ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

কাঁটাতার আত্মার সম্পর্ক দু’ভাগ করতে পারে না ॥ বারিদবরণ ঘোষ

প্রকাশিত: ০৫:৩২, ৫ ডিসেম্বর ২০১৫

কাঁটাতার আত্মার সম্পর্ক দু’ভাগ করতে পারে না ॥ বারিদবরণ ঘোষ

মোরসালিন মিজান ॥ আরও অনেকের মতোই বললেন বারিদবরণ ঘোষ। তিনি কলকাতার বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ সভাপতি। লেখক ও গবেষক। এখন বাংলাদেশে। একান্ত আলাপে জনকণ্ঠকে বললেন, বাংলার কোন এপার ওপার হয় না। কাঁটা তার আছে, সে যতই থাকুক, প্রাণের টানে দুই বাংলা এক হয়ে যায়। এক হবেই। আর তাতেই বাংলা ও বাঙালীর উন্নতি। প্রসার। সমৃদ্ধি। এ বিবেচনায় বাংলা চর্চা ও গবেষণার অতি প্রাচীন প্রতিষ্ঠান বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষতের শাখা বাংলাদেশে ফের চালু করার চিন্তা করা হচ্ছে। শুক্রবার সকালে হোটেল কক্ষে বসে তাঁর কথা বলার সময় উঠে আসে আরও নানা প্রসঙ্গ। শুরুটা করেন বারিদবরণ ঘোষ নিজেই। বাংলাদেশ নিয়ে দারুণ আবেগ। আবেগটাই খোলাসা করেন প্রথম। বলেন, এখানে এলে, জানেন, অন্য দেশ মনে হয় না। মনে হয় না, ঘর ছেড়ে এসেছি। এ যেন নিজের দেশ। নিজের ঘর। প্রথমবার এসেছিলাম ২০১৩ সালে। সেবার সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে গিয়েছি। মুজিবের বাড়িতে গিয়েছি। অভিজ্ঞতা বলে বোঝাতে পরব না! এখনও বাংলাদেশে আসার জন্য পা বাড়িয়ে রাখি। এবার বাংলা একাডেমি আমন্ত্রণ জানাতেই চলে এসেছি। বাংলা একাডেমির অনেক কাজের প্রশংসা করেন তিনি। এরপর ফিরে যান নিজের প্রতিষ্ঠান পরিষতের আলোচনায়। বারিদবরণ বললেন, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষতের বয়স এখন ১২২ বছর। ইংরেজী ১৮৯৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। তখন রবীন্দ্রনাথ সাহিত্য ক্ষেত্রে সামনে রয়েছেন। পরবর্তীতে অনেক বড় বড় মানুষ একে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। এখানে বইয়ের বিপুল সংগ্রহ। বর্তমানে এ সংখ্যা তিন লক্ষ অতিক্রম করে গেছে। প্রতিদিনই বিখ্যাত বিখ্যাত মানুষেরা, যারা বেঁচে রয়েছেন, অঙ্গীকার করে যাচ্ছেন যে, তাঁদের মৃত্যুর পর বইয়ের সংগ্রহটা এখানে দান করা হবে। অনেক লোক যারা মারা গেছেন, পরিবারের লোকেরা তাঁদের সংগ্রহ দিয়ে যাচ্ছেন এখানে। জায়গা না থাকায় আমরা আপাতত এক মাস বই আদান-প্রদান বন্ধ রেখেছি। এ সময়ের মধ্যে নতুন জায়গা বের করে নিয়ে আরও অন্তত দেড় লাখ বই রাখার ব্যবস্থা করব। প্রতিষ্ঠানের সাম্প্রতিক প্রবণতা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখন সাহিত্যের বাইরেও নানা বিষয়ে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ আগ্রহ দেখাচ্ছে। পরিষৎ আগে পর্যন্ত সাহিত্যটুকুর মাঝে আটকে ছিল। এখন ঠিক তা নয়। খেলাধুলো, রাজনীতি, বিজ্ঞান, ললিতকলা সব বিষয় নিয়ে কাজ হচ্ছে। আমাদের চর্চার ক্ষেত্রটা অনেক বাড়িয়ে দিয়েছি, বলতে পারেন। আমরা নানা বিষয়ে আলোচনা চক্র করি। সেখানে সব শ্রোতাকে জায়গা দিতে পারি না। কিন্তু শুধু কি বুড়োরাই আসেন? নাকি সবাই? কলকাতার নতুন প্রজন্মকে কতটা টানে বাংলা? ছেলে মেয়েরা নাকি ইংরেজীতে ঝুঁকছে? এমন অভিযোগ খুব একটা মানতে নারাজ বারিদবরণ ঘোষ। বলেন, এখন পরিস্থিতি বদলাতে দেখছি। ইংরেজীর স্কুল হয়ত বেশি রমরমা কিন্তু বাংলার প্রতিও আগ্রহ কম নয়। আগ্রহ নিয়ে অনেকেই বাংলা পড়ছেন। বাংলার প্রতি যে বৈরাগ্য ছিল, ধীরে ধীরে তা কেটে যাচ্ছে। আমাদের এখানে প্রবীণ পাঠকরা পড়তে আসেন বটে। তেমনি আসেন তরুণ প্রজন্মের পাঠক। তাঁদের আগ্রহের বই পুস্তকও রাখার চেষ্টা করি আমরা। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষতে বাংলাদেশের পাঠক ও গবেষকরা নিয়মিত আসা-যাওয়া করেন জানিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশের পাঠকের সুবিধার্থে বইয়ের পাতা থেকে ফটোকপি করার সুযোগ দেয়া হয়। কেউ চাইলে ছবিও তুলে নিতে পারেন। এ প্রসঙ্গেই মনে পড়ে যায়, এক সময় বাংলাদেশে একাধিক শাখা ছিল বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষতের। আবার হতে পারে না? প্রশ্ন শেষ করার আগেই মুখ খোলেন বর্তমান সভাপতি। বলেন, অবশ্যই হতে পারে। হওয়া জরুরী। রংপুরে আমাদের সবচেয়ে বড় শাখাটি ছিল। আরও বেশ কয়েকটি জেলায় শাখা স্থাপন করা হয়েছিল। অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ হয়েছে বাংলাদেশের শাখাগুলো থেকে। কিন্তু নানা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গিয়েছে ভারতবর্ষ। এক পর্যায়ে পৃষ্ঠপোষকতার অভাবেই হয়ত শাখাগুলো আর কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে পারেনি। এখন আবারও সে চিন্তা করার সময় এসেছে। এ ব্যাপারে তাঁরা আগ্রহী বলেও জানান। বারিদবরণ ঘোষ মনে করেন, শিল্প সাহিত্য বিষয়ে দুই বাংলার মধ্যে সম্পর্ক আরও জোরদার হওয়া চাই। অনেক আগে থেকে সম্পর্কটি চলে আসছিল। মাঝখানে কিছুটা হ্রাস পায়। এখন আবার তা গতি পেয়েছে। আদান-প্রদান প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষতের প্রাণপুরুষ ছিলেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষার পঠন-পাঠন শুরু হয় তখন প্রথম অধ্যাপক ছিলেন তিনি। সংস্কৃতি পড়াতেন। একই প-িত নেপালের রাজদরবার থেকে একটি পুঁথি আবিষ্কার করেছিলেন। সে পুঁথিটিই হচ্ছে বাংলা ভাষার প্রথম পুঁথিÑচর্যাগীতি কোষ। আবিষ্কারের একশ বছর পূর্তি হবে এ বছর। সামনের বছরে এর ছাপার একশ বছর পূর্তি হবে। আমরা ঢাকার বাংলা একাডেমিকে প্রস্তাব দিয়েছি এ বিষয়ে একটি সেমিনার আয়োজন করার জন্য। আমরা সেখানে মূল পুঁথিটা কেমন ছিল তা দেখাতে চাই। আদি ভাষার চর্চা সম্পর্কে এর মাধ্যমে দেখানো যাবে। আরও বেশকিছু গবেষণা ও প্রকাশনার ক্ষেত্রে দুই দেশ একসঙ্গে কাজ করলে অনেক বেশি ফলপ্রসু হবে বলে মত দেন তিনি। সাহিত্যের হাত ধরেই আলোচনায় উঠে আসে রাজনীতি। ভারতে অনেক লেখক তাঁদের পুরস্কার ফিরিয়ে দিচ্ছেন। এভাবে চলমান অসহিষ্ণুতার প্রতিবাদ চলছে। প্রসঙ্গটি তুলে ধরে মন্তব্য চাওয়া হলে বারিদবরণ ঘোষ বলেন, অসহিষ্ণুতাটা এসে গেছে, স্বীকার করতেই হবে। এটা আসলে রাজনীতির খেলা। আমাদের দেশে কখনও টিকবে না। বড় প্রমাণ তো বিহার। এখানে সম্প্রতি যে বিধানসভা নির্বাচন হলো তাতে জয়ী হওয়ার বহু চেষ্টা করেছে কেন্দ্র সকার। কিন্তু সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। যে ভোটটা হলো, দেখা গেল, অসহিষ্ণুদের প্রত্যাখ্যান করেছে জনগণ। অসহিষ্ণুতা প্রদর্শনকারীরা ভোট পেয়েছে মাত্র ১৭ ভাগ। তার মানে, সবচেয়ে গোঁড়া বিহার কিংবা ঝাড়খ-ে জাত-পাতের রাজনীতি টেকেনি। ভারতে সরকারের পরিবর্তন ঘটেছে তাই এটা হচ্ছে। অসহিষ্ণুতা যারা দেখাচ্ছেন তারা তো বাবরি মসজিদ ধ্বংস করে সেখানে মন্দির করবেন বলেছিলেন। পরে তো একটা ইট নিয়ে সেখানে যাননি। সব আসলে রাজনীতি। ওটা তারা পারেননি। পারবেনও না। আর পশ্চিমবঙ্গের বেলায় তো গলা উঁচু করে, চিৎকার করে বলতে পারি, এখানে অসহিষ্ণুতার কোন স্থান নেই। আমার বয়স হয়েছে, অভিজ্ঞতা থেকে বলি, জোরের সঙ্গে বলি, পশ্চিমবঙ্গে হবে না। এর পর আবারও বাংলাদেশ প্রসঙ্গ। ঘুরে ফিরেই আসে। এখন বিজয়ের মাস ডিসেম্বর। স্মৃতি হাতড়ে তিনি বলেন, এ বিজয় তো আমাদেরও। যেদিনে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল সেদিন আমি ছিলাম বেনারসে। আমার মাস্টার মশাইয়ের বাড়ি গেছি। তাঁর সঙ্গে তাঁর স্ত্রীর কি নিয়ে যেন অভিমান করে আছেন। হঠাৎ মাস্টার মশাই নতুন কাগজ দেখিয়ে বললেন, একটা দেশ স্বাধীন হয়ে গেল আর তোমার ঝগড়াঝাটি করছ! এই যে একটা দেশ স্বাধীন হয়ে গেল কথাটা সত্যি ভুলবার মতো নয়। বাংলাদেশকে আমার নিজের দেশের মতোই মনে হয়। বারিদবরণ পুনর্বার দুঃখ করেনÑ আমার বলতে খুব খারাপ লাগে, এপার বাংলা ওপার বাংলা। শুধু কাঁটাতার আত্মার সম্পর্ককে দুই ভাগ করতে পারে না। মনের দিক থেকে আমাদের কতটা মিল, এখানে এলে অনুভব করতে পারি। প্রাণের যেখানে চাহিদা আছে, ভিসা পাসপোর্ট সেখানে কিছু আটকাতে পারে না। প্রসঙ্গত, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সভাপতি বারিদবরণ ঘোষ একজন খ্যাতনামা লেখক। নানা বিষয়ে নিয়মিত লেখেন। জন্ম ১৫ জুন, ১৯৩৯ সালে। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ করেছেন। অর্জন করেছেন পিএইচ-ডি ও ডি লিট উপাধি। শ্রীগোপাল ব্যানার্জী কলেজ ও বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছিলেন। তাঁর রচিত গ্রন্থের সংখা ৪৭। সম্পাদনা করেছেন ৯১টি গ্রন্থের। কেন্দ্রীয় সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি দফতরের বৃত্তি পেয়ে দুই খ-ে রচনা করেছেন ‘রবীন্দ্রনাথের সম্বর্ধনার ইতিবৃত্ত : দেশে ও বিদেশে’। অন্যান্য গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য চিত্রশিল্পী হেমেন মজুমদার, সাহিত্যসাধক শিবনাথ শাস্ত্রী, নিত্যানন্দ : বাংলার সমাজ ও সাহিত্যে এবং রহস্যাবৃত্ত ভাওয়াল সন্ন্যাসী। এছাড়াও নিয়মিত লেখালেখি করেন পশ্চিমবঙ্গের সব প্রথম শ্রেণীর পত্রপত্রিকাতে। বাংলা একাডেমির হীরক জয়ন্তীর অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ঢাকা এসেছেন তিনি।
×