ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

যে বিপ্লব স্বপ্ন দেখায়

প্রকাশিত: ০৬:৫০, ৮ ডিসেম্বর ২০১৫

যে বিপ্লব স্বপ্ন দেখায়

বর্তমান যুগে যে কোন আন্দোলন আর প্রতিবাদের জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আর মিডিয়া বেশ ভালভাবেই সাড়া ফেলতে সক্ষম। তাই অনেক সময়ই শাসকশ্রেণী নানা অজুহাতে এসবের ব্যবহার সীমিত করে জনগণের অধিকারের স্বাধীনতায় লাগাম টেনে ধরতে চান। কিন্তু যেখানে সংগ্রাম টিকে থাকার, স্বাধীনতার ইচ্ছা যেখানে প্রবল, মানবিকতা যেখানে অবরুদ্ধ সেখানে ঠিকই প্রতিবাদ সংগঠিত হবে কোন না কোনভাবে। বার বার বাধাপ্রাপ্ত হওয়ার পরেও। সর্বকাল আর সর্বদেশে এই আসল প্রতিবাদটি করতে হয় বাস্তবের রণাঙ্গনে। বুলেটের সামনে তোপের মুখে। সেটা আগ্নেয়াস্ত্র হাতে নিয়েই হোক কিংবা মাইক্রোফোন, গিটার, কলম, রং-তুলি অথবা ক্যামেরা। সৃষ্টিশীল প্রতিবাদের এই অস্ত্রগুলোই যুগে যুগে স্বাধীনতার পক্ষে অসাম্প্রদায়িকতার পক্ষে কথা বলেছে। হাতিয়ার হয়েছে মানুষের মুক্তি-সংগ্রামের। বর্তমান পৃথিবীর যুদ্ধবিধস্ত সিরিয়ার দিকে তাকালেই আমরা দেখতে পাব কিভাবে সেখানে সংগঠিত হয়েছিল এক সাংস্কৃতিক প্রতিবাদ। এখনও সিরিয়ার সাধারণ বেসামরিক ও উদ্বাস্তু নাগরিকরা চলমান গৃহযুদ্ধের বিরুদ্ধে এসব হাতিয়ার নিয়েই রুখে দাঁড়াচ্ছে, প্রতিবাদ করে যাচ্ছে যে যার জায়গা থেকে। ২০১১ সালের আগের সাংস্কৃতিক অবস্থার সঙ্গে বর্তমান সিরিয়ার সাংস্কৃতিক অবস্থার কোন মিল নেই বলতে গেলে। তখন সংস্কৃতিকচর্চা ছিল অভিজাত শ্রেণীকেন্দ্রিক; অনেকাংশে মেকি ও নিছক বিনোদনমূলক। কিন্তু এখন অবস্থা পাল্টেছে। উপরতলা নয়, বরং সমাজের নিচুতলা ও তুলনামূলকভাবে গরিব মানুষদের দ্বারাই পরিচালিত হচ্ছে সিরিয়ার সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, সশস্ত্র যুদ্ধের বিপরীতে শান্তিপূর্ণ বিপ্লব। মুক্তির দাবিতে শুরু হওয়া আরব বসন্তের প্রথম দিককার দিনগুলোতে সিরিয়ার সামাজিক গণমাধ্যমগুলো স্বৈরশাসক আসাদ সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভের ঢেউ তুলেছিল। তাদের আশা, মর্যাদা ও অধিকার রক্ষার দাবি ছিল এই বিক্ষোভে। বিক্ষোভকারীরা দাবি আদায়ের জন্য মুক্তাঙ্গনে আয়োজন করেছিল সেøাগান, দেয়ালচিত্র, কার্টুন, নাচ আর গানের। বুলেটের নিশ্চিত আঘাত আসবেÑ এটা জানা থাকার পরেও এসব আয়োজিত হয়েছিল। শুরুটা হয়েছিল বিক্ষোভকারীদের সেন্ট্রাল স্কয়ারে (মারজেহ স্কয়ার) অবস্থানকে কেন্দ্র করে। মিসরের তাহরির স্কয়ার দখলের ঘটনা তাদের অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিল। পূর্ব-দামেস্কের শহরতলীর বাসিন্দারা রাজধানীর আব্বাসীয়ন স্কয়ারে পৌঁছানোর জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছিল সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধরে। কিন্তু ডজন ডজন লাশ পড়ছিল। অন্যদিকে প্রতি হাজারে মাত্র দশজন করে ক্লক স্কয়ারে হমস দখল করতে পারল। সেখানে তারা প্রার্থনা করছিল আর গান গাইছিল। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই নিরাপত্তা বাহিনী সেখানে রক্তগঙ্গা বইয়ে দেয়। চলচিত্র নির্মাতা মনজার দারউইশ। যার নির্মিত চলচিত্র ‘মেটাল ইজ ওয়ার’ স্বৈরশাসকের বন্দুকের নলের বিপরীতে প্রতিবাদের শোরগোল তুলতে সক্ষম হয়। যার পর্দাজুড়ে ছিল হেভি মেটালের সুর আর রণভূমির দৃশ্য। এই নির্মাতাকেও দেশ ছাড়তে হয়। অন্যদিকে, সাহিত্যিক খালেদ খলিফার হাত ভেঙ্গে দিয়েছিল শাসকের নির্মম আঘাত। কারণ তিনি লিখেছেন অধিকার আদায়ের স্বপ্নের কথা। সিরিয়ার প্রথম হিপহপ গানের ব্যান্ড দল ‘রিফিউজি অফ র‌্যাপ’ এই দলের সদস্যদের মেরে ফেলার হুমকি দেয়া হয়, এমনকি তাদের স্টুডিওটি গুড়িয়ে দেয়া হয়। র‌্যাপ গানের কথা ও শব্দের ব্যবহারে তারা যুদ্ধের বিভীষিকার এমন বর্ণনা ছিল যা শাসকের কাছে ভয়ঙ্কর হিসেবে ধরা দেয়। আরও অনেকের মতোই এই দলটিরও আশ্রয় এখন ইউরোপ। ইব্রাহীম কাশাশ তরুণ কবি ও গীতিকার। বিদ্রোহের দিনগুলোতে যে হামার জনসমুদ্রে গেয়ে উঠেছিল ‘ইয়ালা হিরহাল! ইয়া বাসার!’ অর্থাৎ ‘গেট আউট বাসার! তোমার চলে যাবার সময় হয়েছে!’ খুব শীঘ্রই কণ্ঠনালী বিচ্ছিন্ন অবস্থায় তার লাশ পাওয়া যায় নদীর তীরে। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কার্টুনিস্ট আলী ফিরজাত যার অসংখ্য কার্টুন স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে কথা বলে। সর্বশেষ আগস্ট ২০১১ তে কার্টুন এঁকে ব্যাঙ্গ করেছিলেন আসাদ সরকারকে। সেই কার্টুনটিতে দেখা যায়, জিপ গাড়িতে পলায়নরত তৎকালীন লিবীয় প্রেসিডেন্ট গাদ্দাফীর গতিরোধ করে আসাদ লিফট চাইছেন, সঙ্গে ফরেন সেক্রেটারি, একগাদা কাগজপত্র আর একটি পেটমোটা ব্রিফকেস। এই কার্টুনটি প্রকাশিত হওয়ার পর পরই আসাদ সরকারের নিরাপত্তা বাহিনী তার দুহাতের আঙ্গুল ভেঙ্গে দেয়। বর্তমানে এই কার্টুনিস্ট কুয়েতে পালিয়ে আছেন। আকরাম রাসলান নামে আরেক কার্টুনিস্টের ভাগ্য এর চেয়েও খারাপ। তাকে শাসকের নির্যাতনে প্রাণ হারাতে হয়। এভাবে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের বিরুদ্ধে একের পর এক শাস্তি দিয়ে যাওয়াটা চরম ভয়ানক প্রতীকী আইনে পরিণত করে শাসকশ্রেণী। একদিকে আসাদ সরকারের ব্যারল বোমার আঘাত আরেকদিকে, আইসিসের অত্যাচার লুটপাটের শিকার প্রায় ১২ মিলিয়ন সিরীয় নাগরিক অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুহারা হয়েছে। ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া গ্রাম আর বসতবাড়ি ছেড়ে থাকতে হচ্ছে খোলা আকাশের নিচে গাছের তলায় অথবা সাময়িক আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে। কেউ কেউ ঘুরে বেড়াচ্ছে বর্ডারগুলোতে সীমানা পাড়ি দেয়ার আশায় আর কেউ কেউ হাহাকার করছে ইউরোপিয়ান সমুদ্রতীরগুলোতে। প্রতিবেশী দেশগুলোতে আশ্রয় নিয়েছে প্রায় চার মিলিয়ন শরণার্থী। এই সব মানুষরা তাদের দুঃখ কষ্ট রাগ ক্ষোভ স্বজন হারাবার বেদনার পাশিপাশি মনন ও সৃজনশীলতাও সঙ্গে করে নিয়েই শরণার্থী হয়েছে। ইতোমধ্যেই ইউরোপের বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নেয়া সিরীয়রা তাদের উদ্বাস্তু ইমেজে পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছে। যারা একসময় রাতের আঁধারে নীরবে জীবন নিয়ে পালিয়ে এসেছিল তারাই এখন আবার স্বপ্ন দেখছে তাদের অধিকার মর্যাদা ফিরে পাবার। এজন্য তারা রাজনীতি, যুদ্ধ, সন্ত্রাসবাদ বা ধর্মকে নয়, বরং বেছে নিয়েছে সাংস্কৃতিক প্রতিবাদকে। তারা তাদের হারিয়ে যাওয়া স্বজনদের কথা, তাদের ত্যাগের ইতিহাস জানাতে চায় শরণার্থী শিবিরে বেড়ে উঠতে থাকা ছেলেমেয়েদের। ধর্মীয় রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত নিরপেক্ষ শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে চায় একটি নতুন প্রজন্মকে। ক্রোধকে ভালবাসায়, হিংসাকে সৃষ্টিকর্মে, হতাশা আর দুঃখকে আশায় পরিণত করতে শিখে গেছে তারা। বিডি নিউজের সৌজন্যে
×