ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

রায়হান আহমেদ তপাদার

প্রবাসে দেশীয় রাজনীতি

প্রকাশিত: ০৩:৪৯, ৬ ডিসেম্বর ২০১৫

প্রবাসে দেশীয় রাজনীতি

কোন দেশের স্বাধীনতার পর সে দেশের জনগণকে শিখতে হয় দেশপ্রেম, নাগরিক দায়িত্ব, মানবিক দায়িত্ব, আত্মনির্ভরশীলতা এবং বিবেকের ব্যবহার। আর আমাদের বাংলাদেশে শেখানো হয়েছে রাজনীতি। যেখানে বর্ণিত সব শব্দই প্রায় অনুপস্থিত। অনুপস্থিত বলেই বিদেশেও দলীয় রাজনৈতিক কর্মকা- থেকে আমরা রেহাই পাচ্ছি না। শুধু আমরা নই, সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দেশটাও কলঙ্কিত হচ্ছে। লন্ডনের মতো এত উন্নত দেশে থেকেও আমাদের অতিমাত্রায় দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদরা উন্নত রাজনীতির বদলে দেশীয় ও দলীয় অসুস্থ সংস্কৃতি ধরে রাখতে চান বা ধরে রেখেছেন। তাতে কেন জানি আমার খুব কষ্ট হয়। আর তাই তো আমার এই অনুরোধ। দেশের অসুস্থ রাজনীতির কথা আর কি বলব। এই অসুস্থ রাজনীতির অভিজ্ঞতা কমবেশি আমাদের সবারই আছে। সুতরাং আমাদের অতি উৎসাহী ও দেশদরদী প্রবাসী রাজনীতিবিদদের প্রতি আমার পরামর্শ থাকবে তারা রাজনীতি করবে ভাল কথা; কিন্তু তা যেন হয় দলীয় রাজনীতির উর্ধে এবং দেশ ও জাতির স্বার্থে। দেশের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা মনে না রেখে যেখানে আছেন সেখানকার রাজনৈতিক ভাল অভিজ্ঞতাগুলো যদি কাজে লাগাতে পারেন তবে দেশ ও জাতির অনেকটা উপকারে আসবে। তাছাড়া তারাও নিজেদের মধ্যে খুঁজে পাবেন রাজনৈতিক জীবনের সার্থকতা। আমরা সাধারণ জনগণ তাদের কাছ থেকে ভাল ও উন্নত রাজনীতি কি আশা করতে পারি না, যা দেশ ও জাতির কল্যাণে আসবে? আমরা সবাই গণতন্ত্রের পাগল। সবখানেই এই শব্দটা বার বার মহাগর্বে উচ্চারণ করি; কিন্তু আসলে আমরা কতটুকু পালন বা ভোগ করছি তাই জিজ্ঞাসা। আমার বিশ্বাস রাজনীতিবিদরা গণতন্ত্রের অর্থ ও ব্যাখ্যা খুব করেই জানেন এবং বুঝেন; কিন্তু খারাপ লাগে তখনই যখন দেখি তারা জেনেও না জানার ভান করে দলীয় স্বার্থে এটাকে বিসর্জন দেন। তাই তো বলতে হয়, দুঃখ যেখানে গভীর, ভাষা সেখানে নীরব। সকল প্রবাসী রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি বিনীত অনুরোধ, দয়া করে আমাকে ভুল বুঝবেন না। আমি একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে সকল প্রবাসী রাজনৈতিক দলের নেতা ও নেত্রী মহোদয়কে বলছি, আপনারা বিদেশে থেকে দেশের দলীয় অসুস্থ রাজনীতির সংস্কৃতি এখানে চালু করে আসছেন, তা বন্ধ করতে পারাটাই দেশপ্রেমের বিরাট একটা উদাহরণ হবে। আমরা কেন ভুলে যাই দল থেকে দেশ বড় আর দেশ থেকে জাতি বড়। কেন আমরা নিজের দেশকে অন্য দেশের কাছে ছোট করব। বাঙালীরা তো মাথা নত করতে জানে না, জানে শুধু উঁচু রাখতে আর তাই তো নাম বীর বাঙালী। তবে কি আমরা জেনেশুনে বিষ পান করছি শুধু কর্তাকে খুশি করার জন্য? দেশ ও জাতি এই রাজনীতিবিদদের কাছে ভাল কিছু আশা করা অন্যায় ও পাপ নয় তাও মনে রাখা একান্ত প্রয়োজন। একে অন্যের প্রতি রাজনৈতিক কাদা ছোড়াছুড়িতে আমাদের একটা স্বাধীন দেশ, কেন প্রবাসে এই অপমানের বোঝা সমগ্র জাতিকে সইতে হবে। বিদেশে জাতিকে ছোট করার বোঝা কে বইবে? মনে রাখা দরকার ভবিষ্যত প্রজন্ম আমাদের কাছ থেকে কী শিখছে এবং আমরা তাদের জন্য কী রেখে যাচ্ছি। তাই অন্তত তাদের স্বার্থে হলেও সঠিক রাজনীতির চর্চা একান্ত প্রয়োজন। শুধু তাই নয়, এটা আপনার-আমার সবার দায়িত্বও বটে। সবাই যদি যার যার বিবেকের কাছে জিজ্ঞাসা করি তহলে এসবের উত্তর পেয়ে যাব। অনেক সময় বৃহত্তর স্বার্থে ক্ষুদ্র স্বার্থ ত্যাগ করতে হয়। রাজনীতি করবো ভাল কথা, তবে এই রাজনীতি যেন দেশ ও জাতিকে ছোট না করে সে দায়িত্বটাও মাথায় রাখতে হবে। রাজনীতিবিদরা জ্ঞানী গুণী মানুষ তাই, তারাই ভাল জানবেন বা বুঝবেন দেশের রাজনৈতিক অবকাঠামো। রাজনৈতিক দলের কোন নেতা-নেত্রী বা মন্ত্রী পদমর্যাদার আসনে সমাসীন কোন ব্যক্তি লন্ডনে আসলেই যেন প্রতিবাদে প্রস্তুতিটা এক ধরনের ব্যাধি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমনকি প্রধানমন্ত্রী এবং বিরোধী দলীয় নেত্রী এলেও। শুধু প্রস্তুতিতেই সীমাবদ্ধ নয় অনেক সময় তা হাতাহাতির পর্যায়ও চলে যায়, যা সামাল দিতে লন্ডনের মেট্রোপলিটান পুলিশকে পর্যন্ত হিমশিম খেতে হয়। রাজনীতিকদের কেউ কেউ বেমালুম ভুলে যান কোথায় আছেন কি করছেন। এখানে যে কোন দলেরই নেতানেত্রী বা মন্ত্রী এখানে আসেন না কেন ওঁরা তো আমাদেরই সম্মানিত ব্যক্তিত্ব। ওদের সম্মান করা বা জানানো দেশ ও জাতিকে সম্মানিত করা। এটা কোন দলের একক স্বার্থ হতে পারে না। প্রতিবাদ গণতান্ত্রিক ভাষা হলেও তা যেন দেশকে ও জাতিকে ছোট করার পর্যায় না পড়ে। আপনাদের প্রতিবাদের ভাষা হতে পারে শালীনতাপূর্ণ। অথচ যেভাবে প্রতিবাদ করা হয় তা কোন রাজনৈতিক অভিধানে এমন প্রতিবাদের ভাষা আছে বলে আমার মনে হয় না এবং তা প্রবাসে। দলীয় বা ব্যক্তি স্বার্থে আমরা দেশ ও জাতিকে বিদেশীদের কাছে ছোট বা অপমান করা কিন্তু রাজনৈতিক দায়িত্ব নয়। কথায় আছে ‘জীবনে বড় হও, তবে কাউকে ছোট করে নয় ! জীবনে মন খুলে হাসো, তবে কাউকে কাঁদিয়ে নয় ! জীবনে জয়লাভ করো, তবে কাউকে ঠকিয়ে নয়।’ আরও মনে রাখতে হবে ‘মানুষের যতই বন্ধুবান্ধব কিংবা শুভাকাক্সক্ষী থাকুক না কেন, বেশির ভাগ সময় জীবনে বা দেশের কঠিনতম মুহূর্তগুলো তাঁদের একা একাই পার করতে হয়।’ জেনেশুনে রাজনীতিবিদরা যা করছেন এটার নাম কি দেশপ্রেম, এটার নাম কি জনসেবা? মানসিকতা বোঝাতে বিদেশের একটি দৃষ্টান্ত উল্লেখ করতে চাই, ইংল্যান্ডের ট্রেন কিংবা বাসে খুব ব্যস্ত সময়ে প্রচন্ড ভিড়ের মাঝেও মানুষগুলো এত সুন্দরভাবে দাঁড়িয়ে থাকে, কেউ কারও বিরক্তির কারণ হয় না। প্রায় এক যুগেরও বেশি সময় এমনটি দেখে দেখে অভ্যস্ত আমি। স্বপ্ন দেখি, কোন একদিন আমার দেশেও এমন পরিবেশ গড়ে উঠবে। কেননা, দিনকে দিন দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। মানুষের মনমানসিকতার পরিবর্তন আসছে। কিন্তু এসব যেন আশায় নিরাশা শুধুমাত্র রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে। আমাদের দেশে অপরাধীর শাস্তির উদাহরণ কম, তাই দিনকে দিন অপরাধ বাড়ছে তো বাড়ছেই। রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি বলতে হয় আপনারা সত্য এবং সঠিক রাজনীতি করলে দেশ ও জাতির উপকৃত হবে। একই সঙ্গে নিজের মধ্যেও খুঁজে পাবেন রাজনৈতিক জীবনের সার্থকতা। দলকে একমাত্র মুখ্য মনে না করে দেশকে ভাল বাসুন, দেশের মানুষকে ভাল বাসুন। দেশ ও জাতির স্বার্থে সত্য কথাগুলো তুলে ধরুন তবেই প্রবাসে নিজেদের মধ্যে খুঁজে পাবেন রাজনৈতিক জীবনের সার্থকতা। আর এতেই সবার মঙ্গল নিহিত। লেখক : শিক্ষাবিদ ও লন্ডন প্রবাসী
×