ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

জাকারিয়া স্বপন

ফুল বিক্রি করে স্কুল হয় না

প্রকাশিত: ০৬:২১, ৭ ডিসেম্বর ২০১৫

ফুল বিক্রি করে স্কুল হয় না

গত সপ্তাহেও বাচ্চাগুলো রাস্তায় গাড়ি থামাল। গায়ে হলুদ রঙের টি-শার্ট, হাতে ফুল। টি-শার্টের লেখা থেকে বুঝতে পারলাম, তারা বাংলাদেশের সবার জন্য মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করতে চায়। ফুল বিক্রি করে টাকা যোগাড় করছে স্বেচ্ছাসেবকরা। গাড়ি জানালার কাচ নামিয়ে কেউ টাকা দিয়ে সেই ফুল কিনছে। দূরে একজনের কাছে রসিদ বই। কেউ সেই রসিদ নিচ্ছে, কারও হয়ত সেটা নেয়ার মতো সময়ও নেই। ট্রাফিক সিগন্যালে দাঁড়িয়ে একদল ছেলেমেয়ে এভাবেই ফুল বিক্রি করে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে পাল্টে দেয়ার ব্রত নিয়েছে। এটা যে একটি ট্রাফিক সিগন্যালে করা হচ্ছে তা নয়। ঢাকা শহরের বিভিন্ন সিগন্যালে একই সঙ্গে ফুল বিক্রি করছে স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা। একটি স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের ব্যানারে মাঝে মধ্যেই এই কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। এই নিয়ে বেশ কয়েকবার একই দৃশ্য আমি দেখেছি। এটা এক ধরনের স্বেচ্ছাসেবা, ইংরেজীতে যাকে আমরা বলি ভলেন্টিয়ারিং। বিনা পারিশ্রমিকে সমাজের কোন একটি কাজ করে দেয়া। যে কোন মাপেই স্বেচ্ছাসেবা একটি মহৎ কাজ। বাংলায় যদিও একটি প্রবাদ আছে যে ‘নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো’, তবে কিছু মানুষ এই সমাজে থাকে যারা এই কাজগুলো ঠিকই করে থাকেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এখন স্বেচ্ছাসেবার ধরন অনেক পাল্টে গেছে। আমরা আশা করছি না সবাই বনের মোষ তাড়াবে, তবে ‘গিভিং ব্যাক’ কনসেপ্টটা সমাজে থাকাটা জরুরী। খালি সারাক্ষণ আমি নেব, আর কিছুই ফেরত দেব না- এটা খুবই স্বার্থপর চিন্তাভাবনা। একটি সমাজ যদি শুধুই স্বার্থপর হয়ে ওঠে, তখন সে তার ব্যালেন্স হারিয়ে ফেলে। বাংলাদেশেও তাই হয়েছে, তাতে কোন সন্দেহ নেই। বর্তমানের বাংলাদেশের মানুষ বিশ্বাস করে, ‘নিজের বোঁচকা সাবধান, অন্যের বোঁচকা ঘরে আন।’ ছল চাতুরী করে সম্ভব না হলে শক্তি প্রয়োগ করে, সেটা না হলে কারও জীবন নাশ করে দিয়ে হলেও অন্যের সম্পদকে নিজের করে নেয়ার যে প্রতিযোগিতা শুরু“হয়েছে এবং সেটাকে আমরা সবাই যেভাবে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছি, তার ভেতরে যদি কেউ স্বেচ্ছাসেবা নিয়ে কাজ করে তাকে তো মাদার তেরেসার মতো সম্মান জানানো উচিত। স্বেচ্ছাসেবাকে আমি মনেপ্রাণে সমর্থন করি। তবে বাচ্চাদের রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে ফুল বিক্রি করে টাকা সংগ্রহ করাকে আমি সমর্থন করি না। ঢাকার রাস্তায় যারা ফুল বিক্রি করে টাকা সংগ্রহ করছে, তারা সবাই ধনী ঘরের সন্তান। তারা ইংরেজী মাধ্যমে লেখাপড়া করে, যাদের স্কুলের বেতন খুব কম করে হলেও মাসিক ১০ হাজার টাকা এবং বছরে লক্ষাধিক টাকা। কারও কারও আরও অনেক বেশি। এই ছেলেমেয়েদের একজনের পেছনে বছরে শুধু শিক্ষা বাবদ যে টাকা খরচ হয়, সেটা দিয়ে বাংলাদেশের গ্রামে পুরো একটি স্কুল চলতে পারে। স্বেচ্ছাসেবা করতে হয় এক ধরনের বিশ্বাস থেকে। তারা যদি সত্যিই বিশ্বাস করে থাকে যে, গ্রামের ছেলেমেয়েদের শিক্ষা ব্যবস্থা উন্নত করতে তারা সাহায্য করতে পারে, তাহলে তাদের প্রথম কাজটি হবে পরিবারকে বলে গ্রামের স্কুলগুলোকে সাহায্য করা (কিংবা যে স্কুলগুলোকে তারা সাহায্যের জন্য টাকা তুলছে সেগুলোকে পরিচালনা করা)। যখন এই কাজটি করার পরেও তাদের বাড়তি টাকার প্রয়োজন হবে, তখন রাস্তায় নামা এবং তখনও সেই বিশ্বাসকে ধরে রাখতে হবে। দুই. ঢাকা শহরের ট্রাফিক সিগন্যালে ফুল বিক্রি করে কত টাকা ওঠে? আমি যেই সিগন্যালগুলোতে লক্ষ্য করেছি, সেখানে তাদের হাতে ৫০০ ফুলও ছিল না। ধরে নেই সারাদিনে একটি দল ৫০০ ফুল বিক্রি করতে পারবে। একটি ফুলের জন্য গড়ে মানুষ ৫০ টাকা করে দান করতে পারে। (এখানে ফুল বিক্রিটা মুখ্য নয়, এটা মূলত অনুদান চাওয়া)। তাহলে একটি ট্রাফিক সিগন্যালে উঠতে পারে ২৫,০০০ টাকা। একটি দলে দেখে মনে হলো ২৫ জনের মতো কাজ করছেন। তাহলে এই ২৫ জনের জন্য প্রতিষ্ঠানের খরচ হলো ১২,৫০০ টাকা (তাদের টি-শার্ট, দুপুরের খাওয়া, যাতায়াত ইত্যাদি মিলে গড়ে ৫০০ টাকা হারে)। অর্থাৎ অর্ধেকই চলে গেছে টাকা তুলতে। এই হিসাবে তারা সারাদিন কয়েক লাখ টাকার বেশি তুলতে পেরেছেন বলে মনে হয় না। অথচ এদের অনেকেরই পরিবারের সামর্থ্য রয়েছে এর চেয়ে অনেক বেশি অনুদান দেয়ার। তারা তাদের পরিবারকে কেন প্রথমে কনভিন্স করতে পারছেন না? এর বিপক্ষে কঠিন যুক্তি হলো- না, পরিবারগুলো চাইছে তাদের সন্তানেরা স্বেচ্ছাসেবার সঙ্গে যুক্ত হোক, স্বেচ্ছাসেবা শিখুক; তাহলে ভবিষ্যতে চোর-ডাকাত না হয়ে কিছু হয়ত সমাজে ফেরত দেবে। সমাজকে অনুভব করতে শিখবে। বাংলাদেশকে চিনতে পারবে। পাশাপাশি অন্যকে এ কাজে উদ্বুদ্ধ করতে পারবে। নিজের সন্তানের সঠিক ট্রেনিংয়ের জন্য মা-বাবা হিসেবে এমনটা তো কেউ ভাবতেই পারেন। রাস্তায় গাড়ির আরোহীদের কাছ থেকে চাঁদা তোলা হলো এই পৃথিবীর সবচেয়ে নিম্নমানের স্বেচ্ছাসেবা। জাতীয় পর্যায়ে একটি জাতি সঙ্কটে না পড়লে এমন কাজে নামে না। ধরুন বন্যা, ভূমিকম্প কিংবা আগুনে হাজার হাজার ঘরবাড়ি এবং জীবন সঙ্কটে পড়েছে। সেই সঙ্কটে জরুরী ভিত্তিতে সাহায্যের জন্য মানুষ রাস্তায় নামে। এর বাইরে পরিকল্পিতভাবে কাউকে সাহায্য করতে হলে, কোন সংগঠন যদি রাস্তা থেকে টাকা তোলার পরিকল্পনা করে থাকে- এর চেয়ে নিচুমানের পরিকল্পনা আর দ্বিতীয়টি হতে পারে বলে আমি মনে করি না। তাদের উদ্দেশ্য নিয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। হয়ত প্রচার, নয়ত টাকাটা নয়ছয় করা। স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের স্বেচ্ছাসেবা শেখানোর জন্য টাকা তুলতে হবে কেন? একবার ভাল করে তাকিয়ে দেখেছেন রাস্তায় আর কারা গাড়ি থামিয়ে টাকা চায়? ঢাকা শহরের ফকির চক্র (যারা একটা মাফিয়া দলের অংশ), এলাকার ক্লাবগুলো, মসজিদ/মাদ্রাসার লোকজন, অসুস্থ বন্ধুকে বাঁচানোর জন্য বাক্স নিয়ে শত শত মানুষ ট্রাফিক লাইটে জ্যাম করে থাকে। তার ভেতর নতুন উৎপাত শুরু হয়েছে এই ফুল বিক্রি। বাংলাদেশে কি স্বেচ্ছাসেবার আইডিয়ার কমতি রয়েছে? যে কোন মানুষকে খারাপ করার জন্য সবচেয়ে ভাল যন্ত্র হলো টাকা-পয়সা। আপনি একটি ভাল ছাত্রকে খারাপ বানাতে চান, তার হাতে প্রতিদিন কিছু বাড়তি টাকা দিয়ে দেন এবং সে যদি বুঝতে পারে, এ টাকাটার হিসাব-নিকাশে একটু ঝামেলা রয়েছে- কোমল সেই ব্রেইন বিপথে যাবেই। যারা গাড়ি থেকে টাকা তুলছে, তারা সবাই রসিদ নিচ্ছে না, কিংবা তারা দিতেও পারছেন না। ফলে কেউ চাইলেই এখানে কিছু টাকা এদিক-সেদিক করে ফেলতে পারে। আমরা এমন স্বেচ্ছাসেবায় কেন যাব যেখানে স্কুলের ছেলেমেয়েদের মাথায় ভিন্ন চিন্তার জন্ম দিতে পারে? স্বেচ্ছাসেবা করতে ইচ্ছে করে? তাহলে শুক্রবারে ঢাকা শহরের ময়লা পরিষ্কার করো, নিজের বাড়ির সামনের রাস্তাটা পরিষ্কার করো, স্কুলে গিয়ে কিছু একটা পড়াও, লেকচার সিরিজ করো, কম্পিউটারে ভাল টিউটোরিয়াল বানিয়ে ছাড়ো, বাসার কাজের বুয়ার ছেলেমেয়েকে পড়াও, কিংবা কোথাও গিয়ে শারীরিক শ্রম দাও। টাকা তোলার মতো খারাপ বুদ্ধি তোমাদের মাথায় কে দিয়েছে? হাতে সময় থাকলে ঢাকার বাইরে যাও। সেখানে গিয়ে যেই জমিতে ফুলের চাষ হয় সেখানে গিয়ে গায়ে-গতরে এক বেলা পরিশ্রম করে সেই কৃষককে সাহায্য করো। ঢাকা শহরে অনেক পার্ক আছে যেগুলোর ভাল পরিচর্যা হয় না। সেই গাছগুলোকে যতœ করো, পানি দাও, ময়লা পরিষ্কার করে দাও। সেখানে অনেক মানুষ বসেন। তাদের পাশেই কেউ হয়ত প্রাকৃতিক কাজটি করে রেখেছে। সেটাকে বসার যোগ্য করো। ঢাকা শহরে অনেক লেক মরতে বসেছে। সেখানে ময়লার ঢিবি। সেগুলোকে পরিষ্কার করো। ঢাকা শহরের মেয়রদের বল, তাদের কাছে কাজের অভাব নেই, আইডিয়ারও অভাব নেই। দয়া করে আর টাকা তোলার মতো বাজে কাজ করতে এসো না। আর গরিবদের নাম ভাঙ্গিয়ে তো আরও না। যখন আমরা কোন সঙ্কটে পড়ব, তখন হাত পাততে রাস্তায় নামব। ততদিন রাস্তাটা পরিষ্কার রাখ। উল্টো ট্রাফিক জ্যাম তৈরি করছ কেন? তিন. ব্র্যাক (বাংলাদেশ রুরাল এ্যাডভান্সমেন্ট কমিটি) হলো বিশ্বের সবচেয়ে বড় এনজিও (বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা)। ‘তৃণমূল পর্যায়ের দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে সংগঠিত করে বৃহত্তর অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে তাদের ক্ষমতায়নের অঙ্গীকার নিয়ে এই সংস্থাটি কাজ করে যাচ্ছে। জনগোষ্ঠীভিত্তিক ব্র্যাকের বিভিন্ন উদ্ভাবনা যথা, ক্ষুদ্রঋণ, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, কৃষি, আইনসহায়তা, সামাজিক উদ্বুদ্ধকরণ, জীবিকা সংস্থান, অতিদরিদ্রদের সম্পদ হস্তান্তর, উদ্যোক্তা প্রশিক্ষণ প্রভৃতির মাধ্যমে সমাজের অধিকারবঞ্চিত প্রান্তিক জনগোষ্ঠী তাদের সুপ্ত সম্ভাবনা বিকাশের পথ খুঁজে পেয়েছে। ১৯৭২ সালে ব্র্যাক তার যাত্রা শুরু করে। বর্তমানে এর ১ লাখ ২০ হাজার কর্মী বিশ্বব্যাপী ১১টি দেশে ১৩৫ মিলিয়ন মানুষের জীবনসংগ্রামে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে।’ [সূত্র : ব্র্যাক ওয়েবসাইট] বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষ ব্র্যাককে নিয়ে গর্ব করে। কিন্তু আমি তা মনে করি না; ব্র্যাকসহ বাংলাদেশের সকল এনজিওর মূল ভিত্তি হলো দারিদ্র্য। ‘আমরা গরিব’- এই কথাটা আমরা ধনীদের কাছে নিত্যদিন বিক্রি করি। যে কারণে ইংল্যান্ডের রানী যখন আমাদের পুরস্কার দেন, আমরা মোমের মতো গলে যাই। ফিনল্যান্ডের রানী যখন আমাদের দেশে আসেন, আমাদের মাটি ধন্য হয়ে যায়। অথচ একটি বারের জন্য কেউ বলেন না, এই ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলো যতবেশি বড় হয়, আমরা ততবেশি দরিদ্র হই। এটা সরাসরি ইনভার্সলি প্রপোর্শনাল। দিস ইজ দ্য সিম্বল অব প্রভার্টি। ব্র্যাকের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো যত বড় হয়, সরকার তত ব্যর্থ হয়ে যায়। অর্থাৎ রাষ্ট্রের মানুষ দরিদ্রকে মোকাবেলা করতে ব্যর্থ। অনেকেই হয়ত ভাবতে পারেন, আমি সরাসরি ব্র্যাকের বিরুদ্ধে লিখতে বসেছি। বিষয়টি তা নয়। ব্র্যাক যেহেতু বিশ্বের সবচেয়ে বড় এনজিও (এবং সেই মাপে আমরা সবচেয়ে দরিদ্র রাষ্ট্র), তাই ব্র্যাকের নাম এসেছে। এখানে যত বেসরকারী উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান রয়েছে, তাদের সবার কার্যক্রমকেই বলছি। আমি তাদের কাজের সমালোচনা করার জন্য লিখতে বসিনি। আমি বলতে চাইছি, রাষ্ট্রের ততটা উন্নতি হয়নি বলেই তো এই প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রয়োজন রয়েছে এবং তারা আরও বড় হচ্ছে। বাংলাদেশ যখন পুরোপুরি একটি উন্নত দেশে পরিণত হবে, তখন কিন্তু আর এই বেসরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর ততটা প্রয়োজন হবে না। তারা অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়বে। চার. বাংলাদেশে প্রায় ৫০ লাখের ওপর শিশু-কিশোর স্কুলে লেখাপড়া করে। এই বিশাল গোষ্ঠীকে সঠিকভাবে লেখাপড়া করানোটা খুবই কঠিন একটি বিষয়। মুখে বললাম, আর কাজটি হয়ে গেল- তা কিন্তু নয়। এই পৃথিবীর অনেক দেশের মোট জনসংখ্যাও এত বেশি নয়। সেই হিসাবে, এই কঠিন বিষয়টি নিয়ে যারাই কাজ করতে যাবেন, তাদের হিমশিম খেতে হবে বৈকি। বাংলাদেশের লেখাপড়ার বড় যে ক্ষতি হয়েছে দুটি ক্ষেত্রে। প্রথমত, আমরা শিক্ষকদের যথেষ্ট সুযোগ-সুবিধা দিতে পারিনি। শিক্ষকদের সুবিধার কথা এলেই আমাদের দেশ গরিব, শিক্ষকতা একটি মহৎ পেশা, এই পেশায় না খেয়েই থাকা যায়, এই মহৎ পেশায় আবার টাকা-পয়সা কেন- ইত্যাদি বিষয়গুলো চলে আসে। তারা একটু বেশি কথা বললেই, কামানের গরম পানি খেতে হয়। আমরা করুণা করে সবাই প্রাইমারী শিক্ষকদের জন্য মায়া করি; নিজের শিক্ষককে পা ছুঁয়ে সালাম করি। কিন্তু তার জীবন যে আর চলছে না- তা আমরা কেউ দেখি না। কিন্তু আমরা সবাই প্রত্যাশা করি, আমাদের শিশু সুন্দর নাগরিক হয়ে গড়ে উঠবে। প্রহসন আর কাকে বলে! কিন্তু বাংলাদেশে আরও অনেক মহৎ পেশা আছে, যেগুলোতে এই বিষয়গুলো তো আসেই না, বরং সরকার যেমন আরও তেল ঢালে, তারা নিজেরা আরও বেশি সুবিধা নেয়ার জন্য প্রতিনিয়ত পাঁয়তারায় থাকেন। শিক্ষকরা সেটা পারেন না। কেউ কেউ টিউশনি করেন। তাতেও অনেক কথা শুনতে হয়। তাদের তো আর চুরি করার উপায় নেই। ফলে, ভাল শিক্ষককে আমরা এই পথে আর আনতে পারিনি। মফস্বলের কিছু শিক্ষকের সঙ্গে মাঝে মধ্যে বিভিন্ন জায়গায় দেখা হয়। তাদের মান এবং জ্ঞান দেখে আমার চোখে পানি চলে আসে। দ্বিতীয় যে খারাপ কাজটি হয়েছে তাহলো পরীক্ষার ফল। এত বেশি ছাত্রছাত্রী গোল্ডেন-এ পেতে শুরু করেছে যে, কোন্্টা যে ভাল তার আর বুঝার উপায় থাকল না। আর যদি বলেন যে, এই গোল্ডেন-এ পাওয়া সবাই সোনার টুকরা ছাত্রছাত্রী, তাহলে কাল থেকেই আমার লেখালেখি বন্ধ করে দিতে হবে। এরা তো মনে করছে, গোল্ডেন-এ পেয়ে এই দেশকে ধন্য করে দিয়েছে। কিন্তু তাদের বুঝার উপায় নেই, পৃথিবীর মান থেকে তারা কতটা দূরে অবস্থান করছে। আমি কাউকে চাকরি দেয়ার আগে প্রথমেই তার স্কুল এবং কলেজটি দেখি এবং তখনকার ফল দেখি। তারপর দেখি কোন বিশ্ববিদ্যালয়। কারণ, একটি স্কুল এবং কলেজই একজন ছাত্রছাত্রীর ভিত্তি তৈরির আসল জায়গা। এখন আর আপনি ওই ফল দেখে কিছুই বলতে পারবেন না; একদল মূর্খ আপনার সামনে বসে আছে। তাদের আবার পরীক্ষা নিয়ে বুঝতে হচ্ছে, তার যোগ্যতাটা কেমন। আগে একটা পিরামিড ছিল, যেখান থেকে আপনি বলতে পারতেন কারা উপরের দিকে, আর কারা মাঝারি। এখন কোন পিরামিড নেই। সবাই সমান; গাহি সাম্যের গান। শিক্ষা ব্যবস্থার যা বারোটা বাজানোর সেটা বাজিয়ে এখন ছুটির ঘণ্টা বাজাটা বাকি আছে। এই যখন অবস্থা, সেখানে এনজিওগুলো তো নতুন আরেকটি কার্যক্রম খুলে বসবে এটাই স্বাভাবিক। আমরা তো তাদের কার্যক্রমকে বড় করার জন্যই, বিদেশীদের কাছে হাত পাতার জন্যই এই ব্যবস্থা করেছি। আমরা মনে মনে সবাই গরিব থাকতে চাই। (কানাডাতে কিছু বাঙালী আছেন যারা ইচ্ছে করেই কাগজ-কলমে গরিব থাকেন। তখন সরকার থেকে ভাতা পান। চাকরি করলে ট্যাক্স দেয়ার পর যা হাতে থাকে, তার চেয়ে চাকরি না করে সরকারী ভাতা নিয়ে পাশাপাশি নগদে কোথাও কাজ করলে হাতে বেশি আসে। বোকা কানাডা সরকার!) বাংলাদেশটাকে গরিব রাখতে পারলে, সেই সাহায্য বন্ধ হয়ে যাবে। তাহলে তো হলো না! আমাদের এমন সব ফন্দি করতে হবে যেন দেশের মানুষ গরিব থাকে, অশিক্ষিত থাকে- তাতে সাদা চামড়াদের কাছে হাত পাততে সুবিধা। আমাদের হাত সবসময় গ্রহীতার হাত হিসেবে নিচেই থাকে। আমাদের হাত কখনই ওপরে উঠে আসে না। কারণ, আমরা কাউকে কিছু দিতে শিখিনি। হাত পাততেই আমাদের আনন্দ। পাঁচ আমাদের হাত পাততে হয় কেন? আমাদের আমেরিকার ধনী বিল গেটসের কাছে হাত পাততে হয় কেন? আমাদের দেশে কি বিল গেটসের মতো ধনী মানুষ নেই? বাংলাদেশে কি এন্ড্রু কার্নেগী, ওয়ারেন বাফেট, জর্জ সোরোস, জর্জ কাইজার, মার্ক জাকারবার্গ, ওয়ালটন পরিবার, মাইকেল ব্লুমবার্গ, পল এলেনের মতো মানুষ নেই। তাদের মতো এতো সম্পদ হয়ত এদের নেই, কিন্তু বাংলাদেশের সাপেক্ষে তুলনামূলক সম্পদ যে আছে, তাতে কি সন্দেহ আছে? কিন্তু কই, তারা তো দেশের শিক্ষাব্যবস্থার জন্য কোন পদক্ষেপ নেন না। গ্রামীণফোনের মতো কর্পোরেটগুলো তাদের নিজেদের নামের জন্য টিভিতে দেখায় সুদূর বান্দরবানে একটি স্কুলকে তারা সাহায্য করে। সাহায্য করে ১ টাকা, আর সেটা প্রচার করতে ব্যয় করে ১ লাখ টাকা। শিক্ষার প্রতি এটাই তো আমাদের কমিটমেন্ট! যে কারণে বিল গেটসের অনুদানের টাকা দিয়ে ব্র্যাকের কার্যক্রম পরিচালনা করতে হয়! অথচ বাংলাদেশে বর্তমানে এত বেশি ধনীর সংখ্যা পাওয়া যাবে, যারা কয়েক হাজার কোটি টাকার ওপর ধারণ করে আছেন। কই, কাউকে তো দেখি না, দেশের পুরো শিক্ষাব্যবস্থার জন্য কিছু করতে! তারা যেটা করেন, তা হলো প্রধানমন্ত্রীর নামে একটি কলেজ বানিয়ে তার জন্য বিশাল বিলবোর্ড প্রধানমন্ত্রীর অফিসের সামনের রাস্তায় লাগিয়ে রাখেন। মূল উদ্দেশ্য, প্রধানমন্ত্রীকে খুশি করা। অপরদিকে বর্তমানের শিক্ষামন্ত্রী আছেন সংখ্যা বাড়িয়ে বাহবা পেতে, আর তার সচিব আছেন পরবর্তী সময়ে মন্ত্রী হওয়ার খায়েশ নিয়ে। তিনি যা কিছুই করেন, চমক দেখানোর জন্য করেন; ভোটের জন্য করেন। মূল সমস্যাটা সমাধান করার জন্য কিছুই করেন না। মাঝখান দিয়ে সরকারের অনেক টাকা নষ্ট হয়, নিজেদের প্রচার হয়। শিক্ষা হলো একটি সুদূরপ্রসারী বিনিয়োগ। এত দ্রুত ফল পাওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু আমাদের যে এখনই ফল লাগবে! তাই কেউ ফুল বিক্রি করে স্কুল চালান, কেউ চালান বিল গেটসের টাকায়; কেউবা বিশ্বব্যাংকের প্রজেক্টের পয়সায়। আমি কেবল আশায় আশায় থাকি, কবে এই দেশের মানুষ নিজেদের পয়সায় নিজেদের সন্তানদের লেখাপড়া শেখাবে। বলতে কি পার নাদের আলী? ৪ ডিসেম্বর ২০১৫ লেখক : তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ এবং সম্পাদক, প্রিয়.কম ys@pri“o.com
×