ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

দাউদ হায়দার

আমি কিন্তু যামুগা

প্রকাশিত: ০৪:০৬, ১১ ডিসেম্বর ২০১৫

আমি কিন্তু যামুগা

পাবনার ছাওয়াল হয়েও কখনো দেখিনি তাঁকে, ওমর আলিকে। লজ্জা বৈ কী। সাফাই-গীত ধোপে টিকবে না ঠিকই, গাইছি একটু ভিন্ন তাল-লয়ে। বেসুরো হয়তো। পাবনা ছেড়েছি বারো বছর বয়সে। পাবনার ভূগোল অচেনা তখনো, পরেও। বছরে একবার-দুবার গিয়েছি বটে, কোনো উপলক্ষে, থাকা হয়নি মাসাধিক। ততদিনে ঢাকার প্রতি টান বেড়েছে, পাবনায় সমসাময়িক কোনো বন্ধু ছিল না, থাকার কথাও নয়। বাড়িতেই গ-া দুয়েক ভাইবোন, শরিকি পরিবার। একই চৌহদ্দিতে বাস, চাচাত ভাইবোনের বয়স দুই-এক বছরের ছোটবড়ো। উপরন্তু, পাড়ার ছাওয়ালপল তো আছেই। রীতিমত একটি ফুটবল টিম। অগ্রজ-অনুজকুল পাবনার শহর, রাস্তাঘাট, আমোদ-হুল্লোড়পনার (কালচারাল সেন্টার ) যত সেক্টর চেনেন, কবুলিত করছি, কোনোটাই সঠিক চিনি না। বনমালি ইনস্টিটিউট বলে খ্যাত, গানবাজনা, নাটক, সাহিত্যপাঠ তথা সাংস্কৃতিক আখড়া, ভাইবোন-আত্মীয়ের সঙ্গে কখনো গিয়ে থাকবো হয়তো, স্মৃতি বড়োই দুর্বল, মনে পড়ছে না। ইতিহাসমাখা গোবিন্দ পাবলিক লাইব্রেরি সেঞ্চুরি পার করেছে, ঢুকিনি একবারও। বাড়িতেই নানা বই। সোমত্ত বোনেরা পড়েন আর প্রেমে কাতর হন। দেবদাস হাতে নিয়ে পৃষ্ঠা গুনছি একদিন, দুই বছরের বড়ো হেনাবু ধমক দিয়ে বললেন, ‘খুব পাকিছ্যাও, অ্যা। আব্বাক কয়ে দেবো নে।’ মামাত ভাই গোলাম মোস্তফা ওরফে মোগল, এক সন্ধ্যায়, সম্ভবত আবু হেনা মোস্তফা কামালকে বলছিলেন, ‘আপনার মতো বহু কবি পাবনার অলিগলিতে ঘুরে বেড়ায়।’ কিছুক্ষণ আগেই কি বিষয় নিয়ে যেন দুজনের কথা কাটাকাটি। আবু হেনাকে আমরা হেনামামা বলতুম। পাবনার অলিগলি-রাস্তাঘাটে কবিকুল? কই, দেখলুম না। ওমর আলিকেও না। অবশ্য, ওমর আলির অজানা তখনো। জানলুম ঢাকায় এসে, এক বছর পরে, তাও ঘটনাক্রমে। পাক-ভারত যুদ্ধ (৬-১৭ সেপ্টেম্বর ১৯৬৫ ) চলছে। স্কুল ছুটি। সন্ধ্যার পরে ব্ল্যাকআউট। হারিকেনের আলোয় লেখাপড়া। শেলফে ইংরেজি-বাংলা ডিকশনারি আনতে গিয়ে দেখি একটি চটি বই, ‘এদেশে শ্যামল রং রমণীর সুনাম শুনেছি।’ রমণী যখন, নিশ্চয় গোপন, নিষিদ্ধ বইটই হবে। আশপাশে কেউ ছিল না, হাতে নিয়ে দেখি কবিতার। কিচ্ছু বুঝিটুঝিনা কবিতা। ইচ্ছেও নয় পড়ার। যুদ্ধ-শেষের মাস দেড়েক পরেই পরীক্ষা। পরীক্ষা-শেষে বিস্তর সময়। বাড়িতে কবিতার একটু-আধটু গন্ধ, হাওয়াও বলা যেতে পারে। এমনও হতে পারে, হাওয়া থেকেই আগ্রহ, ‘এদেশে শ্যামল রং রমণীর সুনাম শুনেছি’ বেছে নিই। ১৯৬০ সালে প্রকাশিত। আটপৌরে ছাপা, টাইপ সেটিং-এ। সস্তা কাগজ। বাঁধাই অমজবুত। মফস্বলী প্রকাশনা। জিয়া হায়দারকে উপহার দিয়েছেন ওমর আলি। এই কবির নাম অশ্রুত। ঘটকা জাগে মনে। কোনো বাংলা কবিতার বইয়ের নাম এতো বড়ো, কখনো দেখিনি আগে। বোধহয়, সেই সময়ের পূর্ব পাকিস্তানে, পরে বাংলাদেশেও, সেই প্রথম। কবিতা বুঝি না, কাব্যগ্রন্থের নাম পড়েই উত্তেজিত, দোলায়িত। অগ্রজদ্বয়ের মুখেই শুনলুম ওমর আলির বাড়ি পাবনা। না, পাবনার ছাওয়াল হয়েও কখনো দেখিনি তাঁকে, না-দেখার ব্যথা ও বেদনায় কাবু। দেখিনি, তবে ওমর আলি সঙ্গে আছেন। বাংলা কবিতার স্বর, ভঙ্গিমা, মেজাজ, স্মার্টনেস বদলে দিয়েছেন, এমনকি ননসেন্স-বাতুলতাও। কবিতায় শাহরিক নাগরিকতার ছ্যাবলামো নেই, গ্রামীণ মুখশ্রীও নেই। গ্রাম-শহরের ঘরগেরস্থালির যে জটিল ঘরানা, যন্ত্রণা, বিষাদ, সঙ্গ-অনুষঙ্গ, সুখ-প্রেম, আশা-হতাশা, উত্তেজনা, বিধুর সময়কাল নানাভাবে গ্রন্থিত। দেশের রাজনীতি, ঝড়ঝাপটা নেই ঠিকই, কিন্তু দৈনন্দিন ছবি, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার সোপানে আলোকিত। আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে, এমন নির্মোহ যে, ষাট দশকের দেশীয় বিরুদ্ধে, বিরুদ্ধ স্রোতে বাহিত না হয়ে কী করে অবিভাজিত। এই প্রশ্নের সঙ্গে আরো যে তাঁর সমকালীন কবিদের থেকে এতটা আলাদা, ছিন্ন হলেন কিভাবে। উত্তর হতে পারে, মূলত তিনি নিভৃতচারী। এই উত্তরেও সায় নেই হয়তো, বলবেন কেউ, সরবও ছিলেন প্রয়োজনে। এই প্রয়োজন সামগ্রিক বিচারে বেমানান। তাঁর আরদ্ধ পরিসর ও পরিবেশ নিজস্ব, আত্মিক-এককতা। জীবনানন্দের বৈদেহী কবিতায় সমাচ্ছন্ন একদা, আত্মিকতায় উদ্বেলিত, কিন্তু অনুরাগ-অনুকম্পায়ী। এই সর্বনেশে কুহকিনীর নিবিড়ঘন জ্যোতির্ময়ে বাঁধা পড়েছিলেন, সন্দেহ নেই, প্রথম কাব্যগ্রন্থ সাক্ষী। বাংলাদেশকে, বাংলাদেশের নারীকে একটি মাত্র পঙ্ক্তিতে এমন সহজ, স্বছন্দে চিত্রময় করা বাংলাদেশের অন্য কবির কবিতায় সঘন নয়। ভুলছি না জসীমউদ্্দীন, আল মাহমুদের মদিরবিত্ত লোকায়ত অনুশীলন। এদেশে শ্যামল রং রমণীর সুনাম শুনেছি, আইভি লতার মতো সে নাকি সরল, হাসিমাখা। সে নাকি স্নানের পরে ভিজে চুল শুকায় রোদ্দুরে, রূপ তার এদেশের মাটি দিয়ে যেন পটে আঁকা। সে শুধু অবাক হয়ে চেয়ে থাকে হরিণীর মতো মায়াবী উচ্ছল দুটি চোখে, তার সমস্ত শরীরে এদেশেরই কোনো এক নদীর জোয়ার বাঁধভাঙা; হালকা লতার মতো শাড়ি তার দেহ থাকে ঘিরে। (এদেশে শ্যামল রং রমণীর শুনাম শুনেছি। অংশ) গোটা কবিতা দুই ও তিন মাত্রায় রচিত, একটু মনোযোগী হলে দেখবেন, লিরিক ছিন্ন, গদ্যকথায়, ‘পছন্দ করেছে’ কিংবা ‘চতুষ্পার্শে আছে।’ এই ছিন্নকথনই কবিতার আন্বীক্ষিক শিল্পশৈলী তৈরি করেছে। ওমর আলির কাব্যভাষায় ঝিকিমিকি সাযুজ্য, অলংকার, অনুপ্রাস নেই, নিতান্তই সমাহিত কল্লোল। কি করে সম্ভব উচ্ছ্বাসজাত বাংলায়, আজকের বাংলাভাষায়, ভেবে মুখ ব্যাদান করতে পারেন, কিন্তু মনে রাখলে বোধকরি জানবেন, ভাষার প্রাকরণিক প্রাখর্যের চেয়ে প্রবাহমান কথ্যমালা অনেক বেশি ঘরোয়া। উদাহরণ বিস্তর। নিছকই গল্প, গোটা কবিতাই গদ্যে লেখা। মুন্সিয়ানা অন্তমিলে, ছন্দগুণে। কবিতার প্রাণ এখানেই। ঘটনাক্রম প্রেম। একদিন একটি লোক এসে বললো, ‘পারো’? বললাম, ‘কি’? একটি নারীর ছবি এঁকে দিতে, সে বললো আরো, “সে আকৃতি অদ্ভুত সুন্দরী, দৃপ্ত, নিষ্ঠুর ভঙ্গিতে... পেতে চাই নিখুঁত ছবিতে।” ‘কেন’? আমি বললাম শুনে। সে বললো, “আমি সেটা পোড়াবো আগুনে”। (একদিন একটি লোক ) ‘কুড়ানি’ কবিতায় মনীশ ঘটক, ‘খাট্টাশ, বান্দর তোরে করুম না বিয়া,’ বাঙালভাষা ঢুকিয়ে যে কাব্যকলার যে ভূমি তৈরি করেন, আত্মহত্যাবিলাসী বঙ্গবাসী, বঙ্গীয় পাঠককুল হজম করেননি। বদহজমে, ভেজালে এতটাই পোক্ত সহ্য হয়নি। বিদেশী উপমা, সংস্কৃত-ঘেঁষা বাংলা না হলে ভেদবমি হয়। লম্পট, দুশ্চরিত্র, অসাধু, ভ-, বাখোয়াজবাজ পাঠকের সামনে-পাছায়-গাগতরে কষে লাত্থি মারলেন। বাংলাদেশের বাংলাভাষায়, তথা কথ্যভাষায় ওমর আলি প্রথম লিখলেন সুপাঠ্য কবিতা। প্রেমের কবিতা। কোনো প্রতীক, উপমা, উতপ্রেক্ষা, আবরণ, আভরণের ধার ধারেননি। পুরোধাকে বিনতি। আমি কিন্তু যামুগা। আমাকে যদি বেশি ঠাট্টা করো। হুঁ, আমারে চেতাইলে তোমার লগে আমি থাকুম না। আমারে যতই কও তোতা পাখি, চান, মণি, সোনা। আমারে খারাপ কথা কও ক্যান, চুল টেনে ধরো। আমারে ভ্যাংচাও ক্যান, আমি বুঝি কথা জানিনাকো। আমার একটি কথা লয়ে তুমি অনেক বানাও। তুমি বড়ো দুষ্টু, তুমি আমারে চেতায়ে সুখ পাও, অভিমানে কাঁদি, তুমি তখন আনন্দে হাসতে থাকো। শোবো না তোমার সঙ্গে, আমি শোবো অন্যখানে যেয়ে আর এ রাইতে তুমি শুয়ে রবে একা বিছানায়, দেখুম ক্যামনে তুমি সুখী হও আমারে না পেয়ে, না, আমি, এখনি যাইতেছি চলে অন্য কামরায়। (আমি কিন্তু যামুগা ) দুই. পাবনার ছাওয়াল হয়েও ওমর আলিকে দেখিনি। আফসোস। বাংলাদেশের বহু লেখককেই দেখিনি। দুঃখ নেই আদৌ। বরং সুখী। বিস্তর বাজে লেখক দেখে চোখ ঘোলা করার মানে হয় না। ওমর আলি কতটা গৃহবাসী, ঢাকার কাকপক্ষী লেখকদঙ্গলে গা ভাসাননি, হুল্লোড়ে থাকেননি, ফলত একলা, তাঁকে নিয়ে বঙ্গদেশে চেতনাবিনাশকারী লেখক-সম্পাদক-গোষ্ঠী-পত্রিকা-দলবাজি-চুলকানিদাতা-নপুংসকরা মাতামাতি করেনি। না করায় আকুতি হয়তো ছিল না, বিকলাঙ্গ দেশ সমাজে অভিমান ছিল, ‘আমি কিন্তু যামুগা।’ যাওয়ার পরে উপলব্ধি, সমতলের ভূমি কতটা চোরাবালি। তিন. ওমর আলিকে দেখিনি, পাবনার ছাওয়াল হয়ে বড়াই করা বাতুলতা। অগ্রজ রোকন, পোশাকি নাম মাকিদ হায়দার, শুনলুম ফোনে, রাজশাহী, ঢাকায় গিয়েছেন ওমর আলি, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন, কিংবা কোনো বিশেষ কার্যকারণে, ওইটুকুই বাংলাদেশ পরিভ্রমণ। পাবনার বাইরে আর একবার ময়মনসিংহে, সাহিত্যানুষ্ঠানে। জেলা প্রশাসক থেকে শুরু করে অনেক আজেবাজে, গণ্যমান্য। রঙ-চটা স্যুট নিয়ে গিয়েছেন, কোন আমলের একটি টাই-ও। গণ্যমান্য-অভদ্র দেখে হাউস (শখ) জাগে টাই পরার। মাকিদকে বলেন, রোকন, কি করে টাই পরতে হয়, গলায় ফাঁস দিয়ে পরিয়ে দাও। মাকিদ বলছিলেন আরো, প্রসঙ্গক্রমে, কবি আসাদ মান্নান রাজশাহী বিভাগে কর্তা থাকাকালীন ওঁর তহবিল থেকে (সরকারী তহবিল) আর্থিক সাহায্য করেন, আসাদ মান্নান নিজে গিয়ে, ওমর আলির সঙ্গে হাজির হয়ে। ওমর আলি আপ্লুত। কবি ছাড়া কবিকে কে দেখিবে? আসাদ মান্নানকে সাধুবাদ। সাহায্যের টাকায় ওমর আলি কুঁড়েঘর প্রাসাদ বানাননি, মজবুত করেছেন আটচালা। ওমর আলিকে দেখিনি, বাংলা কবিতাও বুঝি না, অবোধ্য। এইটুকু জানি, রুচিবোধের কারুকার্য-পিপাসায় ওমর আলি পাবনার, গোটা বাংলার, বাংলা ভাষার, ধমনী থেকে পুষ্পিত। ৮ ডিসেম্বর ২০১৫। বার্লিন, জার্মানি ফধঁফ.যধরফবৎ২১@মসধরষ.পড়স
×