ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

তথৈবচ শেয়ারবাজার

প্রকাশিত: ০৫:৪৭, ৬ ডিসেম্বর ২০১৫

তথৈবচ শেয়ারবাজার

পুঁজিবাজারকে ঘিরে বিনিয়োগকারীদের হতাশা প্রতিনিয়তই বাড়ছে। মুনাফার আশায় পুুঁজিবাজারে আসা বিনিয়োগকারীদের পোর্টফলিও বা পত্রকোষে লোকসানের পরিমাণ বাড়ছেই। কিন্তু তাদের এই আর্থিক ক্ষতি মেটাতে সংশ্লিষ্টদের উদ্যোগ চোখে পড়ছে খুব সামান্যই। পুরো পরিস্থিতিকে ব্যাখা করা যেতে পারে ‘রোম যখন পুড়ছিল নিরো বাঁশি বাজাচ্ছিল’ এই কথনের মাধ্যেমে। বাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভূমিকা নিরোর মতোই। একদিকে বাজারের সূচক কমছে, অন্যদিকে প্রধান বাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের কর্তাব্যক্তি, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এ্যান্ড একচেঞ্জ কমিশন, বাংলাদেশ ব্যাংক নিরোর মতো বাঁশি বাজাচ্ছে। মাঝখানে চাকরি জীবন শেষে পেনশনের টাকা, স্ত্রীর অলঙ্কার বিক্রির টাকা নিয়ে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করা অথবা নিয়মিত লাভের আশায় স্থায়ী আমানত ভেঙে বিও এ্যাকাউন্ট খোলা বিনিয়োগকারীদের অবস্থা শোচনীয়। এর মধ্যে মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে দেখা দিয়েছে মার্জিন ঋণধারী বিনিয়োগকারীদের অবস্থা। প্রতিনিয়ত মার্জিন ঋণের টাকা সমন্বয় করতেই তাদের দিন যাচ্ছে। ক্রমশ শোচনীয় এবং অমানবিক সময় পার করছেন তারা। কিন্তু এই অবস্থার শেষ কোথায়, তা কেউ বলতে পারছেন না। যদিও দুই পুঁজিবাজার ডিমিউচুয়ালাইজড করার সময় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ঘোষণা করেছিলেন পুঁজিবাজারের জন্য ওষুধ এনেছি। এখন থেকে আর বাজারে কেউ কারসাজি করতে পারবে না। কিন্তু কারসাজি কমেনি। উল্টো স্বল্প মূলধনী কিছু কোম্পানিকে ঘিরে আরও জমেছে কারসাজির প্রক্রিয়া। আগের মতোই এখনও বাজারে মূল্য সংবেদনশীল তথ্যকে ঘিরে রমরমা ব্যবস্থা। তাদের থামানোর কেউ নেই। যদিও তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল একাধিকবার। কিন্তু তা খুব বেশি কাজে আসেনি। নিয়ন্ত্রক সংস্থার দায় কতটুকু? বাজারের টানা পতন এবং বিনিয়োগকারীদের লোকসানের পাল্লা ভারি করতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এ্যান্ড কমিশন কোনভাবেই দায় এড়াতে পারে না। কারণ পুঁজিবাজারে তারাই অভিভাবক। ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক একচেঞ্জ শুধু শেয়ার কেনা-বেচার আদেশ পালন ও কিছু আনুষঙ্গিক দায়িত্ব পালন করে থাকে। কিন্তু নতুন শেয়ার বাজারে আনাসহ মনিটরিং এবং বিধিনিষেধ ঠিকমতো পালিত হচ্ছে কিনা তা, খতিয়ে দেখার দায়িত্ব বিএসইসিয়ের। কিন্তু বর্তমান বিএসইসি আগের তুলনায় অনেক বেশি কাজ করলেও, বাজারে স্থিতিশীলতা ধরে রাখতে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারেনি। নিয়ন্ত্রক সংস্থার কোন ধরনের চাহিদা না থাকলেও, গত দু’বছরে প্রায় ত্রিশটি কোম্পানিকে শেয়ারবাজারে নতুন করে তালিকাভুক্তির অনুমোদন দিয়েছে। এর মধ্যে উচ্চ প্রিমিয়াম নিয়ে নামমাত্র কোম্পানিকেও তালিকাভুক্তির সুযোগ করে দেয়া হয়েছে। যেগুলোর দর এখন খুবই নাজুক। যেখানে বাজারে প্রতিনিয়তই দর কমছে, সেখানে নতুন করে শেয়ার অনুমোদন দিয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থা কোনভাবেই পরিপক্কতার পরিচয় দিতে পারেনি। এর বিপরীতে বস্তাপচা কিছু কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ বাজার থেকে টাকা তুলে নিয়ে গেছে। এর দায় কোনভাবেই বিএসইসির সংশ্লিষ্ট বিভাগ এড়াতে পারে না। এ কারণে বিনিয়োগকারীদের একটি অংশ মানববন্ধনে দাঁড়িয়ে বিএসইসির কর্মকর্তাদের দোষারোপ করেন। একইসঙ্গে তারা বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নরকেও দু’কথা বলতে ছাড়েন না। কারণ ২০১০ সালের আগে কয়েকটি ব্যাংক বাজারে অতিরিক্ত বিনিয়োগ করে বাবল তৈরি করেছিল। তাই ধসের কারণে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের তুলনায় প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী হিসেবে ব্যাংকের দিকেই আগে আঙ্গুল তুলছে তারা। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নর এই বিষয়টি বরাবরই এড়িয়ে গেছেন। তবে ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধনের মাধ্যমে এখন বিনিয়োগ একটি নির্দিষ্ট সীমায় নামিয়ে আনা হয়েছে। এই সিদ্ধান্ত নিতেও ব্যাংক বাজার সংশ্লিষ্টসহ অন্যদের সঙ্গে আলোচনারও তাগিদ বোধ করেনি। বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এ্যান্ড একচেঞ্জ কমিশন ২০১৪ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ৩১ কোটি কোম্পানিকে বাজার থেকে মূলধন উত্তোলনের অনুমোদন দিয়েছে। ফলে উভয়বাজারে যোগ হয়েছে ৮৪ কোটি নতুন শেয়ার। কিন্তু সেই হারে নতুন টাকা বাজারে আসেনি। উল্টো কোম্পানির পরিচালকরা ঘোষণা দিয়ে বোনাস শেয়ার বিক্রি করে টাকা তুলে নিয়ে গেছে। সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় ও বাজারের গতি ফিরিয়ে আনতে সম্প্রতি বিএসইসির নিয়মিত সভায় বিনিয়োগকারীদের সুবিধার্থে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হয়। এর মধ্যে অন্যতম হলো তালিকাভুক্তির পর প্রথম দুই বছর উদ্যোক্তা-পরিচালক ও ৫ শতাংশের বেশি শেয়ারধারীদের বোনাস শেয়ার বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ সিদ্ধান্ত সাধারণ বিনিয়োগকারী ও বাজারের জন্য ইতিবাচক ফল বয়ে আনবে। এছাড়া ঋণাত্মক ইক্যুইটির কারণে মার্জিনধারীদের বিও হিসাবে শেয়ার কেনাবেচার সুযোগ অব্যাহত রাখতে মার্জিন ঋণ বিধির আপাত স্থগিতাদেশের মেয়াদও এক বছর বাড়িয়েছে, যা সেকেন্ডারি বাজারের জন্য ইতিবাচক বলে মনে করছেন বিনিয়োগকারী ও বিশ্লেষকরা। পাশাপাশি মার্চেন্ট ব্যাংক ও ব্রোকারেজ হাউসের নিজস্ব ও গ্রাহকের পোর্টফোলিওতে পুনর্মূল্যায়নজনিত ক্ষতির বিপরীতে সঞ্চিতি রাখার মেয়াদও আরও এক বছর বাড়িয়েছে বিএসইসি। অন্যদিকে, দীর্ঘদিন ঝুলে থাকা মামলা নিষ্পত্তিতে জেলা ও দায়রা জজ হুমায়ন কবীরকে বিচারক হিসেবে নিয়োগ দিয়ে গত জুন মাসে বাংলাদেশ হাউস বিল্ডিংয়ে পুঁজিবাজার বিষয়ক বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছে। ইতোমধ্যে পাঁচটি মামলার রায়ও ঘোষণা করেছেন বিচারক। সম্প্রতি সাবিনকোর মামলায় কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক কুতুবউদ্দিনকে খালাসের আদেশ দিয়েছে আদালত। গত জুনে কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর এটি ট্রাইব্যুনালের পঞ্চম রায়। এর মধ্যে দুটি মামলায় আসামিরা বেকসুর খালাস পেয়েছেন। এর আগে অক্টোবর মাসে প্লেসমেন্ট শেয়ার কেলেঙ্কারি মামলার আসামি সাত্তারুজ্জামান শামীম বেকসুর খালাস পেয়েছিলেন। এছাড়া টিকে গ্রুপ ও র‌্যাঙ্কস গ্রুপের মামলা বিচারাধীন রয়েছে। তবে ডিএসইর সাবেক সভাপতি রকিবুর রহমানের চট্টগ্রাম সিমেন্ট কারখানার মামলাটি উচ্চাদালতের নির্দেশে স্থগিত রয়েছে। বিগত এক মাস ধরে শেয়ার বাজারের প্রধান সূচকটি ৪ হাজার ৪শ’ পয়েন্ট থেকে ৪ হাজার ৬শ’ পয়েন্টের মধ্যে ঘোরাঘুরি করেছে। লেনদেনও গড়ে চার শ’ কোটি টাকার কাছাকাছি রয়েছে। আর পুরো বাজারের মূল্য আয় অনুপাত বা পিইও রেশিও রয়েছে ১৫ দশমিক ৮৭ শতাংশ। আমাদের অর্থনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে এই পিইও রেশিও ২৫ ভাগ পর্যন্ত বাড়তে পারে। এর অর্থ এখনও পুঁজিবাজার বিনিয়োগযোগ্য। কিন্তু তারপরও বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরছে না। এজন্য সরকার এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থার উচিত পুঁজিবাজার যে এখনও বিনিয়োগের উত্তম জায়গা সেটা বিনিয়োগকারীদের আশ্বস্ত করা। আর বিনিয়োগকারীদের উচিত হবে গুজবে নয়, বা কারো প্ররোচনায় নয়, কোম্পানির প্রোফাইল বা আর্থিক ভিত্তি দেখে শেয়ার কেনা।
×