ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ব্রিটিশ গোয়েন্দারা ঢাকায়

শাহজালাল হয়ে অবৈধ লন্ডন যাওয়া যাত্রীদের বিষয়ে তদন্তে ব্রিটেন

প্রকাশিত: ০৫:১৪, ৯ ডিসেম্বর ২০১৫

শাহজালাল হয়ে অবৈধ লন্ডন যাওয়া যাত্রীদের বিষয়ে তদন্তে ব্রিটেন

আজাদ সুলায়মান ॥ শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ব্যবহার করে ভুয়া ও জাল ভিসায় লন্ডনে প্রবেশের সময় এক মাসে ১৩ জনকে শনাক্ত করেছে ব্রিটিশ পুলিশ। গত অক্টোবর থেকে নবেম্বরের মধ্যে এক মাসে জাল ভিসায় শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে এরা লন্ডন যায়। সেখানকার হিথরো বিমানবন্দর থেকে তাদের ফেরত পাঠানো হলেও বেশ কয়েকজন লন্ডনে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়। এদের নিয়েই উদ্বিগ্ন ব্রিটিশ গোয়েন্দারা এখন ঢাকায় তৎপর হয়েছে। এরই অংশ হিসেবে মঙ্গলবার ঢাকার ব্রিটিশ হাইকমিশনের দুই কর্মকর্তা বিমানের সদর দফতর বলাকায় হাজির হন। তারা বিমানের চেয়ারম্যান ও এমডির কাছে এসব অভিযোগ উত্থাপন করেন এবং দ্রুত তদন্ত চান। একই সঙ্গে বিমানবন্দরের সার্বিক নিরাপত্তা জোরদারেরও তাগিদ দেন। এ সময় তারা আবারও বিমানের জনবলের ঘাটতি ও বিমানবন্দরের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। এ বিষয়ে জানা যায়, গত অক্টোবর থেকে নবেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত এক মাসে হিথরো বিমানবন্দর থেকে ১৩ বাংলাদেশীকে ফেরত পাঠানো হয়। তাদের কারও জাল পাসপোর্ট ও কারও জাল ভিসা ধরা পড়ে। এই এক মাসে কেন এত বেশি জাল-জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে সেটা ব্রিটিশ সরকারের জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বিশেষ করে মিসরের সিনাই পর্বতের কাছে একটি রাশিয়ান বিমান বোমা হামলায় বিধ্বস্ত হওয়ার পর থেকেই ব্রিটিশ সরকার হিথরো বিমানবন্দরের সার্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ শুরু করে। এমনকি যেসব দেশ থেকে সরাসরি হিথরো বিমানবন্দরে যাত্রীবাহী উড়োজাহাজ চলাচল করে, সেসব দেশের বিমানবন্দরগুলোরও নিরাপত্তা ব্যবস্থায় কী ধরনের ঘাটতি আছে তা সরজমিন পরিদর্শনের উদ্যোগ নেয়। এরপরই গত অক্টোবরে ঢাকা আসেন ব্রিটিশ ট্রান্সপোর্ট বিভাগের এক কর্মকর্তা। তিনি দিনভর সরজমিন শাহজালাল বিমানবন্দরের নিরাপত্তাব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ করেন। এ সময় বিমানের কার্গো হাউসের কার্যক্রমও অবলোকন করেন। এরপর ওই টিম বিমানমন্ত্রী রাশেদ খান মেননের সঙ্গে দেখা করে বিমানবন্দর পরিদর্শনের প্রতিবেদন দাখিল করে। তাতে বিমান ও শাহজালাল এয়ারপোর্টের নিরাপত্তা জোরদারে করণীয় সুপারিশ ও মতামত রাখে। এদিকে, ওই প্রতিবেদন দাখিলের পর পরই হিথরো এয়ারপোর্ট থেকে একটি গোয়েন্দা প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। তাতে উল্লেখ করা হয়, গত এক মাসে বাংলাদেশ থেকে শুধু শাহজালাল বিমানবন্দর দিয়ে জাল পাসপোর্ট ও জাল ভিসায় লন্ডনে প্রবেশের সময় বেশ কয়েকজনকে শনাক্ত করা হয়। তাদের মধ্যে ১৩ জনকে তাৎক্ষণিক বিমানবন্দর থেকেই বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হয়। সূত্র জানায়, এ ১৩ জনকে ফেরত পাঠানোর পর ঢাকার ব্রিটিশ হাইকমিশনকে এদের বিষয়ে অনুসন্ধান চালানোর নির্দেশ দেয়া হয়। জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে এ ১৩ জনের হিথরো বিমানবন্দর পর্যন্ত যেতে পরাটা এখানকার নিরাপত্তায় বড় ধরনের ঘাটতি বলে মনে হয় ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের কাছে। এতে তারা উদ্বেগ প্রকাশ করে পরিস্থিতি উন্নয়নে তৎপর হন। এরপর মঙ্গলবার দুপুুরে বিমানের সদর দফতর বলাকায় হাজির হন ঢাকার ব্রিটিশ হাইকমিশনের ইমিগ্রেশান এনফোর্সমেন্টের সেকেন্ড সেক্রেটারি ইমা হারডি ও ইমিগ্রেশন লিয়াজোঁ অফিসার নিরাজ শর্মা। তারা প্রথমে বিমানের চেয়ারম্যান এয়ারমার্শাল জামাল উদ্দিনের সঙ্গে সাক্ষাত করেন। তারপর সাক্ষাত করেন বিমানের ব্রিটিশ এমডি কাইল হেউডের সঙ্গে। এ সময় এমডির কার্যালয়ে অবস্থানকারী এ প্রতিনিধি এমডি কাইলের সঙ্গে সাক্ষাত করে জানতে চান ব্রিটিশ প্রতিনিধি দলের প্রধান অভিযোগ ও মতামত সম্পর্কে। জবাবে কাইল হেউড বলেন, গত সেপ্টেম্বর, অক্টোবর ও নবেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে শাহজালাল বিমানবন্দর দিয়ে বিমানের ফ্লাইটে অস্বাভাবিকসংখ্যক যাত্রী জাল পাসপোর্ট ও ভিসার মাধ্যমে লন্ডনে প্রবেশের সময় ধরা পড়ে। তাদের ফেরত পাঠানো হলেও বিমান কী ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছে সেটা জানতে চেয়েছেন ব্রিটিশ প্রতিনিধিরা। তারা এ ১৩ জনের কেস আলাদা আলাদা তদন্ত করে জানতে চান- নিরাপত্তা ব্যবস্থার কোথায় কোথায় ঘাটতি আছে, কারা কারা এতে সহায়তা করেছে, কী স্বার্থে করেছে- সেসব প্রশ্নের উত্তর। এ সময় তারা আরও মতামতও দিয়ে বলেছে, এ ধরনের নিরাপত্তা ঘাটতি শুধু ব্রিটিশের জন্যই নয়, বিমানের জন্যও হুমকিস্বরূপ। অপর এক প্রশ্নের জবাবে কাইল হেউড বলেন, শুধু যে বাংলাদেশী নাগরিক শাহজালাল দিয়ে বিমানবন্দর ব্যবহার করে লন্ডনে যাচ্ছে, তা নয়। পাশের ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার নাগরিকও ঢাকা হয়ে লন্ডন পাড়ি দিচ্ছে বলে হিথরো বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে তথ্য রয়েছে, যেটা আরও উদ্বেগের কারণ। তিনি বলেন, এসব ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করলে বিমানবন্দরের কোন কোন পযেন্টে কী ধরনের দুর্নীতি ও জাল-জালিয়াতি ঘটছে সেগুলো সহজেই শনাক্ত করা সম্ভব হবে। এসব বিষয়ে জানতে চাইলে এয়ারমার্শাল জামাল উদ্দিন আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, দু’দেশের নিরাপত্তার স্বার্থেই এ ধরনের জালিয়াতির ঘটনায় যারাই জড়িত তাদের শনাক্ত করে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া দরকার। এ নিয়ে কাউকে বিন্দুুমাত্র ছাড় দেয়া যাবে না। একটি সূত্র জানায়, ব্রিটিশ প্রতিনিধি দল আবারও বিমানের কার্গোতে দক্ষ জনবলের প্রচ- অভাবের বিষয়টি সম্পর্কে অবহিত হয়ে অবিলম্বে নিয়োগের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন। এদিকে এ ১৩ জনের বিষয়ে অনুসন্ধান করে জানা যায়, শাহজালাল বিমানবন্দরের একটি সংঘবদ্ব চক্র দীর্ঘদিন ধরেই এ ধরনের জালিয়াতির মাধ্যমে আদমপাচারের সঙ্গে জড়িত। এদের কারণেই প্রতি মাসে গড়ে অর্ধশত যাত্রীর ভিসার পাতা গায়েব হচ্ছে। ছেঁড়া পাতা কৌশলে অন্য পাসপোর্টে লাগিয়ে চলছে আদমপাচার বাণিজ্য। বিমানবন্দরের বিভিন্ন এয়ারলাইন্স, ইমিগ্রেশন পুলিশ, কাস্টমস, সিভিল এ্যাভিয়েশন, সাদা পোশাকে কর্মরত পুলিশ সদস্য আর কতিপয় ট্রাভেল এজেন্টের সমন্বয়ে গড়া শক্তিশালী সিন্ডিকেট এই আদমপাচারের মূল হোতা। সম্প্রতি এ ধরনের দুটি ঘটনায় বিমানবন্দরজুড়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে। সাইফুল আলম (পাসপোর্টনং এবি-২০২৪৪৬৯) ও মনজুুরুল আলম নামে দুই যুবক ২৫ ডিসেম্বর ইতালির ভিসা নিয়ে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আসেন। চট্টগ্রামের শাহ আমানত বিমানবন্দর থেকে বাংলাদেশ বিমানের ট্রানজিট যাত্রী হয়ে তারা শাহজালালে আসেন। ২৬ ডিসেম্বর বিকেল সাড়ে ৪টায় বাংলাদেশ বিমানের বিজি-০০৫৫ ফ্লাইটে তাদের ইতালি যাওয়ার কথা ছিল। ট্রানজিট যাত্রী হওয়ায় বাংলাদেশ বিমানের স্টাফ রেজাউল করিমের কাছে তাদের দু’জনের পাসপোর্ট রক্ষিত ছিল। এরপর রেজাউল করিমের সঙ্গে তারা ইমিগ্রেশন কাউন্টারে গেলে সাজ্জাদ হোসেন নামে ইমিগ্রেশন পুলিশ তাদের পাসপোর্ট ও ভিসা তলাশি করে একটি টোকেনসহ পাসপোর্ট ফেরত দেন। এরপর রেজাউল করিম তাদের উত্তরার বিমানের ভাড়া করা হোটেল এ্যারোলিনে নিয়ে যান। পরদিন দুপুরে বিমানের বোর্ডিং কার্ডসহ তারা ইমিগ্রেশন কাউন্টারে গেলে কর্তৃপক্ষ দীর্ঘসময় তাদের পাসপোর্ট ও ভিসা তল্লাশি করে বহির্গমন সিল দিয়ে ছেড়ে দেয়। কিন্তু ইমিগ্রেশন কাউন্টার থেকে বেরিয়ে এসে সাইফুল আলম নিজের পাসপোর্ট দেখে আঁতকে ওঠেন। দেখতে পান পাসপোর্টে ইতালির ভিসা লাগানো ৭ নম্বর পাতটি নেই। এরপর মনজুরুল আলমের পাসপোর্ট তল্লাশি করেও একই অবস্থা দেখতে পান। বিষয়টি তারা তাৎক্ষণিকভাবে ইমিগ্রেশন পুলিশ এবং বাংলাদেশ বিমান কর্তৃপক্ষকে জানান। সাইফুল আলম জানান, এ ঘটনা ইমিগ্রেশন কাউন্টারে জানালে একজন পুলিশ তাকে ইমিগ্রেশনের এক উর্ধতন কর্মকর্তার কাছে নিয়ে যান। কিন্তু ওই কর্মকর্তা বিষয়টি না শুনে তাদের দু’জনকে চট্টগ্রাম ফেরত পাঠানোর জন্য বিমান কর্তৃপক্ষের ওপর চাপ সৃষ্টি করেন। অন্যথায় আদমপাচারের মামলায় দু’জনকে থানায় সোপর্দ করা হবে বলেও হুমকি দেন। সাইফুল ও মনজুরল চট্টগ্রাম যেতে অস্বীকার করলে তাদের দু’জনকে একদিন বিমানবন্দরে বসিয়ে রাখেন। ২৭ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় তাদের হাতে একটি চিঠি দিয়ে ২৯ ডিসেম্বর মালিবাগের এসবি অফিসে যোগাযোগ করতে বলেন। সাইফুল জানান, এরপর তারা মালিবাগ যান। সেখানে পুলিশ পরিদর্শক একেএম আলমের কাছে তাদের কাগজপত্র ও পাসপোর্ট প্রদান করেন। কিন্তু তিন মাসেও এ ঘটনার কোন সুরাহা হয়নি। দুটি ঘটনায় বিমানবন্দর থানায় মামলা দায়ের করা হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত পুলিশ ঘটনার সঙ্গে জড়িত সিন্ডিকেটের কোন সদস্যকে গ্রেফতার করতে পারেনি। জানা গেছে, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এ ধরনের ঘটনা হরহামেশাই ঘটছে। আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে গলাকাটা পাসপোর্টে (পিসি বাণিজ্য) আদমপাচার। জানা গেছে, বাংলাদেশ থেকে এই পাচারের সবচেয়ে বড় রুট হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। এ দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এ খাত থেকে প্রতি মাসে গড়ে ২০ কোটি টাকার বেশি আয় করছে। বিমানবন্দরে কর্মরত একটি গোয়েন্দা সংস্থা সূত্রে জানা গেছে, ট্রাভেল এজেন্টরা পাচারের জন্য মানুষের যোগান দেয়। আর পাসপোর্ট যোগান দেয় বিমানবন্দরকেন্দ্রিক একটি ছিনতাইকারী চক্র। তারা প্রবাসী যাত্রীদের কাছ থেকে পাসপোর্ট ছিনতাই করে ফকিরাপুলে নিয়ে যায়। সেখানে ট্রাভেল এজেন্সির অফিসে এ্যাসিড দিয়ে ছিনতাই করা পাসপোর্ট থেকে ছবি তুলে ফেলা হয়। এরপর সেখানে পাচারকৃত মানুষের ছবি সংযুক্ত করা হয়। বাংলাদেশ বিমানসহ দেশী-বিদেশী এয়ারলাইন্সগুলো এদের বোর্ডিং কার্ড ইস্যু করে। এরপর সিভিল এ্যাভিয়েশন ও ইমিগ্রেশন পুলিশের কিছু দুর্নীতিবাজ সদস্য পাচারকৃতদের বিমানবন্দর থেকে উড়োজাহাজে তোলার বন্দোবস্ত করে। প্রতি পিসি থেকে গড়ে দুই থেকে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত নেয়া হয়। জানা গেছে, পাচার হওয়া এসব আদম বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিদেশে গিয়ে বৈধভাবে কোন কাজ করতে পারে না। লন্ডন থেকে ফেরত পাঠানো এ ১৩ জনও একই চক্রের শিকার। এদের কপালে এখন কী ঘটে সেটাই দেখার বিষয়।
×