ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

নিজামীর আপীলের চূড়ান্ত রায় ৬ জানুয়ারি

প্রকাশিত: ০৫:০৭, ৯ ডিসেম্বর ২০১৫

নিজামীর আপীলের চূড়ান্ত রায় ৬ জানুয়ারি

বিকাশ দত্ত ॥ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক মৃত্যুদ-প্রাপ্ত জামায়াতে ইসলামীর নেতা আমির আলবদর বাহিনীর প্রধান মতিউর রহমান নিজামীর আপীলের যুক্তিতর্ক শেষ হয়েছে। রায় ঘোষণার জন্য ৬ জানুয়ারি দিন নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে চার সদস্যবিশিষ্ট আপীল বেঞ্চ এ আদেশ প্রদান করেছেন। বেঞ্চে অন্য সদস্যরা ছিলেন, বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী। যুক্তিতর্ক শেষে এ্যাটর্নি জেনারেল বলেছেন, আমি আশা করি নিজামীর সর্বোচ্চ শাস্তি বহাল থাকবে। মৃত্যুদ- না হলে হতাশ হবো। অন্যদিকে আসামিপক্ষের আইনজীবী বলেছেন, আমরা আশা করছি নিজামী খালাস পাবেন। নিজামীর মামলাটি আপীল বিভাগে ৬ষ্ঠ মামলা। ট্রাইব্যুনাল থেকে আপীল বিভাগে আসা মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলাগুলোর মধ্যে এর আগে ৫ জনের মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়েছে। এর মধ্যে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লা, অপর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামান, জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের সাকা চৌধুরী ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে ফাঁসির দ-ের পরিবর্তে আমৃত্যু কারাদ- দিয়েছেন আপীল বিভাগ। অন্যদিকে, জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির গোলাম আযম ও বিএনপি নেতা আব্দুল আলীম আপীল নিষ্পত্তি হওয়ার আগে মারা যাওয়ার কারণে তাদের আপীল অকার্যকর হয়ে যায়। মঙ্গলবার সকালে সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগে বিভাগে যুক্তিখ-ন করেন নিজামীর প্রধান আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানীদের পক্ষে জামায়াতের সহযোগিতার বিষয়ে খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেছেন, মতিউর রহমান নিজামী দুধে ধোয়া নন। তিনি বলেন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের অখ-তা রক্ষায় পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছিলো জামায়াত। আর নিজামী ওই দলের কর্মী হিসেবে রাজনৈতিক বিশ্বাস থেকে পাকিস্তানের পক্ষ নেন। নিজামী দুধে ধোয়া নন। যা করেছেন প্রিন্সিপ্রাল এ্যাকিউজডরা করেছেন, অর্থাৎ পাকিস্তানীরা। নিজামী ছিলেন ২০ বছরের যুবক। তার কথা কী পাকিস্তানী সেনারা মানবে? কার্যদিবসে এর মধ্য দিয়ে শেষ হলো এই আপীলের যুিক্ততর্ক। সোমবার নিজামীর ফাঁসির রায় বহাল রাখার পক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন এ্যাটর্নি জেনারেল। যে চারটি হত্যা-গণহত্যা ও ধর্ষণের দায়ে ট্রাইব্যুনালের রায়ে নিজামীকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদ-াদেশ দেয়া হয়েছে, সেগুলোতে যেন সর্বোচ্চ সাজা বহাল থাকে এর সপক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করেন তিনি। বিশেষ করে একাত্তরের বুদ্ধিজীবী হত্যাকা- সীমাহীন অপরাধ বলে উল্লেখ করে এ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, সর্বোচ্চ শাস্তিই এ অপরাধের একমাত্র সাজা। ফাঁসি ছাড়া এর অন্য কোন বিকল্প নেই। অন্যদিকে, গত ৩০ নবেম্বর থেকে ২ ডিসেম্বর পর্যন্ত তিন কার্যদিবসে আসামিপক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন এ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন ও এসএম শাহজাহান। আসামিপক্ষ বলেন, অপরাধ সংঘটিত হলেও নিজামী সে অপরাধের সঙ্গে যুক্ত নন। এরপরও কোন অভিযোগে যদি আদালত দোষী সাব্যস্ত করেন, তাহলে তাকে যেন চরম দ- দেয়া না হয়, সে বিষয়ে আদালতে আরজি জানান তারা। এ আপীল মামলার শুনানি শুরু হয় গত ৯ সেপ্টেম্বর থেকে। ২৫ নবেম্বর পর্যন্ত ছয় কার্যদিবসে ট্রাইব্যুনালের রায়সহ মামলার নথিপত্র উপস্থাপন শেষ করেন আসামিপক্ষ। বুদ্ধিজীবী গণহত্যা, হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, সম্পত্তি ধ্বংস, দেশত্যাগে বাধ্য করা, আটক, নির্যাতনসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের ষড়যন্ত্র ও সংঘটনে সহযোগিতার অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় ২০১৪ সালের ২৯ অক্টোবর নিজামীকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদ-ের রায় দেয় ট্রাইব্যুনাল-১। রায়ে ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম বলেন, “আদালত সম্মত হয়েছে যে, তিনি যে মাত্রায় হত্যা, গণহত্যা ঘটিয়েছেন, তাতে সর্বোচ্চ সাজা না দিলে তা হবে ন্যায় বিচারের ব্যর্থতা।” পরে রায়ের বিরুদ্ধে ২০১৪ সালের ২৩ নবেম্বর আপীল করা হয়। ৬ হাজার ২৫২ পৃষ্ঠার ডকুমেন্ট পেশ করে তাতে ১৬৮টি কারণ উল্লেখ্য করে দ- থেকে খালাস চেয়ে সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় এ্যাডভোকেট অন রেকর্ড জয়নুল আবেদীন তুহিন এ আপীলটি দাখিল করেন। ১২১ পৃষ্ঠায় মূল আপীল আবেদনের সঙ্গে ৬ হাজার ২৫২ পৃষ্ঠার নথিপত্র দাখিল করা হয়েছে। মূল আপীলে ১৬৮টি গ্রাউন্ড পেশ করে দ- থেকে খালাস চাওয়া হয়েছে। নিজামীর বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের ১৬টি সুনির্দিষ্ট অভিযোগের মধ্যে ৮টি অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়। ১, ২, ৩, ৪, ৬, ৭, ৮ ও ১৬ নম্বর অভিযোগ প্রমাণ হয়েছে। এর মধ্যে ২, ৪, ৬ ও ১৬ নম্বর অভিযোগে নিজামীকে মৃত্যুদ- দেয় ট্রাইব্যুনাল। ১, ৩, ৭ ও ৮ নম্বর অভিযোগে তাকে যাবজ্জীবন কারাদ- দেয়া হয়। এছাড়া ৫, ৯, ১০ থেকে ১৫ নম্বর অভিযোগ প্রমাণ না হওয়ায় এসব অভিযোগ থেকে তাকে অব্যাহতি (খালাস) দেয়া হয়। খালাস পাবেন নিজামী ॥ নিজামীর প্রধান আইনজীবী খন্দকার মাহবুব বলেছেন, মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় মৃত্যুদ-প্রাপ্ত জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামী চূড়ান্ত রায়ে খালাস পাবেন বলে আশা করি। মঙ্গলবার আদালত কর্তৃক চূড়ান্ত রায়ের তারিখ নির্ধারণের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় সাংবাদিকদের এ কথা জানান তিনি। খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, আদালতের কাছে যে যুক্তি উপস্থাপন করেছি তাতে আশা করি ন্যায়বিচার পাবো এবং আসামি খালাস পাবেন। আর যদি ধরে নেয়া হয় তিনি সহযোগী ছিলেন তাহলেও তাকে যেন লঘু দ- দেয়া হয়। তিনি আরও বলেন, রাষ্ট্রপক্ষ গতকাল (সোমবার) আপীলের বিরুদ্ধে যে যুক্তি উপস্থাপন করেছে আজ আমি তার জবাব দিয়েছি। তিনি আরও বলেন, পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত তৎকালীন সময়ে নিজামীর কিছু বক্তব্য তুলে ধরে প্রসিকিউশন বলতে চেয়েছেন তিনি ইনস্টিগেশন (উস্কানি) করেছেন। সে কারণে সে দোষী। আমরা বলেছি, সংগ্রাম পত্রিকায় যতোগুলো বক্তব্য এসেছে সবগুলো ট্রাইব্যুনাল বিবেচনা করেছেন। ট্রাইব্যুনাল ওইসব অভিযোগে তাকে খালাস দিয়েছেন। তিনি বলেন, আদালত বলেছেন, অ্যাবেটমেন্টের কথা। আমি বলেছি, অ্যাবেটমেন্টের ঘটনা স্পেসিফিক করতে হবে। কোন অপরাধের বিষয়ে উস্কানি দিয়েছেন। যে ঘটনাগুলোর কথা উল্লেখ করেছেন সেগুলো পাকিস্তানী আর্মিরা করেছে। প্রসিকিউশন থেকে সাক্ষ্য এসেছিলোÑ নিজামী সঙ্গে ছিলেন। প্রধান আসামি হচ্ছে পাকিস্তানী আর্মি। সর্বোচ্চ শাস্তি আশা করছি ॥ এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম আশা করছেন, নিজামীর সর্বোচ্চ শাস্তি বহাল থাকবে। কারণ এর আগে বুদ্ধিজীবী হত্যার অভিযোগে জামায়াত নেতা মুজাহিদের ফাঁসি হয়েছে। নিজমীর বিরুদ্ধেও এ অভিযোগে চার্জ গঠন করা হয়েছে। একই অপরাধে রায়ের ধারাবিহকতায় মতিউর রহমান নিজামীর সর্বোচ্চ শাস্তিই থাকবে। এ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, নবেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে উনি (নিজামী) আল বদরের উদ্দেশে যে লেখা লিখেছে তা আল বদরদের উদ্বুদ্ধ করার জন্য। আল বদরদের আরও কাজে নিয়োজিত হওয়ার জন্য। তাতে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে এ লেখার পরিপ্রেক্ষিতে ১৪ ডিসেম্বর বা তার কাছাকাছি সময়ে আল বদরদের হাতে দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানরা জীবন হারিয়েছে। কাজেই আল বদরদের ব্যাপারে ওনার যে বক্তব্য সেটা পিন পয়েন্টে। সুতরাং এ থেকে ওনাকে অব্যাহতি দেয়া যায় না। মাহবুবে আলম বলেন, আল বদর বাহিনী যখন গঠিত হয়। তখন তিনি ইসলামী ছাত্র সংঘের সভাপতি ছিলেন। আর ছাত্র সংঘের সদস্যের সমন্বয়ে আল বদর গঠিত হয়। ওনাদের (আসামি) পক্ষ থেকে যুক্তি দেয়া হয়েছে উনি অক্টোবর থেকে আর ছাত্র সংঘের সভাপতি ছিলেন না। সুতরাং ওনার কোন নেতৃত্ব দেয়ার আর সুযোগ নেই। কিন্তু আমরা বলেছি উনি নবেম্বর যে লেখা লিখেছেন তাতে দেখা যায় আল বদরদের ওপর ওনার কন্ট্রোল ছিল। তিনি বলেন, বুদ্ধিজীবী হত্যার বিষয়ে মতিউর নিজামী দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি তথা মৃত্যুদ- যদি না পান তাহলে আমরা হতাশ হবো। আপিন ফাঁসির আবেদন করেছেন কিনা এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, হ্যাঁ। বুদ্ধিজীবী হত্যার অভিযোগে মুজাহিদের ফাঁসি হয়েছে, একই অপরাধে নিজামীর বিষয়ে কি আশা করছেন এ প্রশ্নের জবাবে মাহবুবে আলম বলেন, মুজাহিদের মামলার রায় আদালতে পেশ করেছি। ইসলামী ছাত্র সংঘের নেতৃত্বে নিজামী-মুজাহিদ গোলাম আযমের নাম ছিল। যেহেতু একই অপরাধে মুজাহিদের ফাঁসি হয়েছিলো। তাই রায়ের একইরকম ধারবাহিকতা বজায় রাখতে একই অপরাধে নিজামীরও ফাঁসির দাবি করছি।
×