ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

আমদানি এড়াতে আগামী বাজেটে বিশেষ প্রণোদনা দেবে সরকার

ভারতের কঠোর অবস্থানে দেশে গরু পাচার কমেছে ৭০ ভাগ

প্রকাশিত: ০৫:২৭, ৫ ডিসেম্বর ২০১৫

ভারতের কঠোর অবস্থানে দেশে গরু পাচার কমেছে ৭০ ভাগ

এম শাহজাহান ॥ সীমান্ত দিয়ে গরুপাচার পুরোপুরি বন্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে ভারত। এতে করে গত কয়েক মাসে বাংলাদেশে গরু আমদানির পরিমাণ কমেছে প্রায় ৭০ ভাগ। ফলে অভ্যন্তরীণ মার্কেটে বেড়েছে গরুর মাংসের দামও। সীমান্ত পাড়ি দিয়ে গরু আনতে গিয়ে গুলিতে মারা পড়ছেন সাধারণ ব্যবসায়ীরা। এই বাস্তবতায় চাহিদা পূরণে দেশে গরুসহ অন্যান্য পশুপালন ও উৎপাদন বাড়ানোর পরিকল্পনা গ্রহণ করা হচ্ছে। ভবিষ্যতে চালের মতো যাতে আর গরুও আমদানি করতে না হয় সেজন্য আগামী বাজেটে বিশেষ প্রণোদনা ঘোষণা করবে সরকার। পশুপালন ও উৎপাদনে ২শ’ কোটি টাকার তহবিল গঠন করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে পোল্ট্রি মুরগি, ডিম, সবজি ও মাছের পাশাপাশি গরুর মাংস উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে বাংলাদেশ। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। জানা গেছে, গরুপাচার পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণের জন্য সম্প্রতি আবারও ভারতীয় সীমারক্ষী বাহিনীকে (বিএসএফ) নির্দেশ দিয়েছেন দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং। একই সঙ্গে গরুপাচার ৭০ শতাংশ কমে যাওয়ায় তিনি বিএসএফকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। ভারতের নয়াদিল্লীতে বিএসএফের ৫০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে সালাম গ্রহণ করে তিনি বলেন, বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে গরু চোরাচালান বন্ধে আপনারা যে অবদান রেখেছেন তার জন্য পুরো ভারতে আপনাদের সম্মান বেড়ে গেল। এভাবে চলতে থাকলে বিএসএফ গরুপাচার পুরোপুরি বন্ধ করতে পারবে। শুধু তাই নয়, সম্প্রতি ভারতীয় জাতীয় দৈনিক দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের খবরে বলা হয়েছে, গরুপাচার প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বাংলাদেশ মাংসের বাজার নিয়ে উদ্বিগ্ন। গরু ঢুকতে না পারলে বাংলাদেশের মাংসের বাজারে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে, আর্থিক অঙ্কে যার পরিমাণ প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা। জানা গেছে, গত নবেম্বর মাসে ঢাকায় অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ-ভারত স্বরাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠকেও গরুপাচারের বিষয়টি উঠে আসে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে স্বরাষ্ট্র সচিব মোঃ মোজাম্মেল হক খান ও ভারতের পক্ষ থেকে দেশটির কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র সচিব রাজীব মেহরিশি বৈঠকে অংশ নেন। এছাড়া বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সের (বিএসএফ) মহাপরিচালক ডিকে পাঠক ও সংস্থাটির উর্ধতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। ওই সময় গরুপাচার বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে ভারতের পক্ষ থেকে অনুরোধ করা হয়। আর বাংলাদেশ থেকে গরুপাচারের বিষয়ে কঠোর না হয়ে কিছুটা নমনীয় এবং গুলি করে কাউকে হত্যা না করার জন্য অনুরোধ করা হয়েছিল। কিন্তু রাজনাথ সিং গরুপাচার পুরোপুরি বন্ধে বিএসএফকে আবারও কঠোর হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। তবে ভারতের সরকারী হিসাবমতে, বিএসএফের কঠোর নজরদারি থাকায় বাংলাদেশে গরুপাচার হওয়ার হার ৭০ শতাংশ কমে গেছে। গত সেপ্টেম্বরে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং জানিয়েছিলেন, প্রতি বছর ২০ থেকে ২২ লাখ গবাদিপশু বাংলাদেশে পাচার হয়ে যায়, যা বর্তমানে দুই থেকে আড়াই লাখে নেমে এসেছে। তবে বিএসএফের একটি তথ্যমতে, গত ২০১৩ সালে বাংলাদেশে গরুপাচার হয়েছে ২২ লাখ। তবে গত ২০১৪-১৫ অর্থবছরে এই সংখ্যা ১৮ লাখ কমে গেছে। এছাড়া চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত মাত্র এক লাখ ১৯ হাজার গরু বাংলাদেশে পাচার হয়েছে। এই সংখ্যা জিরোতে নিয়ে আসার পরিকল্পনা রয়েছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর। পশুপালন ও গরু উৎপাদন বাড়ানোর পরিকল্পনা ॥ গরু-ছাগল-ভেড়ার উৎপাদন বাড়ানোর পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। এজন্য খামারিসহ গ্রামের গরিব, নিঃস্ব ও অসহায় মানুষদের গবাদিগশু পালনে আগ্রহী করে তুলতে প্রণোদনা দেয়ার উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার। সম্প্রতি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র সচিবালয়ে জানান, আমদানিনির্ভরতা কমাতে সরকার পশুপালন ও গরুর উৎপাদন বাড়াতে চায়। উৎপাদন বাড়ানোর মাধ্যমে নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে রফতানির চিন্তাভাবনা করছে সরকার। যেহেতু এ বছর কোরবানির সময় ভারত থেকে গরু আমদানি বন্ধ থাকার পরও পরিস্থিতি সামাল দেয়া গেছে, তাই গরু-ছাগল-ভেড়াসহ গবাদিপশুর উৎপাদন বাড়াতে শীঘ্রই ব্যবস্থা নেয়া হবে। তিনি বলেন, উৎপাদন বাড়ানোর পর ভারত যদি বাংলাদেশে গরু রফতানি করে তাহলে দেশের খামারিরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যাতে দেশটি থেকে আর গরু আমদানি না করা হয় এজন্য প্রধানমন্ত্রীসহ স্বরাষ্ট্র ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা করা হবে। এছাড়া আগামী বাজেটে গবাদি পশুপালন ও গরুর উৎপাদন বাড়াতে বাজেটে বিশেষ প্রণোদনা ঘোষণা করবে সরকার। এজন্য বিশেষ বরাদ্দও চাওয়া হবে। পশুপালন ও উৎপাদনে ২শ’ কোটি টাকার তহবিল গঠন ॥ বাণিজ্যিকভাবে গবাদি পশুপালনে সহজশর্তে ও কম সুদে ঋণের যোাগান দিতে আপাতত ২শ’ কোটি টাকার একটি পুনর্অর্থায়ন তহবিল গঠন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এই তহবিল থেকে গ্রাহকদের সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ সুদে ঋণ দেয়া হবে। ঋণের মেয়াদ হবে সর্বোচ্চ তিন বছর। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে একটি সার্কুলার বাণিজ্যিক ও বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের কাছে পাঠানো হয়েছে। এতে বলা হয়, দেশের বেকার যুবকদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি, পুষ্টির চাহিদা পূরণ, গুঁড়াদুধ ও দুগ্ধজাতীয় পণ্যের আমদানি চাহিদা কমিয়ে দেশীয়ভাবে চাহিদা মেটানোর লক্ষ্যে এই তহবিল গঠন করা হয়েছে। সার্কুলারে বলা হয়, এই তহবিল থেকে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ৫ শতাংশ সুদে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণ দেবে। তারা বিতরণ করা ঋণের ওপর সুদ ভর্তুকি বাবদ ৫ শতাংশ অর্থ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে দাবি করতে পারবে। তিন বছরের মধ্যে ঋণের আসল পরিশোধ করতে হবে এবং প্রতি বছর শেষে ঋণের সুদ পরিশোধ করতে হবে। ইতোমধ্যে ব্যাংকের পর্ষদ ওই তহবিল গঠনের প্রস্তাব অনুমোদন করেছে। এর আলোকে এই সার্কুলার জারি করা হয়েছে। এদিকে, এই খাতে ঋণপ্রবাহ বাড়াতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে আরও এক হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে সুদ ভর্তুকি বাবদ চাওয়া হয়েছে আরও ১০ কোটি টাকা। জানা গেছে, গাভী কেনা, গাভী লালন-পালন, গাভীর সঙ্করায়ন, দুধ প্রক্রিয়াজাতকরণ, দুগ্ধজাতীয় খাদ্যসামগ্রী উৎপাদন ও বিপণন খাতে এই তহবিল থেকে ঋণ দেয়া হবে। ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যে কোন পর্যায়েই ঋণ নেয়া যাবে। ঋণের বিপরীতে জামানত ও অন্য শর্তাবলী শিথিল থাকবে। প্রায় তিন কোটি গরু রয়েছে দেশে ॥ বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) গত জুনে প্রকাশিত এক জরিপ অনুযায়ী, সারাদেশে পরিবারভিত্তিক দুই কোটি ৮২ লাখ গরু লালন-পালন করা হয়। আর খামারে গরু রয়েছে চার লাখ ১১ হাজার। পরিবার ও খামার মিলিয়ে দেশে এখন দুই কোটি ৮৬ লাখ গরু রয়েছে। এরমধ্যে এক কোটি ৭৫ লাখ গাভী। এক দশকে হাঁস-মুরগির সংখ্যায় গড় প্রবৃদ্ধি হয়েছে বছরে ৩ দশমিক ৩ শতাংশ। এ প্রসঙ্গে প্রাণিসম্পদ অধিদফরের এক উর্ধতন কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে বলেন, একটি গরু দুই বছরে জবাই করার উপযোগী হয়। দেশে সবাই উদ্যোগী হয়ে গরু পালন করলে পাঁচ বছরে ঘাটতির অনেকাংশ পূরণ সম্ভব। কিন্তু সমস্যা হলো, বেসরকারী খাত এক্ষেত্রে এগিয়ে আসছে না।
×