ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

কোটি টাকার এ মিশনে অর্ধেক এসেছে বিদেশ থেকে

ত্রিশালে জঙ্গী ছিনতাইয়ে পাক-আফগান চক্র জড়িত

প্রকাশিত: ০৫:২৬, ৫ ডিসেম্বর ২০১৫

ত্রিশালে জঙ্গী ছিনতাইয়ে পাক-আফগান চক্র জড়িত

গাফফার খান চৌধুরী ॥ ময়মনসিংহের ত্রিশালে জেএমবির তিন দুর্ধর্ষ জঙ্গী ছিনতাইয়ের সঙ্গে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানেরও কিছু চক্র জড়িত। মিশন চালাতে ব্যয় হওয়া প্রায় কোটি টাকার অর্ধেকটারই যোগান এসেছে বিদেশী ওই চক্রগুলো থেকে। চক্রগুলোর সঙ্গে দেশ দুটির একাধিক জঙ্গী সংগঠনও জড়িত। ফান্ড গঠনের মূল কাজটি করেছে দেশ দুইটিতে জঙ্গী প্রশিক্ষণে থাকা বাংলাদেশের জেএমবি সদস্যরা। এর মধ্যে মূল ভূমিকায় ছিল কারাবন্দী জেএমবির আমির জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় শূরা কমিটির সাবেক সদস্য সাইদুর রহমানের দুই মেয়ের জামাই ইজাজ ও সাখাওয়াতুল কবির। ইজাজ বাংলাদেশে নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিম তৈরির অন্যতম নেপথ্য কারিগর। আর সাখাওয়াতুল কবির বাংলাদেশে আইএসের এজেন্ট হিসেবে কাজ করছিল। দুই জামাতা অর্থ যোগাড় করে সীমান্তপথে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ থাকা ভারতীয় মুজাহিদীনদের কাছে পাঠায়। ভারতীয় মুজাহিদীনরা সীমান্ত পথে হুন্ডির মাধ্যমে টাকাগুলো বাংলাদেশের জেএমবির কাছে পাঠায়। অর্থ গ্রহণকারী হিসেবে পলাতক জেএমবির একাংশের ভারপ্রাপ্ত আমির দাবিকারী ফারুকের কথা ওঠে এসেছে। বাদবাকি টাকার যোগান এসেছে যুদ্ধাপরাধীদের গঠিত একটি ইসলামী দলের কয়েকজন ব্যবসায়ী ও সদ্য ফাঁসি কার্যকর হওয়া একজন শীর্ষ ব্যবসায়ীর কাছ থেকে। মামলাটির তদন্ত সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। ঘটনাস্থল ॥ গত বছরের ২৩ ফেব্রুয়ারি সকাল সাড়ে ১০টায় ত্রিশালের সাইনবোর্ড এলাকায় জেএমবির মৃত্যুদ-প্রাপ্ত আসামি জঙ্গী সংগঠনটির শূরা সদস্য রাকিব ও সালেহীন এবং যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত বোমারু মিজানকে ছিনিয়ে নেয় জেএমবি সদস্যরা। ছিনতাইকৃত তিন জেএমবি সদস্যের পরিচিতি ॥ হাফেজ রাকিব হাসান ওরফে মাহমুদ ওরফে রাসেল (৩৫), পিতা- আব্দুস সোবহান, বাড়ি জামালপুর জেলার মেলান্দহ থানাধীন বেলতলা এলাকার বংশী গ্রামে। তিনি ২০০৬ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররম এলাকা থেকে গ্রেফতার হয়েছিলেন। অপরজন মোঃ সালেহীন ওরফে সালাউদ্দিন ওরফে তৌহিদ (৩২), পিতা-রফিকুল ইসলাম, বাড়ি নারায়ণগঞ্জ জেলার বন্দর থানাধীন এসএম সেন রোডের ৫৮ নম্বরে। তিনি ২০০৬ সালের ২৫ এপ্রিল চট্টগ্রামের সিডিএ এলাকা থেকে গ্রেফতার হয়েছিলেন। আরেকজন মোঃ জাহিদ হোসেন সুমন ওরফে বোমারু মিজান (৩০), পিতা- সুজা মিয়া (মৃত), বাড়ি জামালপুর জেলা সদরের শেখেরভিটা গ্রামে। তিনি মিরপুরের পীরেরবাগ থেকে ২০০৯ সালে গ্রেফতার হয়েছিলেন। জঙ্গী ছিনতাইয়ের ঘটনায় ত্রিশাল থানায় দায়েরকৃত মামলা বর্তমানে ঢাকার সিআইডি পুলিশ তদন্ত করছে। তদন্ত ও গ্রেফতারকৃতদের তথ্য ॥ সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, ছিনতাই মিশনে দুইটি গ্রুপ অংশ নেয়। অংশ গ্রহণকারীদের সবার পৃথক পৃথক ছদ্মনাম দেয়া হয়েছিল। এর মধ্যে একটি গ্রুপে থাকা ৫ জনসহ ত্রিশালের ঘটনায় এখন পর্যন্ত ২০ জন আটক হয়েছে। তার মধ্যে ৪ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে টিএফআই সেলে। স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী ॥ ছিনতাইয়ের ঘটনায় জামালপুর সদর জেলার রানাগাছার ময়েজ উদ্দিনের ছেলে জেএমবি সদস্য মাহফুজুল ইসলাম ওরফে শামীম ওরফে সুমন (৩৮) গত বছর ৩০ জুলাই সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল এলাকা থেকে গ্রেফতার হয়। পরবর্তীতে ত্রিশালের মামলায় আদালতে দায় স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে। ছিনতাইয়ের ঘটনায় সর্বশেষ গ্রেফতারকৃত জেএমবি সদস্য ॥ গত ২৫ নবেম্বর ডিবির হাতে হোসেনী দালানে বোমা হামলার ঘটনায় গ্রেফতারকৃত চাঁন মিয়া ত্রিশালের মামলার অন্যতম আসামি। তিনি জেএমবির সক্রিয় সদস্য ও চালক। ত্রিশালে জেএমবি সদস্য ছিনতাইয়ে যে প্রাইভেটকারটি ব্যবহার করা হয়েছিল, সেটির চালক ছিল গ্রেফতারকৃত চাঁন মিয়া। তাকে ত্রিশালের মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের প্রস্তুতি চলছে। আন্তর্জাতিক যোগাযোগ ॥ শীর্ষ দুই নেতাকে ছিনতাইয়ের বিষয়টি পাকিস্তানের একটি জঙ্গী প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে থাকা সাইদুর রহমানের মেয়ের জামাই ইজাজ ও সাখাওয়াতুল কবিরসহ পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে সব বাংলাদেশী জেএমবি সদস্যদের জানানো হয়। যেভাবে অর্থের যোগান আসে ॥ মিশন বাস্তবায়ন করতে আনুমানিক ব্যয় ধরা হয় প্রায় কোটি টাকা। প্রায় অর্ধেক টাকার যোগান আসে যুদ্ধাপরাধীদের গঠিত একটি ইসলামী দলের কয়েকজন এবং তাদের সহযোগী একটি বড় রাজনৈতিক দলের এক ব্যবসায়ীর সূত্র ধরে। সম্প্রতি যুদ্ধাপরাধের দায়ে রাজনৈতিক দলের ওই ব্যবসায়ীর ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। এদের টাকা থেকে প্রায় ৪২ লাখ টাকা দিয়ে একটি নোয়া মাইক্রোবাস ও একটি প্রাইভেটকার এবং অস্ত্রগোলাবারুদ কেনা হয়। যেভাবে বাংলাদেশে জেএমবির কাছে অর্থ আসে ॥ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ইজাজ, সাখাওয়াতুল কবিরসহ পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে জঙ্গী প্রশিক্ষণে থাকা জেএমবি সদস্যরা তাদের সমমনা দেশ দুইটির বিভিন্ন জঙ্গী সংগঠন ও একাধিক চক্রের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে। সেই অর্থ প্রথমে পাকিস্তান থেকে সীমান্তপথে বাংলাদেশের জেএমবির সঙ্গে যোগাযোগ থাকা ভারতীয় মুজাহিদীনদের কাছে পাঠানো হয়। ভারতীয় মুজাহিদীনরা সীমান্ত পথে হুন্ডির মাধ্যমে সেই অর্থ বাংলাদেশে থাকা জেএমবির সংশ্লিষ্টদের কাছে পাঠায়। মূল অপারেশন পরিচালনাকারী শনাক্ত ॥ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে মাঠপর্যায়ে থেকে দায়িত্ব পালন করে পলাতক ফারুক ওরফে আনোয়ার ওরফে সাখাওয়াত ওরফে ফারুক হোসেন। তার পিতার নাম হামিদুর রহমান। বাড়ি জামালপুর জেলার মেলান্দহ থানাধীন কাজাইকাঁটা গ্রামে। অপারেশন চালানোর আগে ফারুক সীমান্ত পথে অনেকবার পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে বাংলাদেশে যাতায়াত করেছে। টাকাগুলোর অধিকাংশই ফারুক অপারেশন সফল করতে ব্যয় করে। ফারুক সরাসরি অংশ নিয়েছিল কিনা, তা শতভাগ নিশ্চিত হওয়া যায়নি। কারণ অপারেশনে অংশ নেয়াদের সবার সাঙ্কেতিক নাম দেয়া হয়েছিল। ফারুককে গ্রেফতারের পর গ্রেফতারকৃত অন্যদের মুখোমুখি করা সম্ভব হলেই বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে। সাইদুর রহমান ও রাহমানীর মতো শীর্ষ জঙ্গী নেতাদের ছিনতাই করার আগে প্রয়োজন হয়ে পড়ে কারাবন্দী জেএমবির তিন দুর্ধর্ষ জঙ্গী রাকিব, সালেহীন ও বোমা মিজানকে মুক্ত করা। মূল পরিকল্পনা বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে প্রথমেই এই তিন দুর্ধর্ষ জঙ্গীকে ছিনতাই করার পরিকল্পনা হয়। ত্রিশাল অপারেশনে অংশ নেয়া ভারতে গ্রেফতারকৃত সাজিদের স্ত্রী ফাতিমা পুরো ঘটনার আদ্যোপান্ত জানত। তদন্তকারী সংস্থার বক্তব্য ॥ এ ব্যাপারে মামলাটির তদন্তকারী সংস্থা সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার মীর্জা আবদুল্লাহেল বাকীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, ছিনতাইয়ে মূলত কতজন অংশ নিয়েছিল তা জানার চেষ্টা চলছে। হামলাকারীদের অধিকাংশই শনাক্ত হয়েছে। এমন ভয়াবহ হামলা চালানোর দীর্ঘ পরিকল্পনার পাশাপাশি বিশাল ব্যয়ভার কারা, কী কারণে বহন করেছে এবং অর্থ কোথা থেকে কিভাবে এসেছেÑ সে বিষয়ে গভীর তদন্ত চলছে। আসামিদের গ্রেফতারে ভারতসহ পার্শ্ববর্তী দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ হচ্ছে।
×