ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

রোকেয়া আক্তার

কুটিরশিল্পে নারী

প্রকাশিত: ০৬:৪৫, ১১ ডিসেম্বর ২০১৫

কুটিরশিল্পে নারী

বাঙালির রয়েছে হাজার বছরের ইতিহাস। ধারাবাহিকভাবে প্রবহমান এই ইতিহাস বাংলার মানুষকে নানাভাবে করেছে সমৃদ্ধ। ঋদ্ধ। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি-চিত্রকলা-নাটক-গান-যাত্রাসহ নানা মাধ্যমে বাঙালি জীবনের বর্ণিল উপাখ্যান বাক্সময় হয়ে ফুটে উঠেছে। প্রতিকূল পরিবেশ বাঙালি জীবনের সংগ্রাম রঙিন হয়ে মূর্ত হয়েছে এই শিল্পকলায়। শিল্পকলার নানা মাধ্যম বাঙালির হাজার বছরের সংগ্রাম, ঐতিহ্য ও গৌরব বর্ণিল হয়ে উঠেছে। কুটিরশিল্প। বাঙালি নারীদের স্বপ্ন বাস্তবতার এক অনন্য দলিল। কুটিরশিল্পের ভেতর বাঙালি নারীর দীর্ঘায়িত স্বপ্ন, হাসি-কান্না, দুঃখকষ্ট, আনন্দ-বেদনা প্রকাশ পেয়েছে। কুটিরশিল্পের নানা নকশার মধ্য দিয়ে বাঙালি জীবনের না বলা উপাখ্যানেরও চমৎকারভাবে প্রকাশ পেয়েছে। কুটিরশিল্প বাঙালি নারীদের সৃজনশীলতাকে নানাভাবে সমৃদ্ধ করেছে। একটা সময় সমাজ বাস্তবতার কারণে এ অঞ্চলের নারীদের নানা ধরনের প্রতিকূল অবস্থার মধ্যদিয়ে দিনাতিপাত করতে হয়েছে। রক্ষণশীল সামজের নানা কুসংস্কার, নিয়মকানুন ও প্রতিবন্ধকতায় তাদের জীবন ছিল কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত। নারীকে বলা হতো ‘অন্তঃপুরবাসিনী’। সমাজে নারীর জন্য এক অলিখিত জীবনবিধি প্রচলিত ছিল। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর জীবন যাপন ছিল অরক্ষিত। নারীকে তুলনা করা হতো পণ্যের সঙ্গে। নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া নারীর পক্ষে দাঁড়ালেন। নারীর অধিকার নিয়ে তিনিই প্রথম সাহসের সঙ্গে কথা বললেনÑ পুরুষের পাশাপাশি নারীর জয়গান গাইলেন। সেই থেকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে হাঁটা শুরু হলো নারীর। বিভিন্ন প্রতিকূলতার মধ্য থেকেও বাঙালি নারী তার সৃজনশীলতার সর্বোচ্চ পরিচয় দিয়েছে সর্বক্ষেত্রে। মেধা-মনন ও প্রতিভার সমন্বয়ও ঘটেছে তাতে। বাঙালি নারী তার অবগুণ্ঠন ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এসেছে। নারীর অবগুণ্ঠন থেকে এই বেরিয়ে আসার ক্ষেত্রে কুটিরশিল্পের রয়েছে বলিষ্ঠ ভূমিকা। শুধু তাই নয়, কুটিরশিল্প নারীর এগিয়ে যাওয়া ও স্বাবলম্বী হওয়ার ক্ষেত্রে জোরদার অবদান রেখেছে। স্বচ্ছলতা, আর্থিক নিরাপত্তা ও সমাজে নারীর মান-মর্যাদাওও এনে দিয়েছে কুটিরশিল্প। নারীর প্রতি শত বছরের শিল্পেরহাত ধরে বাংলার অবহেলিত নারী নতুন জীবনের সন্ধান পেয়েছে। পেয়েছে বেঁচে থাকার অবলম্বন। ঐতিহ্য আর গৌরবের পথ ধরে বাংলাদেশের কুটরশিল্প বিশ্বসভায় স্থান করে নিয়েছে। একইসঙ্গে কুটিরশিল্প তার নিজস্ব ধারণা অগ্রসর হয়ে বাঙালির সংস্কৃতি বিশ্বে তুলে ধরছে। শিল্পস্বত্তা আর জীবনের পথ চলার কুটিরশিল্প এক অনবদ্য ভূমিকা রেখে চলেছে। কুটিরশিল্পের সঙ্গে নারী অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে। কুটিরশিল্পে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে বাংলার নারীরা। অর্থনীতির এক সমীক্ষায় জানা যায়, দেশে কর্মজীবী মানুষের প্রায় ২০ শতাংশ মানুষ কুটিরশিল্পের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এর মধ্যে সিংহভাগই নারী। কুটিরশিল্পের ওপর নির্ভর করে লাখ লাখ নারী তাদের জীবননির্বাহ করছে। এসব লাখ লাখ নারীর ওপর নির্ভর করছে আরও অসংখ্য জীবন। জানা যায়, ২০১৫ সালে বিসিকের সহায়তায় সারাদেশের ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পগুলোতে মোট ১ হাজার ৬৭৩ কোটি ৮৮ লাখ টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে। এই বিনিয়োগের ফলে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে কর্মসংস্থান ঘটেছে প্রায় ২৩ হাজার মানুষের। কুটিরশিল্পে নারীদের আরও সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে সরকার ইতিমধ্যেই নিদের্শনা দিয়েছেন। একই সঙ্গে নারী উদ্যোক্তাদের কুটিরশিল্পে বিনিয়োগ করতে সবধরনের সহযোগিতা প্রদান করতে অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে সরকারের শীর্ষমহল। স্বল্প সুদ ও সহজশর্তে ঋণ প্রদানে নারী উদ্যোক্তাদের কুটিরশিল্পে সম্পৃক্ত করতে নানা ধরনের বাস্তব পদক্ষেপ নেয়ার জন্য সংশ্লিষ্টবিভাগগুলোর প্রতি কঠোর প্রজ্ঞাপনও জারি করেছে সরকার। দেশের অর্থনীতিতে কুটিরশিল্পের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে (এসএমই) ব্যাপক কর্মসংস্থানের পাশাপাশি ব্যবসা-বাণিজ্যে গতিশীলতা, কুটিরশিল্পের ধারাবাহিক অগ্রগতিকে নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের দীর্ঘদিনের দাবিকে রূপায়নে সর্বাত্মক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে বর্তমান সরকার। নারী উদ্যোক্তাদের মাধ্যমে কুটিরশিল্পে রফতানি বৃদ্ধির সম্ভাবনাকেও উসকে দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশে কুটিরশিল্পে নারীদের ব্যাপক অংশগ্রহণ দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। কুটিরশিল্পের মধ্যে রয়েছে তাঁতশিল্প, হস্তশিল্প, মৃৎশিল্প, বাঁশ ও বেতশিল্প, ঝিনুক শিল্প, পাট শিল্প, খাদ্য ও খাদ্যজাত দ্রব্যাদি, বস্ত্রশিল্প, সিরামিক শিল্প, রাবার শিল্প, চামড়া শিল্প ইত্যাদি। অতীতকালে এসব শিল্পের ঐতিহ্য ও গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। এসব শিল্পে দেশের লাখ লাখ ভাগ্য বিড়ম্বিত নারী ওতপ্রোতভাবে জড়িত। গৃহবধূ, বিধবা, প্রতিমন্ত্রী নারী এমনকি ছাত্রীরা পড়াশোনার ফাঁকে এই শিল্পের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। এসব শিল্পে লাখ লাখ নারীর কর্মসংস্থান ও জীবিকানির্বাহ হয়। দিনবদলের পালায় নারী সমাজ এগিয়ে যাচ্ছে নানা প্রতিকুলতা সত্ত্বেও বর্তমানে রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ ক্ষমতায়নের পথে যেমন নারীকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তেমনি অর্থনীতিতেও নারীর অবদান উল্লেখ। কর্পোরেট অফিসগুলো ছাড়াও বিভিন্ন সরকারী ও এনজিও অফিসে নারীদের উপস্থিতি নারীর ক্ষমতায়নের ইতিবাচক চিত্রকে ফুটিয়ে তোলে। পাশাপাশি কর্মক্ষেত্রে নারীর অবদান নারীর অর্থনৈতিক অবদানকে তুলে ধরে। শিক্ষিত নারীরাই নয়, গ্রামীণ অশিক্ষিত দরিদ্র নারীরাও নিজেদের স্বাবলম্বী করে তুলতে সচেষ্ট আজ। গার্মেন্ট শিল্প বহু অশিক্ষিত ও স্বল্পশিক্ষিত নারীর কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করেছে। কিন্তু এছাড়াও নারীর কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে এদেশের ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পগুলো। প্রান্তিক পর্যায়ের অনেক নারীরা আজ এ শিল্পে কর্মসংস্থান করে নিজেদের ভাগ্য বদল করছে। শীতল পাটিসহ অনেক হস্ত ও কুটির শিল্পজাত পণ্য দেশের সীমা ছাড়িয়ে বিদেশেও রফতানি হচ্ছে। যার ফলে কুটির শিল্পনির্ভর পরিবারগুলোই আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছে না। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে দেশও। সমৃদ্ধ হচ্ছে দেশের অর্থনীতি। কর্মসংস্থান হচ্ছে গ্রামীণ দরিদ্র নারীর। কমছে বেকারত্বের হার। হস্ত ও কুটির শিল্প প্রসারের সম্প্রতি বেশকিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে শুধু সরকারি পর্যায়ে নয়, বেসরকারী পর্যায়ে নানা পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পনির্ভর পরিবারগুলো থেকে তৈরি হচ্ছে উদ্যোক্তা। আর তাদের সহায়তায় এগিয়ে আসছে ব্যাংক, বীমাসহ এনজিওরা। সরকার এসব পদক্ষেপে সাধুবাদ জানিয়েছে। সম্প্রতি ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয় কমনওয়েলথ নারীবিষয়ক মন্ত্রী সম্মেলন। এ সম্মেলনের প্রতিপাদ্য ছিল ‘নারী উদ্যেক্তাদের জন্য নেতৃত্ব।’ নারী উদ্যোক্তাদের অগ্রাধিকার দেয়ার লক্ষ্যে এ সম্মেলনে ২০ দফা ঢাকা ঘোষণা করা হয়। এ সকল দফায় মূলত অংশগ্রহণকারী দেশের উন্নয়নে নারীর অংশগ্রহণ ও অর্থনৈতিক অবদানের বিষয়ে জোর দেয়া হয়। দেশের উন্নয়নের লক্ষ্যে নারীকে নেতৃত্বের চালিকাশক্তি হিসেবে বিবেচিত করে উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাওয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়। নারীর রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক উন্নয়নও জরুরি। আর সেক্ষেত্রে দেশের প্রত্যেকটি নারীর অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ জরুরি। ধঃযধরৎরফযধ১৫@ুধযড়ড়.পড়স
×