়টায় খালু সবসময় উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু খালু অসুস্থ হয়ে যাবেন, আমাদের মাঝে থাকবেন না এমন ভাবনা আমার কোন সময় ছিল না। উনি বেঁচে থাকবেন এমনই একটা চিরন্তন সত্য আমার মনে ছিল। বিশেষ করে আমার কাছে মনে হতো কি, আমি যে তাজউদ্দিন আহমেদ-এর উপরে কাজ করছি, উনার জন্মদিনের অনুষ্ঠানগুলো পালন করতাম, যা কিছু করেছি সবকিছুর মূলে কিন্তু প্রেরণার উৎস ছিলেন খালু। আমার সঙ্গে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সবকিছুতে অংশ নিতেন খালু। আমার খুব কষ্ট হয়, কয়দিন আগেও বলেছি, ১৯৮৭ সালের পর থেকে উনি কখনই কোন অনুষ্ঠানে অনুপস্থিত থাকতেন না। বিদেশে থাকলেও ওই সময়টাতে অর্থাৎ জুলাই মাসে চলে আসতেন এই ভেবে যে, না, আমাকে তাজউদ্দিন ভাইয়ের অনুষ্ঠানে থাকতেই হবে। উনি অসুস্থ হয়ে যাবার পরে প্রথমবারের মতো খালুকে ছাড়া আমরা অনুষ্ঠান করেছি। তাঁর মৃত্যুর পরে গত ২ বছর আমাদের অনুষ্ঠান করতে হচ্ছে তাঁকে ছাড়া। এটাও আমাদের জন্যে খুবই কষ্টের একটা জায়গা। খালুকে অনেকেই মনে করতেন খুব রাশভারি, খুবই গম্ভীর। উনি আমাকে বলতেন- শোন, তোর কি মনে হয় আমি খুব রাগী উঁচু লোক? -খালু আমার তো মনে হয় না। -কিন্তু তুই কি জানিস বাইরের লোক আমাকে তাই বলে জানে। আমি বললাম- কেন মনে করে? বলে- শোন, আমি যখন কোন লোককে দেখি তখন আমি তার ভেতরটা পড়ে ফেলতে চেষ্টা করি। তো তখন হয় কি ওরকম মেলামেশাটা ঠিক হয়ে ওঠে না। কথাগুলো খুব মজা করে বলতেন। আমি বলতাম, খালু আপনি এতো জানেন, এতো কথা বলেন, আমার তো সবসময় মনে হয় যে, একটা টেপরেকর্ডার রাখি সঙ্গে। কারণ এতো কথা তো মানুষের মনে থাকবে না। মাঝে মাঝে বলতাম -আপনি লিখেন না কেন? এখানে উনার দাম্ভিক উত্তর কেন বুঝিস না? একটা শব্দ পছন্দ করতেই আমার দু’বছর লেগে যাবে। পরে তিনি খুব চেষ্টা করেছিলেন কিছু লেখার। আমি জানি না রুমা আপা বলতে পারবেন কিছু লিখে গেছেন কি না। আমার জানা মতে কিছু কাগজপত্র ছিল। তারপর মাঝে মাঝে হতো কি, স্ট্রোকটা করার আগে আমাকে প্রায় হঠাৎ করে ফোন করে বলতেন-এক্ষুণি আয়। তো আমি এমনভাবে অভ্যস্ত ছিলাম খালু বলা মাত্রই চলে যেতাম। আমি কিন্তু কখনই কারও সঙ্গে এমন সম্পর্ক গড়ে তুলি নাই। নূরজাহান খালা এবং খালু দুজনের সঙ্গেই এমন হতো যে, একজনের সঙ্গে কথা বলেছি ৩ ঘণ্টা, একটু পরে খালাম্মা এসে বলতেন এই তুমি এখন আমার সঙ্গে আস। এভাবে আমাদের দিন চলতো। একবার আমাকে খালু বলেছিলেন- জানিস খুব ইচ্ছা একটা মস্তবড় লাইব্রেরি করার। একটা ফ্লোরে থাকবে শুধু আমার বই। তো শেষদিকে খুব চিন্তা করতেন। খালু খুব উদার মানুষ ছিলেন। সত্যি কথা বলতেন। যেটা অন্যায় মনে করতেন সেটাকে তিনি অন্যায়ই বলতেন। এক্ষেত্রে একটু মেপে, একটু রেখে-ঢেকে বলব, সেই পক্ষপাতিত্বে তিনি একদম ছিলেন না। সৎসাহস ছিল প্রচ-। কিন্তু সাহসটা উনার মতোই মার্জিত। অত্যন্ত রুচিশীল একজন মানুষ আর সুন্দর থাকতে পছন্দ করতেন। এই যে ফুল ভালোবাসতেন এটা সৌন্দর্যের বড় প্রকাশ। ফুলকে যেমন ভালোবাসতেন ঠিক তেমনি খুব সচেতন ছিলেন কাপড়চোপড় নিয়ে। আমাকে তো জিজ্ঞেস করতেন- এই পাঞ্জাবিটা এই অনুষ্ঠানে মানাচ্ছে কি না? বা ভালো লাগে কি না? এই রকমই ছিলেন তিনি। আমি বলব আমাদের সমাজে এই রকম মানুষ খুবই দুর্লভ। যেটা সবসময় আমরা সঙ্গে না থাকলে বুঝতে পারি না। এখন যে আমরা এই ধরনের মানুষদের হারাচ্ছি এটাই হয়তো প্রকৃতির নিয়ম। কিন্তু চলে যাওয়ার ফলে আমাদের সমাজে এই ধরনের যোগ্যতাসম্পন্ন মানুষদের খুব অভাব হয়ে যাচ্ছে। তো আমার মনে হয় যে, উনার নাতি নাতনিরা, খালুর সব আত্মীয় স্বজন, আমরা যারা সঙ্গে ছিলাম একটু সময়ের জন্য তাঁকে এভাবে স্মরণ করলে তাঁর কাজগুলোকে আরও বেশি তুলে ধরা যায়। আমি কিন্তু বারই বারই বলব যে, উনার কিছু লেখা ছিল, আমি নিজে দেখেছি। ওগুলো যদি বই আকারে প্রকাশ করা যায় তাহলে আমার মনে হয় ভালো হবে। আমি সত্যি খালুকে মিস্ করি, সব সময় মিস্ করি। আমি এর চাইতে আর কি বলব। খালুকে পাওয়াটা খুব আনন্দের, আর না পাওয়াটা প্রচ- কষ্টের।
×