ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নেই কোন সরকারী স্বীকৃতি ও নিয়ন্ত্রণ, অনুমোদিত নয় পাঠ্যসূচীও

কওমী মাদ্রাসা

প্রকাশিত: ০৫:০৫, ৯ ডিসেম্বর ২০১৫

কওমী মাদ্রাসা

বিভাষ বাড়ৈ ॥ গঠনতন্ত্র অনুসারে নিষিদ্ধ হলেও সরাসরি মাদ্রাসাকে ব্যবহার করে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছেন বাংলাদেশ কওমী মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড বা বেফাকের শীর্ষ নেতারা। বেফাকের নির্বাহী কমিটি মজলিসে আমেলার অধিকাংশ সদস্য ব্যক্তিস্বার্থে সরাসরি যুক্ত বিএনপি-জামায়াত জোটের রাজনীতিতে। এরা আবার হেফাজতের নেতা হওয়ায় এ সংগঠনও ব্যবহার হচ্ছে বিএনপি-জামায়াত জোটের স্বার্থে। পরীক্ষার প্রশ্নপত্র প্রণয়ন, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ, প্রশাসনিক দায়িত্বেও আছেন রাজনৈতিক ব্যক্তিরাই। ফলে উন্নয়নের বদলে হাজার হাজার কওমী মাদ্রাসা ও এর লাখ লাখ শিক্ষক-শিক্ষার্থী ব্যবহৃত হচ্ছে কিছু নেতার ব্যক্তিগত রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির কাজে। এসব বিতর্কিত নেতার রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির কবলে পড়েই সনদের স্বীকৃতি পাচ্ছে না কওমী মাদ্রাসার ৫০ লক্ষাধিক শিক্ষার্থী। কওমী মাদ্রাসা বোর্ড ও এর অধীন মাদ্রাসার কার্যক্রম সম্পর্কে খোঁজ নিতে গিয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও আলেম সমাজের এমন অসন্তোষের চিত্রই উঠে এসেছে। তবে মাদ্রাসাকে ব্যবহার করে অনিয়ম ও রাজনীতি করার প্রেক্ষাপটে এবার তীব্র প্রতিবাদ উঠেছে দেশের আলেম সমাজের পক্ষ থেকেই। বেফাকের সংস্কারসহ শাস্তির দাবি উঠেছে মাদ্রাসাকে ব্যবহার করে দুর্নীতি ও অপরাজনীতিতে জড়িয়ে পড়া ব্যক্তিদের। জানা গেছে, জামায়াতী মদদপুষ্ট কিছু নেতার কারণেই কওমী মাদ্রাসার অর্ধকোটি শিক্ষার্থীর বহু আকাক্সিক্ষত সরকারী সনদ প্রাপ্তি অনিশ্চিত হয়ে পড়ার প্রেক্ষাপটে সনদের দাবি নিয়ে নতুন করে সংগঠিত হচ্ছে কওমী আলেম সমাজ। শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে জামায়াতপন্থীদের চক্রান্ত বন্ধে ঐক্যবন্ধ অবস্থান নিয়েছেন ধর্মীয় দল ও সংগঠনের নেতৃবৃন্দসহ বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদরাও। জানা গেছে, বিভিন্ন দলের নেতারা গুরুত্বপূর্ণ পদে বসে রাজনীতিতে ব্যস্ত থাকায় সঙ্কটের মুখে পড়েছে কওমী মাদ্রাসার সবচেয়ে বড় শিক্ষা বোর্ড বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ (বাংলাদেশ কওমী মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড-বেফাক)। এখানে বিএনপি-জামায়াত জোটের শরিক দল জমিয়তে উলামা ইসলামের নেতাদের প্রভাব বেশি। কওমী মাদ্রাসা ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, দেশে কওমী মাদ্রাসার সংখ্যা দেশে আসলে কত তার হিসাব নেই কারও কাছে। তবে ধারণা করা হয় এই সংখ্যা ৪০ থেকে ৫০ হাজার হবে। সরকারীভাবে অবশ্য গবেষণা ছাড়াই বিভিন্ন সময় তথ্য দিয়ে বলা হয়েছে, এই সংখ্যা হবে ১৪ হাজারের মতো। বেসরকারী বিভিন্ন হিসাবে কওমী মাদ্রাসায় অর্ধকোটি শিক্ষার্থী আছে। এই মাদ্রাসার নেই কোন সরকারী স্বীকৃতি ও নিয়ন্ত্রণ, পাঠ্যসূচীও অনুমোদিত নয়। দেশের কওমী মাদ্রাসা নিয়ন্ত্রণ করে ১৯টি জাতীয় ও আঞ্চলিক বোর্ড। তবে কওমী মাদ্রাসাগুলোর সবচেয়ে বড় নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ কওমী মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড (বেফাক)। এই বোর্ডের নিয়ন্ত্রণ যাদের হাতে তাদের অধিকাংশই এখন হেফাজতের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। এই নেতারাই আবার বিএনপি-জামায়াত জোটের শরিক দলের নেতা। ফলে এরা এখন কওমী মাদ্রাসাকে ব্যবহার করছেন অপরাজনীতির কাজে। কারা পরিচালনা করেন বেফাক? কী তাদের পরিচয় ॥ বেফাকের মজলিসে আমেলার মধ্যে কমপক্ষে ৭ জন রয়েছেন জমিয়তের কেন্দ্রীয় নেতা। ফলে দীর্ঘদিন ধরে কওমী মাদ্রাসার সিলেবাস সংস্কার, ছাত্র বৃত্তি, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণসহ বিভিন্ন দাবি উঠলেও তা বাস্তবায়ন হচ্ছে না। বেফাকের পরিচালনার দায়িত্বে থাকা মজলিসে আমেলার (নির্বাহী কমিটি) সদস্য সংখ্যা ৫৫ জন। হেফাজতে ইসলামের আমির শাহ আহমদ শফী মজলিসে আমেলার সভাপতি। এছাড়াও এই কমিটিতে রয়েছে বিএনপি-জামায়াতপন্থী রাজনৈতিক দল জমিয়তে উলামা ইসলাম, খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের নেতারা। এসব নেতা রাজনৈতিক দল ও বেফাক উভয় ক্ষেত্রেই আছেন নীতিনির্ধারক পর্যায়ে। বেফাকের মজলিসের আমেলার তালিকায় দেখা গেছে, জমিয়তে মহাসচিব মাওলনা নূর হোসেন কাসেমী বেফাকের সহ-সভাপতি, নির্বাহী সভাপতি মুফতি ওয়াক্কাস বেফাকের সহ-সভাপতি, জমিয়তে সহ-সভাপতি মোস্তফা আজাদ বেফাক সহ-সভাপতি, যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মনঞ্জুরুল ইসলাম বেফাকের আমেলার সদস্য, জমিয়তে সহকারী মহাসচিব মাওলানা খালেদ সাইফুল্লাহ সাদী বেফাকের আমেলার সদস্য, সহকারী মহাসচিব মাওলানা মাসউদুল করিম বেফাকের আমেলার সদস্য, জমিয়ত ঘরনার আলেম আবু ফাতাহ মোহাম্মদ বেফাকের আমেলার সদস্য ও বেফাক সহকারী মহাসচিব। অন্যদিকে খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা হাবিবুর রহমান বেফাক সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব মাওলানা মাহফুযুল হক বেফাকের আমেলার সদস্য ও বেফাক সহকারী মহাসচিব। খেলাফত মজলিস সিনিয়র নায়েবে আমির মাওলানা জুবায়ের আহমেদ চৌধুরী বেফাকের আমেলার সদস্য ও বেফাক সহকারী মহাপরিচালকের দায়িত্বে আছেন অথচ বেফাকের গঠনতন্ত্রেই কোন দলের শীর্ষ নেতাদের কেউই কখনও বেফাকের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বশীল পদে থাকার বিধান নেই। বিধান অনুসারে বেফাকের মজলিসে আমেলার সদস্য করা হয় মাদ্রাসার মুমুহতামিমদের (অধ্যক্ষ)। তবে ’৯০-ড়এ এরশাদের পতনের পর বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর থেকেই বেফাকের প্রভাব বিস্তার শুরু হয় রাজনৈতিক দলের নেতাদের। প্রতিনিয়ত তাদের প্রভাবে বেফাক ব্যবহার হয় রাজনৈতিক স্বার্থে। বেফাকের মজলিসে আমেলায় বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হলেও সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রভাব বিস্তার করেন ওই রাজনৈতিক নেতারা। বেফাকে কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগেও রয়েছে রাজনৈতিক প্রভাব। বিএনপি-জামায়াতের স্বার্থ রক্ষায় ক্ষতি ৫০ লাখ মাদ্রাসা শিক্ষার্থীর ॥ কওমী শিক্ষারস্বীকৃতি দিতে ‘বাংলাদেশ কওমী মাদ্রাসা শিক্ষা কর্তৃপক্ষ আইন-২০১৩’ করার উদ্যোগ নিয়েছিল সরকার। এছাড়াও সরকার কওমী মাদ্রাসার সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা জন্য ‘কওমী মাদ্রাসা শিক্ষা কর্তৃপক্ষ’ গঠনেরও উদ্যোগ নেয়। কিন্তু এখানেও বিএনপি-জামায়াতের রাজনীতি করতে গিয়ে সেই নেতারাই হেফাজতের ব্যানারে ‘সরকারী নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার’ ধুয়ো তুলে এ বিরোধিতা করে। অর্ধকোটি শিক্ষার্থীর ক্ষতি করে তারা সরকারকে হুমকি দেয়, এটা করলে রক্ত ঝরবে ইত্যাদি ইত্যাদি। ফলে সরকার প্রক্রিয়া বন্ধ রাখায় কপাল পোড়ে লাখ লাখ সাধারণ শিক্ষার্থীর। কওমী মাদ্রাসার সনদের স্বীকৃতি না থাকায় পড়াশোনা শেষে মাদ্রাসার ছাত্ররা অন্য কোথাও চাকরি করতে পারেন না। ফলে তাদের কর্মসংস্থান হয় মসজিদে ইমামতি, ব্যবসা বা কওমী মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করে। এছাড়াও মাদ্রাসার সিলেবাসে প্রযুক্তিগত শিক্ষা না থাকায় যুগের সঙ্গে তালমিলিয়ে এগোতে পারেছে না ছাত্রছাত্রীরা। এছাড়াও পাঠ্যবই বিক্রি করে বেফাকের আর্থিক সক্ষমতা বাড়লেও বইয়ের ছাপ, কাগজের মান নিম্নমানের। প্রকাশনার সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা নানা অনিয়ম করে ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হচ্ছে। কিছুদিন আগে অনুষ্ঠিত বেফাকের কেন্দ্রীয় পরীক্ষায় তাকমিল হাদিসের (মাস্টার্স সম্মান) তিরমিজি শরীফ ১ম খ-ের মোট ৫টি প্রশ্নের ৪টিই জামিয়া মাদানিয়া বারিধারা মাদ্রাসার নিজস্ব প্রশ্নপত্র থেকে নেয়া হয়েছে। তাদের সাময়িক পরীক্ষা ও দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে হুবহু ছিল। মাদ্রাসাটির পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছেন জমিয়তে মহাসচিব ও বেফাকের সহ-সভাপতি ঢাকা মহানগর হেফাজতের আমির মাওলানা নূর হোসাইন কাসেমী। বারিধারা মাদ্রাসার শিক্ষা সচিব মাওলানা মকবুল হোসাইন একই সঙ্গে বেফাক বোর্ডের প্রশ্নপত্র প্রণয়ন কমিটির অন্যতম সদস্য। এ নিয়ে কওমী আলেমরা প্রতিবাদ করলেও কাজ হয়নি। এ নিয়ে আছে অসন্তোষ। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেফাকের আমেলার এক সদস্য বলেন, বেফাক কিছু রাজনৈতিক নেতার হাতে জিম্মি। বিভিন্ন দলীয় পদবি ধারণকারী ব্যক্তিদের দ্বারা বেফাকের নিয়ন্ত্রণ। তারা তাদের রাজনৈতিক স্বার্থ বাস্তবায়নে ব্যস্ত। বেফাকের সিলেবাস সংস্কার করা, সনদের স্বীকৃতি জরুরী। এসব বিষয়ে পদক্ষেপ না নিয়ে উল্টোপথে হাঁটছেন বেফাকের কর্তারা। যেখানে পবিত্র কোরান ও হাদিস চর্চার জন্য প্রতিনিয়ত নানা গবেষণা, প্রশিক্ষণের দরকার সেখানে দুর্নীতি ঘটনা ঘটছে। আলেম সমাজের একটা বড় অংশ অভিযোগ করেছেন, কওমী মাদ্রাসার উন্নয়ন সাধারণ মানুষ চাইলেও জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত কওমী বোর্ড নেতারা চান না লাখ লাখ শিক্ষার্থী লাভবান হোক, চাকরি কিংবা অন্য কোন সুবিধা পাক। এর আগে গত মহাজোট সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই দাবি অনুসারে কওমী মাদ্রাসার সনদের জন্য কাজ শুরু করেছিল। আলেম ওলামাদের নিয়ে গঠন করা হয় কমিশন। এমনকি সেখানে মূল দায়িত্বই পালন করেন হেফাজতের আমির আহমদ শফী। অথচ এখন শিক্ষার্থীদের ক্ষতি হলেও বিএনপি-জামায়াত জোটের রাজনীতি করতে গিয়ে বোর্ডের গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা হেফাজত নেতারাই সনদের স্বীকৃতির বিরোধিতা করছেন। বিগত চার দলীয় জোট সরকারের সময় থেকেই কওমী মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা তাদের সনদের স্বীকৃতির দাবি জানিয়ে আসছিল। চার দলীয় জোট ওই সময় প্রতিশ্রুতি দিলেও তা বাস্তায়ন হয়নি। ওই সময়ে প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার কাছে গিয়ে বহুবার ইসলামী দল ও সংগঠনের নেতারা সনদের স্বীকৃতিদানের দাবি জানিয়েও সারা পাননি। ওই নেতরা এখন প্রায় প্রত্যেকেই হেফাজতের ব্যানারে রাজনীতি করছেন। ২০০৬ সালে ইসলামী ঐক্যজোটের ব্যানারে এখনকার হেফাজত নেতারাই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাত করে সনদের স্বীকৃতি দাবি করেছিলেন। ওই দিন ঘোষণা দেয়া হয়, কওমী মাদ্রাসার সনদের স্বীকৃতি ঘোষণা করছে সরকার। কওমী মাদ্রাসার সর্বোচ্চ ডিগ্রী দাওরায়ে হাদিসকে মাস্টার্সের (ইসলামী শিক্ষা/আরবি সাহিত্য) সমমান দেয়ার কথা বলা হয়েছিল। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া তার কার্যালয়ে আলেমদের ডেকে এনে এ ঘোষণা দেন। এ সময় তিনি আলিয়া মাদ্রাসা শিক্ষার ফাজিলকে ডিগ্রী এবং কামিলকে মাস্টার্সের সমমান করারও আশ্বাস দেন। তবে খালেদা জিয়ার ঘোষণা আর বাস্তবায়ন হয়নি। ওই ঘটনায় ইসলামী ওই নেতারা চার দলীয় জোট সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনেরও ঘোষণা করেছিল। এরই ধারাবাহিকতায় মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসলেই সেই নেতারা স্বীকৃতির দাবি তোলেন। ইতিবাচক সারা দিয়ে সরকার কওমী মাদ্রাসা শিক্ষার সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসার মহাপরিচালক ও হেফাজতে ইসলামীর আমীর শাহ আহমদ শফীকে চেয়ারম্যান করে ১৭ সদস্যের কমিশন গঠন করে। কমিশনের কো- চেয়ারম্যান হন শোলাকিয়া ঈদগাহের খতিব ফরিদ উদ্দিন মাসউদ। সদস্য সচিব করা হয় গোপালগঞ্জের গওহরডাঙা মাদ্রাসার অধ্যক্ষ রূহুল আমীনকে। মাদ্রাসা ব্যবহার করে রাজনীতির বিরোধিতা ও সনদের স্বীকৃতির দাবি জোরালো হচ্ছে ॥ শিক্ষার্থীদের পক্ষে আন্দোলরত আলেম ওলামারা বলছেন, রাজনীতি আর ব্যবসার অংশ হিসেবেই হেফাজত নেতাদের একটি অংশ স্বীকৃতির বিরোধিতা করেছেন লাখ লাখ শিক্ষার্থীর স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে। এরা আবার প্রত্যেকেই প্রায় ২০ দলের রাজনীতি করেন। গত বছর হফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসচিব জুনায়েদ বাবুনগরী ‘কওমী মাদ্রাসা শিক্ষা আইন-২০১৩ পাস হলে দেশে লাখ লাখ লাশ পড়বে’ বলে হুঁশিয়ারি দেন। একই সুরে বেফাক মহাসচিব আবদুল জব্বার ‘লাখ লাখ লাশ পড়বে’ বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। এই অবস্থায় উদ্যোগ প্রায় চূড়ান্ত করেও অরাজকতা এড়াতে সনদের স্বীকৃতি দান আপাতত স্থগিত করে সরকার। কওমী মাদ্রাসার স্বীকৃতির জন্য আন্দোলরত সংগঠন দাওয়াতে ইসলাম অভিযোগ করেছে, কিছু ধর্ম ব্যবসায়ী সনদের বিরোধিতা করছে। এরা শিক্ষার্থীদের নিজেদের মতো নিয়ন্ত্রণে রেখে ব্যবসা করতে চায়। সংগঠনের আহ্বায়ক মাওলানা জহিরুল ইসলাম (মুস্তাকিম হুজুর) বলেছেন, সরকার যখন কওমী মাদ্রাসার শিক্ষা সনদের স্বীকৃতি দিতে সব ধরনের কার্যক্রম হাতে নিয়েছে তখন কতিপয় আলেম নামধারী মুরব্বি বিরোধিতা করছেন। এতে কওমী শিক্ষা সনদের সরকারী স্বীকৃতি বাস্তবায়ন বাধার মুখে পড়েছে। কিছু মুরব্বি আলেম কওমী শিক্ষাকে নিয়ে ব্যবসা করছেন অভিযোগ করে দাওয়াতে ইসলাম বলেছে, মুরব্বি সেজে সাধারণ ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের কাছ থেকে যাকাত, ফিতরা, কোরবানি পশুর চামড়া ও দান-দক্ষিণা নিয়ে বড় বড় মাদ্রাসা করেছেন। এইসব দ্বীনি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে। মুরব্বি নামধারী এসব আলেম টাকা-পয়সা নিয়ে তাদের জীবনের উন্নতি সাধনে ব্যস্ত। অবিলম্বে কওমী মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ আইন, ২০১৩ করার উদ্যোগ গ্রহণের জন্য সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছেন ‘কওমী ছাত্র-শিক্ষক কল্যাণ পরিষদ।’ এই সংগঠনের নেতারা বলছেন, সরকারের স্বীকৃতি না থাকায় প্রতিবছর প্রায় ৫০ হাজার শিক্ষার্থী কওমী মাদ্রাসা থেকে শিক্ষা সমাপ্ত করে সরকারী চাকরির সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। একই অবস্থান নিয়ে সনদের পক্ষে আন্দোলন করছে বেফাকুল মাদারিসিল কওমিয়্যাহ গোপালগঞ্জ, খাদিমুল ইসলাম বাংলাদেশ, কওমী মাদ্রাসা স্বীকৃতি আন্দোলন পরিষদ, বাংলাদেশ ইমাম পরিষদ, তানজিমুল মাদ্রাসা, কওমী সনদ স্বীকৃতি বাস্তবায়ন পরিষদসহ বেশকিছু সংগঠন। তারা প্রত্যেকেই অভিযোগ করেছে, নানা ভুল তথ্য ছড়িয়ে সনদের বিরোধিতা করেছে ২০ দলীয় জোটভুক্ত ধর্মভিত্তিক দলগুলো। বেফাক সংস্কারে ছয় দফা দাবি কওমী আলেম সমাজের ॥ কওমী মাদ্রাসা বোর্ড বেফাকের শীর্ষ নেতাদের অনিয়ম দুর্নীতি আর মাদ্রাসাকে ব্যবহার করে রাজনীতি করার প্রেক্ষাপটে তীব্র প্রতিবাদ উঠেছে দেশের আলেম সমাজের পক্ষ থেকেই। মাদ্রাসাকে ব্যবহার করে বেফাক নেতাদের রাজনীতি করার প্রতিবাদ জানিয়ে সম্প্রতি সংবাদ সম্মেলন করে বেফাক সংস্কারে ছয় দফা দাবি তুলেছে বাংলাদেশ কওমী মাদ্রাসা শিক্ষক ফেডারেশন। আলেম সমাজের পক্ষ থেকে তোলা হয়েছে বেফার সংস্কারের ছয় দফা দাবি। দাবিগুলো হচ্ছে- প্রশ্নপত্র ফাঁসের জালিয়াতিতে যারা জড়িত তাদের অবশ্যই বহিষ্কার করতে হবে। প্রকাশনা বিভাগে দুর্নীতি ও বই নকলের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বহিষ্কার করতে হবে। দলীয় পদবি ধারণকারী ব্যক্তিদের অবিলম্বে বেফাকের সমস্ত কমিটি থেকে অব্যাহতি দিতে হবে। বেফাক কমিটিতে মাদ্রাসার মুহতামিম ছাড়া অন্য কোন ব্যক্তির অন্তর্ভুক্ত করার সুযোগ বাতিল করতে হবে। বেফাকের সিলেবাস সংস্কার করা খুবই জরুরী, সে বিষয়ে এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে এবং কওমী মাদ্রাসার সনদের সরকারী স্বীকৃতি আদায় করতে হবে। সংগঠনের সভাপতি মাওলানা আব্দুল মাজেদ আতহারী বলেছেন, আমরা গভীর দুঃখের সঙ্গে লক্ষ্য করছি যে, ইসলামী শিক্ষার প্রাণকেন্দ্র পবিত্র কোরান ও হাদিস চর্চার নির্ভেজাল দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কওমী মাদ্রাসাগুলোর নিয়ন্ত্রক সংস্থা বেফাক বোর্ড তার গৌরবের ইতিহাস ঐতিহ্য হারাতে বসেছে। যা অত্যন্ত দুঃখজনক ও মর্মান্তিক। মাওলানা আতহারী দাবি করেন, স্পষ্টভাবেই বোঝা যায় যে, বেফাক-এর বিরুদ্ধে ভেতরে-বাইরে গভীর ষড়যন্ত্রের চাল চলছে। ষড়যন্ত্রকারীরা সিদ্ধহস্ত। তাদের চক্রান্ত সুদূর প্রসারিত, ওরা কওমী ওলামা ও তালিবে ইলমদের স্বপ্নের প্রতীক বেফাককে সুকৌশলে ধ্বংস করতে চায়। ম্লান করে দিতে চায় বেফাকের গৌরব গাথা ইতিহাস-ঐতিহ্যের সোনালি অধ্যায়। তিনি বলেন, অবিলম্বে প্রশ্নপত্র ফাঁসে জড়িত ও চিহ্নিত অপরাধীচক্রকে বহিষ্কার করতে হবে। একই সঙ্গে এসব অপকর্মে সম্পৃক্ত মাদ্রাসাগুলোকেও বেফাক থেকে বহিষ্কার করা হউক। বেফাক প্রতিষ্ঠাদের অন্যতম একজন ঐতিহাসিক শোলাকিয়া ঈদগাহের ইমাম ও খতিব আল্লামা ফরিদ উদ্দিন মাসউদ। তিনি বলেন, বর্তমানে বেফাক রাজনৈতিক প্রভাবিত হয়ে গেছে। যা বেফাকের জন্য ক্ষতিকর। সংবিধানে ছিল বেফাকের গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকবেন না। ধাপে ধাপে রাজনৈতিক প্রভাব শুরু হয়েছে। সরকার কওমী শিক্ষার স্বীকৃতি দিতে চাইলেও বেফাককে যারা রাজনীতিকরণে জড়িত তারা বিরোধিতা করছে। কারণ এসব নেতাদের অনেকে বিএনপি-জামায়াত জোটের শরিক দলের। তারা ভাবছে তাদের জোট ক্ষমতায় আসবে, তখন স্বীকৃতি নেবেন। রাজনৈতিক স্বার্থে লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থীকে বঞ্চিত করা হয়েছে। শোনা যাচ্ছে বেফাকের প্রশ্ন ফাঁস হচ্ছে, অফিসে দুর্নীতি হচ্ছে। এখানে তদন্ত হলে সকলের গোমর ফাঁস হবে। তিনি হতাশা প্রকাশ করে বললেন, যারা যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষায় কাজ করে সেই নেতাদের যদি এতই ভয় হয় তাহলে সরকারের উচিত হেফাজত নেতা শফীর হাতে ক্ষমতা দিয়ে চলে যাওয়া। মাওলানা ফরীদ উদ্দিন মাসউদ আরও বলেন, আগের অবস্থা নেই হেফাজতের ভেতরেও। অনেক নেতাই শিক্ষার্থীদের উপকারের বিষয়টি বুঝতে পারছে। যারা জামায়াতের রাজনীতি করে তাদের বাইরে সকলেই এখন স্বীকৃতির পক্ষে কথা বলছেন।
×