ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

নানা আয়োজনে গণহত্যা স্মরণ

প্রদীপের আলোয় একাত্তর ত্রিশ লাখ মানুষ হত্যার বিচার দাবি

প্রকাশিত: ০৫:৩৮, ১০ ডিসেম্বর ২০১৫

প্রদীপের আলোয় একাত্তর ত্রিশ লাখ মানুষ হত্যার বিচার দাবি

মোরসালিন মিজান ॥ বিজয়ের মাস ডিসেম্বর। এ মাসেই বাঙালী অর্জন করেছিল শ্রেষ্ঠ ধন স্বাধীনতা। এমন আনন্দের ক্ষণে কান্নার কোন স্থান নেই। বেদনা ভুলে থাকবার কথা। কিন্তু বুধবার সেটি হয়নি। বরং একাত্তরে পাক বাহিনীর নিষ্ঠুরতার ইতিহাস বর্ণিত হয়েছে। স্মরণ করা হয়েছে নির্মম গণহত্যার শিকার হওয়া স্বজনদের। দুঃসহ স্মৃতি তুলে ধরার পাশাপাশি আজকের পৃথিবীতে চলমান গণহত্যা বন্ধের দাবি তোলা হয়েছে। জাতিসংঘ ঘোষিত আন্তর্জাতিক গণহত্যা স্মরণ ও প্রতিরোধ দিবসে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর এ দাবি উপস্থাপন করে। বিশ্বমানবের সঙ্গে একাত্ম হয়ে দিবসটি পালন করা হয়। ছিল কথা কবিতা পাঠ ও নাট্য আয়োজন। মানবিক মানুষের বহুদিনের দাবির প্রেক্ষিতে ৯ ডিসেম্বরকে আন্তর্জাতিক গণহত্যা স্মরণ ও প্রতিরোধ দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। গত ১১ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এর প্রেক্ষিতে বুধবারের কর্মসূচী পালন করে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। আয়োজনের শুরু হয় প্রদীপ প্রজ্বালনের মধ্য দিয়ে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে ভয়ঙ্কর গণহত্যা চালায় পাকিস্তান বাহিনী। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস সময় ধরে চলে মানুষ হত্যার মিশন। উদ্দেশ্য ছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতাকামী শক্তিকে ধ্বংস করা। এ উদ্দেশ্যে পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী পরিকল্পিত হত্যাকা- ঘটায়। প্রাণ কেড়ে নেয় ত্রিশ লক্ষ বাঙালীর। প্রদীপ প্রজ্বালনের মাধ্যমে সেই শহীদদের স্মরণ করা হয়। জানানো হয় গভীর শ্রদ্ধা। বিভিন্ন বয়সী মানুষ মোমবাতি প্রজ্বালনে অংশ নেন। আগুনের পরশমনি মুহূর্তেই দূর করে ঘুটঘুটে অন্ধকার। ছোট আঙিনার প্রতীকী এই আলো মানুষের পৃথিবীর জয়গান করে। মোম যখন জ্বলছিল, আলোর গান গাইছিল তখন একই দাবিতে সরব হয় জাদুঘরের উন্মুক্ত মঞ্চ। সেখানে মাইকের সামনে দাঁড়িয়েছেন মাহমুদা আখতার। দিবস উপলক্ষে জাতিসংঘ প্রদত্ত বাণী পাঠ করে শোনান তিনি। তামান্না সারোয়ার নীপার কণ্ঠে ছিল একাত্তরে শহীদ কবি মেহেরুন্নেসার কবিতা। ‘রাজপথে আজ রক্তের প্রস্তুতি’ থেকে আবৃত্তি করেন তিনি। যেখানে কবি বলছেনÑ শহীদ ভাইয়েরা! স্বপ্ন ভেবো না, খাঁটি সত্যের গাঁথা/ বেয়নেট আর বুলেট টিয়ারগ্যাসে-/ভাঙে হাঁড় ফোঁড়ে বুকের পাঁজর, তরুণের তাজা মাথা...। এর পর দিবসটি নিয়ে কথা। প্রথমবারের মতো পালিত হচ্ছে। কিছুটা তাই ভূমিকা টাননেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক। বলেন, বিগত দিনে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গণহত্যা সংগঠিত হয়েছে। বিশেষ করে ষাটের দশকে সত্তরের দশকে অত্যন্ত নিষ্ঠুর গণহত্যা সংগঠিত হয়। এ সময় বাংলাদেশে ৩০ লক্ষ মানুষ প্রাণ দেয়। প্রায় এক কোটি মানুষ ভারতে আশ্রয় নেয়। আজকের পৃথিবীতেও গণহত্যা থেমে নেই। থামানো যাচ্ছে না। তাই গণহত্যা বন্ধের দাবি জানাতে জাতিসংঘের কাছে একটি বিশেষ দিবস চাওয়া হচ্ছিল। জাতিসংঘও গণহত্যা মোকাবেলা কীভাবে করা যায়, সে চিন্তা করছিল। এরপর সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত পাশ। এখন থেকে প্রতি বছর ৯ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক গণহত্যা স্মরণ ও প্রতিরোধ দিবস হিসেবে পালিত হবে। বাংলাদেশের জন্য দিবসটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, আগামীতে দিনটি ঘিরে বাংলাদেশ আরও সোচ্চার হবে। উদ্যোগী হবে। বাঙালী কী করে গণহত্যার স্মৃতি জাগ্রত রেখেছে, গণহত্যা থেকে শিক্ষা গ্রহণের চেষ্টা করছে, বিশ্বসভায় তা তুলে ধরবে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রসঙ্গ তুলে ধরে তিনি বলেন, যারা গণহত্যায় অংশ নিয়েছিল তাদের বিচার করছে বাংলাদেশ। এটা গৌরবের কথা। নাতিদীর্ঘ আলোচনা শেষে শুরু হয় পাঠ। ‘ভয়াবহ অভিজ্ঞতা ১৯৭১’ বই থেকে পাঠ করেন আবৃত্তি শিল্পী মাসকুর-এ-সাত্তার কল্লোল। কুষ্টিয়ার গণহত্যার ভয়াবহতা তুলে ধরার চেষ্টা করেন তিনি। প্রত্যক্ষদর্শী লুৎফর রহমানের অভিজ্ঞতা পাঠ করে শোনান। অপর পরিবেশনায় ছিল শহীদ গীতিকার সুরকার আলতাফ মাহমুদের ওপর নির্যাতনের বর্ণনা। একই টর্চার সেল থেকে প্রাণে বেঁচে আসা কাজী মামুন-উর-রশীদের বর্ণনা পড়ে শোনান তিনি। নায়লা তারান্নুম চৌধুরী কাকলী আবৃত্তি করেন সেলিনা পারভীনের কবিতা থেকে। ‘হায়েনার খাঁচায় অদম্য জীবন’ থেকে পাকিস্তানীদের বর্বরতার বর্ণনা দেন সৈয়দ শহীদুল ইসলাম নাজু। সবশেষে ছিল নাট্যায়োজন। ‘পোড়ামাটি’ নাটকটি নিয়ে মঞ্চে আসে পদাতিক নাট্য সংসদ বাংলাদেশ। বাবুল বিশ্বাসের লেখা নাটকের নির্দেশনা দেন ড. আইরিন পারভীন লোপা। এখানেও বন্দিশিবির। পাকিস্তান বাহিনীর নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরার প্রয়াস। তবে কারও কারও পরিবেশনা ছিল আর সব সময়ের মতোই। গণহত্যার স্মৃতি তুলে ধরার কথা থাকলেও, পরিবেশনায় ব্যাপক হত্যাকা-ের বিষয়টি আসেনি। শহীদ বুদ্ধিজীবী হত্যাকা- পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিল অধিকাংশ পরিবেশনা। প্রথমবারের মতো আয়োজন বলেই হয়ত দিবসটির ভাবার্থে পুরোপুরি প্রবেশ করা গেল না। ভবিষ্যতে হবে। সকলের তা-ই প্রত্যাশা।
×