ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ছেলেবেলা ও ছাত্রজীবন

প্রকাশিত: ০৩:৪৯, ৬ ডিসেম্বর ২০১৫

ছেলেবেলা ও ছাত্রজীবন

ঢাকায় ছাত্রজীবনের আরও কথা (৫ ডিসেম্বরের পর) তিনি বুঝে নেন যে, পূর্ববাংলার অধিবাসীরা পাকিস্তানের জন্য ব্যাপক ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত আছে। তার সম্বন্ধে বলা হয় যে, তিনি বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের ওপরে নজরদারি রাখতেন এবং তাদের সম্বন্ধে গুপ্ত প্রতিবেদন বা অভিমত কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের কাছে প্রেরণ করতেন। তার সঙ্গে আমি যখন কেন্দ্রীয় সরকারে ছিলাম তখন কিছুদিন কাজ করার সুযোগ হয়। তার চরিত্রই ছিল অন্যান্য কর্মকর্তা এবং বিশেষ করে বাঙালী কর্মকর্তাদের থেকে দূরত্ব বজায় রাখা। তিনি হুকুম দিতে পছন্দ করতেন। হুকুমের পুনর্বিবেচনা পারতপক্ষে করতেন না। তাকে অনেকেই বাঙালীদের প্রতি পাকিস্তানীদের বৈষম্যমূলক আচরণের অন্যতম হোতা বলে মনে করেন। তিনি শক্ত হাতে পূর্ববাংলার প্রশাসন এবং রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করেছেন বলে কেন্দ্রীয় সরকারে তাকে পুরস্কৃত করা হয়। পাকিস্তানে প্রথম যখন সামরিক শাসন জারি হয় তখন সামরিক প্রশাসক জেনারেল আইয়ুব খান তাকে উপ-সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে ঘোষণা করেন। হাফেজ ইসহাক একেবারেই বিপরীত প্রকৃতির লোক ছিলেন। ১৯৫৩ সালে ২১ ফেব্রুয়ারির কিছুদিন আগেই তিনি সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির সঙ্গে বৈঠক করেন এবং সংগ্রাম পরিষদের কার্যক্রম সম্বন্ধে একটি সমঝোতায় পৌঁছেন। তার সঙ্গে সংগ্রাম পরিষদের যে সমঝোতা হয় তার একটি সিদ্ধান্ত ছিল যে, মেডিক্যাল কলেজের নিকটস্থ শহীদ বেদীতে শ্রদ্ধা নিবেদন, ফুলের তোড়া প্রদান ইত্যাদি নির্বিঘেœ হতে পারবে বলে ঢাকার অন্য কোথাও কোন শহীদ মিনার নির্মাণ করা যাবে না। সভা, শোভাযাত্রা এগুলোয় পুলিশ কোন রকম বাধা দেবে না এবং পারতপক্ষে ছাত্র বা জনসমাবেশের কাছে থাকবে না। এই সমঝোতাটি সেই বছর ভালভাবে পালন করা হয়। আমরা খালি পায়ে আজিমপুর গোরস্তান থেকে ভোরে শহীদ মিনারে সমবেত হতে থাকি। সেখানে এবং আরও নানা জায়গায় সভা-সমিতি হয়। শহরের বিভিন্ন এলাকায় শোভাযাত্রা হয়। মোটামুটিভাবে ২১ ফেব্রুয়ারি শোক ও বিক্ষোভ দিবস হিসেবে প্রতিপালিত হয়। তবে একটি জায়গায় কিছুটা গোলমাল হয়। ঢাকা কলেজের ছাত্র নেতৃত্ব ইডেন কলেজের ছাত্রীদের সহযোগিতায় একটি শহীদ মিনার ঢাকা কলেজে নির্মাণ করেন। সেই শহীদ মিনারটি নির্মাণে পুলিশ বাধা দেয় এবং কলেজ কর্তৃপক্ষ কতিপয় নেতৃস্থানীয় ছাত্রকে কলেজ থেকে বহিষ্কার করে। বর্তমানে বিরোধী দলের নেতৃস্থানীয় ইনাম আহমেদ চৌধুরী এবং শাহ মোয়াজ্জেম ঢাকা কলেজের যেসব ছাত্র বহিষ্কৃত হন তাদের মধ্যে ছিলেন। বহিষ্কারাদেশ নাকচ করার জন্য তারা কেন্দ্রীয় সংগ্রাম পরিষদের উপরে ব্যাপক চাপ সৃষ্টি করেন। তাদের সমস্যার সমাধানে কিছু সময় লাগে। হাফেজ ইসহাকের সুচিন্তিত বিবেচনার ফলেই কয়েক মাস পর যখন বিষয়টি প্রায় বিস্মৃত হয়ে গেছে তখন তাদের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করা হয়। ছাত্রমহলে আর একটি দুঃখজনক ঘটনা ঘটে ২৭ ফেব্রুয়ারি কার্জন হলে। সেখানে ইতিহাস সম্মেলনে সুলেমান নাদভী নামে একজন আলেম বাংলা সম্বন্ধে কিছু বিরূপ বক্তব্য রাখেন। এই বক্তব্যে যথাযথ ভাষা ইতিহাস সম্বন্ধে তার অজ্ঞতার পরিচয় পাওয়া যায়। ইতিহাস সম্মেলনে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপস্থাপন করা এবং ছাত্রমহলে শান্তি বজায় রাখার বিষয়ে অনুষ্ঠানের আয়োজকরা আমাকে বিশেষভাবে দায়িত্ব দেন। তাই সুলেমান নাদভীর বক্তব্যে সৃষ্ট বিক্ষোভ নিয়ে আমাকে বেশ বিপদে পড়তে হয়। সুলেমান নাদভীর কাছ থেকে অনেক কষ্টে একটি অনুশোচনামূলক বিবৃতি আদায় করতে আমি সক্ষম হই। কিন্তু সরাসরি ক্ষমা চাইতে তিনি বিরত থাকেন। ইতিহাস সম্মেলনে বিক্ষোভ প্রদর্শন রোধে আমি সফল হলেও এ নিয়ে সংবাদ মাধ্যমে বিতর্ক দু’একদিন চলে এবং আমাকে বিভিন্ন জায়গায় নানাভাবে জবাবদিহি করতে হয়। এ বছর কিন্তু ২১ ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে সরকারী দমননীতি হাফেজ ইসহাকের কল্যাণে কার্যকরী ছিল না। হাসান হাফিজুর রহমানের ২১ সঙ্কলন এই বছরই প্রকাশিত হয়। এই সঙ্কলন প্রকাশের একটি কাহিনী রয়েছে। গোপনে গোপনে এই প্রকাশনা ছাপার ব্যবস্থা হয় এবং হাসান হাফিজুর রহমান বাড়িতে গিয়ে পৈত্রিক কিছু জমি বিক্রি করে বইটি প্রকাশ করার খরচ নির্বাহ করেন। ২১ ফেব্রুয়ারি ভালভাবেই অনুষ্ঠিত হলো। কিন্তু মার্চ-এপ্রিল তেমন ভাল কাটেনি। মার্চ মাসের একমাত্র ভাল খবর ছিল যে, হাসান হাফিজুর রহমানের একুশে সঙ্কলন এ মাসে প্রকাশিত হয়। কিন্তু মার্চ মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি করা চলবে না বলে একটি নির্দেশ জারি হয়। আর এপ্রিল মাসেই আসল ঢাকা কলেজের ছাত্রদের বহিষ্কারাদেশ। এ নিয়ে আবার বিক্ষোভ এবং আন্দোলন শুরু হলো। সে সময় বিভিন্ন ছাত্র ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার করা হলো। আমার সলিমুল্লাহ হল ইউনিয়নের সহ-সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক দু’জনই কারাবন্দী হন। যাই হোক, এপ্রিল থেকে জুলাই পর্যন্ত লেখাপড়া ব্যাপকভাবে বিঘিœত হলো এবং অবশেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কালা-কানুন প্রত্যাহার করা হলো। ঢাকা কলেজ থেকে বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহৃত হলো। তবে ছাত্রনেতাদের আরও বেশ কিছুদিন জেলে থাকতে হলো। রাজনৈতিক অঙ্গনে জানুয়ারি মাসে দিনাজপুরের কৃষক নেতা হাজী মোঃ দানেশ, সিলেটের প্রগতিশীল নেতা এবং নওবেলাল সাপ্তাহিকের প্রকাশক মাহমুদ আলী গণতন্ত্রী দল নামে একটি বাম রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করলেন। এই দলটি কোনদিনই জনপ্রিয়তা অর্জন করতে সক্ষম হয়নি। পশ্চিম পাকিস্তানে এই সময়ই রাজনৈতিক কোন্দল লাহোরে এক মহাকা- বাধিয়ে বসল। ৩ থেকে ৭ মার্চ পর্যন্ত লাহোরে কোন আইনশৃঙ্খলা ছিল না এবং কাদিয়ানীদের অমুসলমান ঘোষণা করার জন্য দাঙ্গা বাধে। অবস্থা মোকাবেলা করতে কেন্দ্রীয় নাজিমুদ্দিন সরকার লাহোরে সামরিক শাসন জারি করে এবং জেনারেল আজম খানকে সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব প্রদান করে। চলবে...
×