ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

দুই বাংলার সম্পর্ক প্রশ্নে খোঁচা শাঁওলী মিত্রের

পারস্পরিক সম্মানের জায়গাটা এখনও গড়ে তোলা যায়নি

প্রকাশিত: ০৪:৫৯, ৬ ডিসেম্বর ২০১৫

পারস্পরিক সম্মানের জায়গাটা এখনও গড়ে তোলা যায়নি

মোরসালিন মিজান ॥ বয়স যথেষ্ট হয়েছে। কত? না, সে প্রশ্ন করা হলো না। দেখতে তরুণী লাগছিল। সেখানে তাকে রেখেই কথা বলার শুরু। কণ্ঠটাও মিষ্টি খুব। ততোধিক সতর্ক। যা বলেন, তা বলেন না। আবার বলেন যা, তার নাকি অন্য মানে! তবুও কথা এগোল। বিভিন্ন বিষয়ে নিজের বক্তব্য তুলে ধরলেন শাঁওলী মিত্র। তাঁর সবচেয়ে বড় পরিচয়- তিনি শম্ভু মিত্রের কন্যা। ভারতের কিংবদন্তি নাট্য ব্যক্তিত্ব আবৃত্তি শিল্পী ও চলচ্চিত্র অভিনেতা বাবার মেয়ে নয় শুধু, নিজেরও একাধিক পরিচিতি। বাংলাদেশে আমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলেন পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির সভাপতি হিসেবে। ফিরে যাওয়ার কয়েক ঘণ্টা আগে জনকণ্ঠের সঙ্গে আলাপচারিতা। প্রথম প্রশ্নটি শাঁওলী মিত্র নিজে করলেন। জানতে চাইলেন, কী বিষয়ে কথা হবে? বিষয় জানানো হলে সহাস্যে রাজি। সহজ শুরু করতেই জানতে চাওয়া, কতদিন পরে এলেন ঢাকায়? কেমন লাগছে? উত্তর থেকে বয়সটাও জানা হয়ে গেলে! বললেন, ন’বছর বয়সে, পূর্ব পাকিস্তান যখন ছিল তখন এখানে অভিনয় করতে এসছি। সেটা বোধহয় খুব কম লোকের অভিজ্ঞতা। ’৭৪ সালে আবার এসেছি অভিনয় করতে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নিতে এসেছি দু’বার। ’৯৬ সালে শেষ এসেছিলাম আমার নিজের নাটকে অভিনয় করার জন্য। তার পর এবার ১৯ বছর বাদে এলাম। বাংলা একাডেমির হীরক জয়ন্তী উপলক্ষে ঢাকায় আসা। এই একাডেমির অবদান সম্পর্কে কোন খোঁজ কি রাখা হয় আপনার? জবাবে বলেন, না। আসলে এখানকার একাডেমির কাজ সম্পর্কে অতো আসলে জানা নেই। তাহলে আকাদেমির আলোচনা হোক। পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির সঙ্গে কীভাবে যুক্ত হলেন? এর বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে একটু জানা যাক। শাঁওলী মিত্র কিছুটা অবাক করে দিয়েই বললেন, আকাদেমির সঙ্গে আমার যে অনেক দিনের পরিচয়- তা নয়। কোন সম্পর্কই ছিল না। কয়েক বছর আগে আকাদেমির পক্ষ থেকে রবীন্দ্র রচনাবলীর নতুন সংস্করণ প্রকাশের উদ্যোগ নেয়া হয়। কিন্তু সে সময় সরকার পরিবর্তন হলে কর্ম সমিতির সবাই পদত্যাগ করেন। এ অবস্থায় মুখ্য মন্ত্রী আমাকে ফোন করে বলেন, তুমি কি একটু দায়িত্বটা নেবে? রবীন্দ্রনাথ যেহেতু, প্রলোভন হয়। কর্মসমিতির প্রধান হিসেবে কাজ করা শুরু করি। পরে নানা কিছুর পর সভাপতির পদ গ্রহণ করতে বাধ্য হই। তো, এখন কেমন চলছে কাজ? জানতে চাইলে তিনি বলেন, এরই মাঝে রবীন্দ্র রচনাবলী ১২-১৩টা খ- হয়ে গেছে। নতুন সংস্করণে অনেক তথ্য যোগ করেছি আমরা। তথ্যগুলো অন্য রচনাবলীতে নেই। ভবিষ্যত এগুলো গবেষকদের গবেষণার কাজে আসবে। এখন চার ভাষার একটি অভিধান হচ্ছে। মহাভারত নিয়ে প্রজেক্ট হচ্ছে। আকাদেমি থেকে দুটো পত্রিকা প্রকাশ পায়। আকাদেমি পত্রিকা বলে যেটি চালু ছিল, আছে। এখন সেখানে শিল্প সাহিত্যের বিভিন্ন শাখা নিয়ে লেখা ছাপানো হয়। বাংলা বইয়ের দায়িত্বে আছেন কবি জয় গোস্বামী। আকাদেমির পক্ষ থেকে লিটল ম্যাগ মেলারও আয়োজন করা হয়। চারশ’র মতো স্টল থাকে সেখানে। এছাড়া আমরা সারাবছর অনুষ্ঠান করি। সাহিত্য পুরস্কার দিই। নতুন চালু করেছি, কবির সঙ্গে দেখা বা গল্পস্বল্প। এসব অনুষ্ঠানে কবি লেখকরা এলে, তাঁর জীবনের কথা বলেন। পাঠকের প্রশ্নের জবাব দেন। সময় বেশ বদলে গেছে। লোকে বই কম পড়ে। সামনে তো আরও খারাপ সময় আসতে পারে। এমন সময়ে আপনি আকাদেমির দায়িত্বে আছেন। যুদ্ধটা কেমন করতে হচ্ছে? তাঁর উত্তরÑ যুদ্ধতো বরাবরই করে আসছি। ভাল জিনিসের জন্যই যুদ্ধ করতে হয়। খারাপ জিনিসের জন্য করতে হয় না। আর আমরা ঠিক-ই করে নিয়েছি যে, আমরা করলে ভাল করে কাজটা করব। এটা যদি মাথায় নিয়ে কেউ এগোয়, যুদ্ধ করতেই হয়। তিনি যোগ করেন, এটা দেখেও আপ্লুত হই যে, রবীন্দ্র রচনাবলীর যে গ্রাহক, যারা আগ্রহ প্রকাশ করেন, যারা আলোচনা করেন, লেখেন, তাঁরা যে সবাই বয়স্ক তা নয় কিন্তু। অনেক অল্প বয়সী আছেন। তারা আগ্রহী। এরকম যদি কিছু থাকে। যদি ছড়িয়ে যায়। ভাল তো। খারাপ হচ্ছে বলে থেমে গিয়ে সেটাকে আরও খারাপের দিকে ঠেলে দেব কেন? যতক্ষণ আমার ক্ষমতা থাকবে, চেষ্টা করব। ঢাকার বাংলা একাডেমি ও পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি দু’ প্রতিষ্ঠানই বাংলা নিয়ে কাজ করে। একসঙ্গেও কি কিছু কাজ করতে পারে না? এই প্রশ্ন মাঝে মাঝে ওঠে বৈকি। এ প্রসঙ্গে শাঁওলীও আগ্রহ দেখান। তবে কণ্ঠ কিছুটা শুকনো মনে হয়। বলেন, দু’টো রাষ্ট্র আলাদা। আইনগত অসুবিধা থাকতে পারে, আমি ঠিক জানি না। কারণ, বাংলা একাডেমির আমন্ত্রণে এখানে আসার জন্য ভিসা পেতেই অনেক ঝামেলা হয়েছে। সেরকম হয়ত হতে পারে কিছু ঘটনা। তাছাড়া পরিকল্পনারও অভাব আছে। দুই বাংলার মানুষের মধ্যে অতোটা যাতায়াত নেই। তার পর যা বলেন তাতে অভিযোগের সুর। মিষ্টি খোঁচা। কী যেন ইঙ্গিত করে আকাদেমি সভাপতি বলেন, দুই বাংলার মধ্যে বন্ধুত্ব যতটা গাঢ় হলে এবং পারস্পরিক যেটুকু সম্মান থাকলে সম্পর্কটা গড়ে ওঠে, সেটি এখনও হয়নি। পারস্পরিক সম্মানের জায়গাটা এখনও গড়ে তোলার আছে বলে মনে হয়েছে। তিনি জোর দিয়ে বলেন, বিশেষ করে এবার এসে মনে হয়েছে, পারস্পরিক সম্মানের জায়গাটা আরও গড়ে তোলবার আছে। তাঁর আরও কোন কোন কথায় খোঁচাটা টের পাওয়া যায়। কলকাতায় ইংরেজীর খুব দাপট। প্রচুর কথা হয় বাংলার মিশেলে। শাঁওলী মিত্র এই প্রবণতা থেকে যৌক্তিক কারণ খুঁজে নেন। বলেন, আমাদের ওখানে একাধিক ভাষা। হরেক সংস্কৃতি। ফলে ওটা কিছুটা মানা যায়। এর পর ঢাকার দিকে আঙুল তুলেন। বলেন, এখানেও তো ইংরেজী মিশিয়ে বাংলা বলা হয়। এখানে এটা বড় সমস্যা। আরও একটু বুঝিয়ে দিতেই যেন বলেন, সেদিন যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা দিয়ে হেঁটে এগোচ্ছিলাম তখন ওই পথ দিয়েই হিন্দি সিনেমার গান বাজাতে বাজাতে মুখে আবীর মেখে কিছু ছাত্রছাত্রী যাচ্ছিল। আমি খুব ভীত হলাম দেখে। ঢাকা শহর, যেখানে মানুষ বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছে। সেই প্রাণ দেয়াকে কেন্দ্র করে বাংলা একাডেমি হয়েছে। যারা এখানে সাহিত্য সেবা করে গেছেন আমরা তাঁদের কবরে ফুল দিতে যাচ্ছিলাম। আর ওরা কিনা হিন্দি গানের সঙ্গে নৃত্য করতে করতে যাচ্ছে! কী ধরনের নৃত্য সে আর নাই বলি। তিনি এ পর্যায়ে বলেন, এবার যদি একটা ইংরেজী শব্দ ব্যবহার করি তাহলে বলব, শকিং। এরও আগে অবশ্য একটি ইংরেজী শব্দ তাঁর কথায় ঢুকে যায়। তিনি ‘প্রজেক্ট’ শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। এ পর্যায়ে হয়ত ভুলে যান! এর পর আলোচনার অনিবার্য প্রসঙ্গ হয়ে আসে থিয়েটার। শাঁওলী মিত্রের শেকড় বলা চলে একে। কিন্তু প্রসঙ্গটি নিয়ে আলোচনা শুরু করা যাচ্ছিল না। হঠাৎই বাধা হয়ে দাঁড়ান হোটেল কক্ষে আগে থেকে বসে থাকা দুই ব্যক্তি। তাঁরা কথা শেষ করার তাগাদা দিতে থাকেন। একজন আলোচনা অন্য দিকে নিয়ে যান। বলতে থাকেন, সব ভাল শুধু বাংলাদেশে হয়। কলকাতায় কিচ্ছু হয় না। কলকাতা থেকে এসে কিছু লোক এসব বলে দিয়ে যান। আপনারা তাই শুনে গদ গদ হয়ে যান। কী হচ্ছেটা কী বাংলাদেশে? বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান মাস্তানির মতো করে ১৪ এপ্রিলকে পহেলা বৈশাখ করেছেন অভিযোগ করেন ওই ব্যক্তি। পশ্চিমবঙ্গের পঞ্জিকা অনুসরণ না করার সমালোচনা করেন তিনি। কিন্তু এসব বিষয়ে শাঁওলী মিত্রের মত কী? না, তা জানা যায়নি। তিনি নীরব থাকেন। কখনও মনে হয়েছে, এটা সম্মতি। তাহলে সমাধানের উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। সেটা কি নেয়া যায়? মনে মনেই করতে হলো প্রশ্নটি। তার পর থিয়েটারে ফেরা। শাঁওলী বলেন, নাটকের সঙ্গে আমি এখন যুক্ত না সেই অর্থে। পাঠ অভিনয় করি। পাঠ করব, তাও শুনতে আসছেন লোকে। রবীন্দ্রনাথের রাজা, ডাকঘর, চার অধ্যায়, রক্তকরবী থেকে পাঠ করি। নিজের লেখা থেকে পাঠ করি। তা-ই খুব আগ্রহ নিয়ে শুনতে আসেন লোকে। এ বড় ভাল লাগে। কলকাতার থিয়েটার প্রসঙ্গে বলেন, এখন অনেক নাটক হচ্ছে। অনেক নাট্যগোষ্ঠী হয়েছে। নানা ধরনের নাটক প্রযোজনা করছে। হাসির নাটক মজার নাটক হচ্ছে। সমাজকে জানবার মতো গুরুত্বপূর্ণ নাটকও হচ্ছে। অনেকক্ষণ ধরেই শম্ভু মিত্রে প্রবেশের ইচ্ছা ছিল। নাটকের আলোচনায় সে প্রসঙ্গ আনাও হলো। কিন্তু ফের বাধা। এবার একেবারে থামিয়েই ছাড়বেন হোটেল কক্ষের দুই ব্যক্তি। কাছে এগিয়ে এসে বললেন, শম্ভু মিত্র নিয়ে আবার কী কথা? শম্ভু মিত্র এক দু’ কথায় হয় নাকি? যান, যা হয়েছে, তাতেই শেষ করুন। ততক্ষণে শাঁওলী মিত্রও কিছুটা সরে বসলেন। কিংবা সরে বসতে হলো। কিন্তু যারা তাঁকে সরিয়ে দিলেন তারা কারা? অনেকেই জানতে চাইবেন। তাহলে বলা যাক, এই দুজনের অন্যতম বিপ্লব বালা। বাংলাদেশেরই লেখক!
×