ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মিলু শামস

বিপন্ন ঢাকা ও আমাদের নিশ্বাসের মুক্তি

প্রকাশিত: ০৩:৪২, ৯ ডিসেম্বর ২০১৫

বিপন্ন ঢাকা ও আমাদের নিশ্বাসের মুক্তি

মূল গল্পটি সম্ভবত আন্তন চেখভের। বাংলা শিরোনাম ‘কতটুকু জমি চাই।’ এক লোভী কৃষক দৃষ্টিসীমার সবটুকু জমি দখল করতে চেয়ে নিজের সীমাবদ্ধতার কাছে হার মেনেছিল। শর্ত ছিল, গোটা সার্কেল চক্কর দিয়ে সূর্য ডোবার আগে নির্ধারিত জায়গায় ফিরতে পারলে পুরো জমি তার হবে। কিন্তু যতক্ষণ দেহে প্রাণ ছিল সর্বগ্রাসী লোভ তাকে ছুটিয়েছে- আরও একটু জমি দখলে নেয়া যায় যদি! শেষে প্রাণশক্তি হার মানে লোভের কাছে। লুটিয়ে পড়া দেহ জায়গা পায় কবরের চৌহদ্দিতে। প্রযুক্তিনির্ভর আজকের বাস্তবতায় এ কাহিনী নীতিবাগীশের তত্ত্ব কপচানো মনে হলেও আমাদের অপরিকল্পিত নগর ব্যবস্থাপনায় এর প্রাসঙ্গিকতা ভয়াবহ রকম মূর্ত। ফাঁকা জায়গা পেলেই ককেশিয়ান কৃষকের প্রেতাত্মা তাড়িয়ে ফেরে আবাসন-স্থাপনার নেশায়। নইলে আবাসিক এলাকার পার্ক, খেলার মাঠ, সবুজ বেষ্টনী, ওয়াকওয়েতে অবলীলায় বহুতল ভবন গড়ে ওঠে? তাও খোদ রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের মাস্টার প্ল্যানের চূড়ান্ত নক্সার এরিয়াতে? নক্সায় রয়েছে পার্ক, সবুজ বেষ্টনী, খেলার মাঠ-বাস্তবে বহুতল ভবন, কাঁচাবাজার, পানির ট্যাঙ্ক বা অন্য স্থাপনা। আজকের ঢাকা দেখে বিশ্বাস করা কঠিন এক সময় এ শহরে পার্ক, উদ্যান ও খেলার মাঠের সংখ্যা ছিল এক শ’র বেশি। ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের পরিসংখ্যানে যা এখন দাঁড়িয়েছে সাতচল্লিশে। তাও কেবল নথিতে, বাস্তবে ব্যবহারোপযোগী পার্ক রয়েছে চার থেকে পাঁচটা। পিডব্লিউডি, গণপূর্ত বিভাগ ও অন্যান্য সরকারী প্রতিষ্ঠানের তালিকায় সাতাশটা পার্কের নাম রয়েছে। সেও ওই নামেই। বেশিরভাগই ব্যবহারযোগ্যতা হারিয়েছে। ভাবা যায় এক শ’ থেকে চার পাঁচ! ফাঁকা জায়গা কমতে কমতে কোথায় ঠেকেছে! অথচ নগর বিশেষজ্ঞদের মতে, একটি সুন্দর স্বাস্থ্যকর শহরে কম করে হলেও তিরিশ-পঁয়ত্রিশ ভাগ খোলা জায়গা থাকা দরকার। ব্রিটেনের প্লে-গ্রাউন্ড এ্যাসোসিয়েশনের মতে, প্রতি এক হাজার জনে অন্তত দশ একর খোলা জায়গা থাকা উচিত। রাজউকের ডিটেল্ড এরিয়া প্ল্যান থেকে জানা যায়, ঢাকার এক কোটি তিরিশ লাখ মানুষের জন্য খোলা জায়গা রয়েছে পাঁচ শ’ তিন দশমিক চৌষট্টি একর। হাজারের হিসেবে দশমিক শূন্য চার ভাগেরও কম। এদিকে জনসংখ্যা বাড়ছে। তবে কি আমরাও ওই অপরিণামদর্শী কৃষকের পরিণতির দিকে এগোচ্ছি? সবটুকু খোলা জায়গা দখল হলে কি হবে আমাদের? সুস্থভাবে বাড়বে কি আমাদের সন্তানেরা? ফাঁকা জায়গা ভরে আকাশছোঁয়া ঘরদোরের মনোলোভা হাতছানির অপরিহার্য উপসর্গে আক্রান্ত হচ্ছে প্রথমত শিশু-কিশোররা। তাদের অভিজ্ঞতায় খেলার মাঠ বলে কিছু থাকছে না। আপাত তুচ্ছ মনে হলেও বিষয়টা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। কারণ খেলার মাঠেই শিশুর সামাজিকায়নের প্রথম পাঠ সম্পন্ন হয়। সমবয়সীদের সঙ্গে মেলামেশা, দল বেঁধে খেলা, হারার বেদনা, জয়ের আনন্দ, প্রতিযোগিতা, বন্ধুত্ব, সহমর্মিতা সবকিছুর সঙ্গে পরিচয় খেলার মাঠে। একজন পূর্ণ সামাজিক মানুষ হওয়ার ভিত অজান্তেই তৈরি হয় খেলার মাঠে। সোশ্যালাইজেশনের জন্য মনোবিদদের কাছে ছুটতে হয় না। এখনকার শিশুদের জন্য প্রায়শই যা করতে হয়। চার দেয়ালে আবদ্ধ শিশুর শরীর-মন দুয়ের বিকাশ অপরিপূর্ণ থাকে। নিঃসঙ্গতা থেকে তৈরি হয় নানা ধরনের মানসিক জটিলতা। ঠিক সময়ে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ না নিলে এ শিশুরা অস্বাভাবিক ব্যক্তিত্ব নিয়ে বড় হয়ে ওঠে। বাইরে থেকে সুস্থ-স্বাভাবিক মনে হলেও অসম্পূর্ণ ব্যক্তিত্ব নিয়ে বেড়ে ওঠা এসব শিশু ব্যক্তি বা সমাজ জীবনে তেমন কোন অবদান রাখতে পারে না। স্কুলে মাঠ নেই, বিকেলে খেলতে বা বেড়াতে যাওয়ার জায়গা নেই। স্কুল ভবন থেকে বাসভবন, ফুড কোর্ট থেকে শপিং মলে আবদ্ধ শিশুরা আত্মকেন্দ্রিক ও অসামাজিক হচ্ছে ক্রমশ। জীবনযাপনে প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন এসেছে। বিশ্বজুড়ে চিকিৎসা বিজ্ঞানী ও পুষ্টিবিদরা বলছেন, কর্মময় দীর্ঘ-সুস্থ জীবনের পূর্বশর্ত সঠিক খাদ্যাভ্যাস ও শরীরচর্চা। নতুন নতুন গবেষণায় তারা দেখছেন সঠিক লাইফ স্টাইল হৃদরোগ-ডায়াবেটিসের মতো রোগের জটিলতা পর্যন্ত কমাতে তো পারেই, প্রতিরোধও করতে পারে। লাইফ স্টাইলে শরীরচর্চা বিশেষ করে হাঁটার ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। প্রতিদিন মুক্ত বাতাসে এক ঘণ্টা হাঁটা শরীরকে অনেক জটিলতা থেকে মুক্ত রাখে। এ সুযোগ আমরা হারাচ্ছি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, খোলা জায়গা মানুষের জীবনের মৌলিক বিষয়। কোন শহরে খোলা জায়গা কম থাকলে সেখানে মৃত্যুহার বেশি থাকে। এ তথ্য অনুযায়ী প্রকারান্তরে আমরা আয়ু ঝুঁকিতে রয়েছি। আর শহরের জনসংখ্যার বিশাল অংশ নিম্নবিত্ত ও বিত্তহীনরা তো প্রত্যক্ষ আয়ু ঝুঁকিতে রয়েছেই। অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও মাঠ, পার্ক বেদখলের অজুহাত হিসেবে সাধারণত অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপকে সামনে আনা হয়। আসলে বুঝে না বুঝে অথবা প্রভাবিত হয়ে কথাগুলো বলি আমরা। কারণ জনসংখ্যার যে অংশ ‘অতিরিক্ত’ তারা মূলত ভাসমান। পার্ক, মাঠ, খোলা জায়গা দখল করার শক্তি বা সাহস কোনটাই তাদের নেই। বড়জোড় দিন শেষে খোলা জায়গায় রাতটুকু পার করার ধৃষ্টতা তারা দেখাতে পারে। দখল যারা করে তাদের রয়েছে সামাজিক, রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ক্ষমতা এবং অর্থের জোর। রাজউকের মাস্টার প্ল্যানের সবুজ বেষ্টনী দখল করে বহুতল ভবন নির্মাণ সোজা কাজ নয়। কিন্তু কেন এমন হচ্ছে? বহুতল ভবন তৈরির বাস্তবতা দেখা দিলে নিশ্চয়ই তা করতে হবে। কিন্তু এভাবে দখল করে অপরিকল্পিতভাবে ভবন তৈরি করার মানসিকতা সমর্থন করা যায় না। পুঁজিবাদী প্রতিযোগিতার দৌড় সামন্তবাদী মানসিকতা নিয়ে এগোলে হয় না। মুনাফা অর্জনেরও স্বাভাবিক প্রক্রিয়া রয়েছে। স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় না গিয়ে ধুন্ধুমার কা- ঘটালে সবকিছু তালগোল পাকায়। ঢাকার এখনকার চেহারা তার প্রমাণ। যেমন তেমন একটা ফাঁকা জায়গা পাওয়া গেল, ব্যস শুরু হলো বহুতল আবাসিক প্রকল্পের কাজ। যেন সব মানুষের এ্যাপার্টমেন্টের বন্দোবস্ত এই ঢাকাতেই করতে হবে। মানসিকতা বদলে অন্যভাবে চিন্তা না করলে মরণদশায় পৌঁছাতে এ শহরের বেশি সময় লাগবে না। সুষ্ঠু আরবান প্ল্যানিংয়ের কিছু শর্ত থাকে যেমনÑ সৌন্দর্য, নিরাপত্তা, স্বল্প আয়ের আবাসন নির্মাণ, পুনর্নির্মাণ, যোগাযোগ ও যান চলাচল, নগরায়ণ হ্রাস, পরিবেশগত উপাদান, আলো ও শব্দ নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি। আমাদের আরবান প্ল্যানিংয়ে এখন সবচেয়ে বেশি জোর দেয়া দরকার নগরায়ণ কমানো অর্থাৎ সাব আরবানাইজেশনের দিকে। ঢাকাকে বদ্ধ শহরে পরিণত না করে আশপাশের ছোট শহর বা উপশহরগুলোর দিকে মনোযোগ দিলে চাপ অনেক কমবে। এখানে যোগাযোগ ও যান চলাচলের বিষয়ও গুরুত্বপূর্ণ। ট্রাফিক জ্যাম নিয়ন্ত্রণ করে ঠিক সময়ে পৌঁছানোর নিশ্চয়তা থাকলে নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, গাজীপুর, সাভারের বহু মানুষ ঢাকার সংসার গুটিয়ে নিজ শহর থেকে স্বাচ্ছন্দ্যে ডেইলি প্যাসেঞ্জারি করবে। পুনর্নির্মাণের সুযোগও আমাদের আছে। প্রাকৃতিক নিয়মেই সব শহরের একটা অংশ ক্রমশ পুরনো হয়ে ক্ষয়ে যেতে থাকে। তাকে ভেঙ্গে নতুন করে তৈরির প্রক্রিয়া হাতে নিতে হয়। যেমন আমাদের পুরনো ঢাকা। শুধু ওই এলাকার জন্য একটা পরিকল্পনা করা যেতে পারে। ওখানকার বাড়িঘর-রাস্তার পুনর্বিন্যাস করলে আবাসন সঙ্কটের অনেকটা কাটানো যায়। কিন্তু এ ঝামেলাপূর্ণ কাজে নির্মাণ কোম্পানিগুলোর আগ্রহ নেই। তার চেয়ে পশ এলাকার এক টুকরো জমি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে ‘ম্যানেজ’ করে দখল করায় তারা বেশি আগ্রহী। কারণ এর পুরোটাই লাভ। এখানে বেশ কিছু নির্মাণ কোম্পানি আছে সদিচ্ছা থাকলে যারা পুরনো ঢাকাকে নতুনরূপে নতুন ঢাকার সঙ্গে মেলাতে পারে। এ জন্য কিছুটা হলেও আন্তরিকতা থাকা দরদার। নিজ শহর ও দেশের প্রতি মমতা থাকা দরকার। লুটেপুটে খাওয়ার মানসিকতায় যে ক্ষতি এবং ভয়াবহ পরিণতির সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে, তার হাত থেকে তাদেরও রেহাই মিলবে না। সরকারের এ বিষয়ে শক্ত পদক্ষেপ নেয়া দরকার। পার্ক ও খেলার মাঠ রক্ষায় বছর কয়েক আগে উচ্চ আদালত এক নির্দেশ দিয়েছিল। এতে রাজধানীর ৬৮টি পার্ক ও ১০টি খেলার মাঠের সীমানা নির্ধারণ করতে বলা হয়েছে। সে সঙ্গে পার্ক ও খেলার মাঠ পরিচালনার জন্য বানানো স্থাপনা ছাড়া অন্যসব স্থাপনা উচ্ছেদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। খেলার মাঠগুলো হচ্ছে- গোলাপবাগ মাঠ, বাংলাদেশ মাঠ (আগামসি লেন), বাসাবো মাঠ, লালবাগ শ্মশানঘাট মাঠ, লালবাগ কেল্লার মোড় মাঠ, ধূপখোলা মাঠ, ধানম-ি মাঠ, কলাবাগান মাঠ, বনানী মাঠ ও গুলশান মাঠ। পার্কের মধ্যে রয়েছে ওসমানী উদ্যান, কারওয়ান বাজার চিলড্রেন পার্ক, সায়েদাবাদ শিশু পার্ক, নিমতলী শিশু পার্ক, মোহাম্মদপুর শহীদ পার্ক, বলদা গার্ডেন, বাহাদুর শাহ পার্ক, গুলশান পার্ক, মিরপুর শিশু পার্ক, বোটানিক্যাল গার্ডেন, যাত্রাবাড়ী পার্ক প্রভৃতি। পরিবেশ আইনবিদ সমিতির এক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৩ সালে উচ্চ আদালত রুল জারি করে। ওই সময় একটি পরিবেশবাদী সংগঠন ও পেশাজীবী সংগঠন আরেকটা রিট আবেদন করে। রিট দুটির পরিপ্রেক্ষিতে আদালত ওই রায় দেয়। ১৯৫৯ সালে ঢাকা শহরের মাস্টার প্ল্যান করা হয়েছিল- যেখানে ২৯১ একর খোলা জায়গা রাখা হয়েছিল। সে প্ল্যান বাস্তবায়ন হয়নি। ২০০০ সালে আইন করা হয়েছিল যাতে বলা হয়েছে, খেলার মাঠ, পার্ক, খোলা জায়গা ও প্রাকৃতিক জলাধারের কাঠামো ও আকৃতি পরিবর্তন করা যাবে না। ওই আইন উপেক্ষা করেই চলছে দখল বাণিজ্য। [email protected]
×