ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

কাজী সুফিয়া আখ্তার

সুফিয়া কামালের কবিতায় সুফীবাদ

প্রকাশিত: ০৬:৩১, ৪ ডিসেম্বর ২০১৫

সুফিয়া কামালের কবিতায় সুফীবাদ

(শেষাংশ) এছাড়া, তাঁদের শায়েস্তাবাদের পারিবারিক জমিদার বাড়িতে সারা বছর ধরে বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদিতে যে সমস্ত গানের আয়োজন করা হতো, বাড়ির কাজের লোকেরা কাজের ফাঁকে ফাঁকে যে সকল মরমি গান করতো এবং তাঁদের বাড়িতে প্রায়ই বাউল ও গান- গেয়ে- ফেরা ভিখারির আগমন হতো যাঁদের কণ্ঠের অনুপম ভক্তি সঙ্গীত শিশু সুফিয়ার মনে গভীরভাবে দাগ কাটতো। ‘বাউলেরা বাংলার সেই ঐতিহ্য বুকে ধারণ করে থাকে যা প্রচলিত ধর্মীয় বাধ্যবাধকতার বাইরে এক ভিন্ন আধ্যাত্মিকতাম-িত। এর উৎস খুঁজে পাওয়া যায় তান্ত্রিক বৌদ্ধ ধারায়- যা আবার তাঁর দার্শনিক চিন্তা আর ধর্মীয় বোধ সঞ্চয়ন করেছে হিন্দু বৈষ্ণববাদ এবং মুসলিম সুফীবাদ থেকে।’ (ভূমিকা, পৃষ্ঠা-নয় / সুফিয়া কামাল রচনাসংগ্রহ/ সাজেদ কামাল সম্পাদিত/ বাংলা একাডেমি প্রকাশিত) উল্লেখিত সকল কিছু সুফিয়া কামালের সুফী-মানস গঠনে এবং তাঁর কবিতায় সুফীবাদের প্রভাব সঞ্চরণে গভীরভাবে ক্রিয়াশীল ছিল । স্বশিক্ষায় শিক্ষিত এই মহীয়সী নারী সাত বছর বয়সে প্রথম কবিতা লেখেন (কবির কথা অনুসারে)। সুফিয়া কামাল কখনও তাঁর কবিতাকে জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন করেননি। ‘কবিতা তাঁর মতে, জীবন থেকে উৎসারিত যা সময়ের বিবর্তনে আবার জীবনকে করে উত্তরিত।’ বিষয়বৈচিত্র্যে তাঁর কবিতা সমৃদ্ধ। তাঁর কবিতার অনেক অংশজুড়ে রয়েছে প্রেম, প্রকৃতি এবং ইসলাম ধর্মের বিভিন্ন দিবস এবং স্বদেশে-বিদেশে যাঁরা শান্তি প্রতিষ্ঠায় লড়াই করেছেন, তাঁরা। তাঁর প্রথম দিকের কবিতায় প্রেমের মাধুর্য, দয়িতের সঙ্গে মিলনের আকাক্সক্ষা, স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের বেদনা, মিলন ও বিরহ, প্রাপ্তি ও তিরোধান এবং প্রকৃতি সবিশেষ প্রাধান্য বিস্তার করে আছে। তবে কবিতায় সুফীবাদ তাঁর প্রথম দিকের লেখা কবিতাতেই মূর্ত হয়ে উঠেছে। তাঁর অসংখ্য কবিতা রয়েছে যেগুলোতে গভীর ধ্যানমগ্নতা,অতীন্দ্রিয়বাদ,আধ্যাত্মিকতা স্পষ্ট। প্রকৃতির অস্তিত্বে কবি বরাবরই মুগ্ধ, বিমোহিত। বৃষ্টি ঝরলে কবি মনে করতেন এবং বিশ্বাস করতেন এই ধরিত্রীতে আল্লাহর রহমত ঝরে ঝরে পড়ছে। বাংলাদেশের ফুল-ফল, মাটি ও ঘাসের সঙ্গে তাঁর চিরকালের আত্মীয়তা। বাংলাদেশের নারী আন্দোলনের অন্যতম নেত্রী, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের আজীবন সভানেত্রী, বাঙালী সংস্কৃতির ধারক ‘ছায়ানট-এর সভানেত্রী সুফিয়া কামাল কবিতায় নারী ও ধরিত্রীকে এক করে দেখেছেন। আবার তাঁর সুফীবাদের দর্শনের সঙ্গে কোনো বিরোধ ছিল না নারী আন্দোলনের সংজ্ঞারÑ কিংবা নারীবাদের সংজ্ঞার সঙ্গে তাঁর কোনো বিরোধ ছিল না। নারীবাদের শতেক ধারা। তবে তাঁর নারীবাদে কোনো আধিপত্য বোধ ছিল না। কারণ তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন আল্লাহ সকল মানুষের সৃষ্টিকর্তা। তিনি কোনো বৈষম্য করতে পারেন না। তবে উদার নারীবাদের সঙ্গে এবং মানবী-নিসর্গবাদের সঙ্গে তাঁর চিন্তার অনেক ঐক্য ছিল। তাই তিনি দেশের কাজে নারীদের আত্মনিয়োগ করতে আহ্বান জানান। মৃত্যু নিয়ে তাঁর কোনো দুঃখবোধ নেই। মাটির সঙ্গে মিলেমিশে তিনি ভাল থাকবেন এবং তাঁর দেহের রক্ত-মাংসসহ তিনি ঘাস, তরুলতার শিকড়ে প্রাণসঞ্চার করবেন। কবিতায় ব্যক্ত কবির এই ইচ্ছা, পৃথিবীতে ভিন্নভাবে বেঁচে থাকার আকাক্সক্ষা শুধু ইচ্ছা বা ধর্মীয় চিন্তাপ্রসূত নয়। আর একটু অগ্রসর এই চিন্তা সুফীবাদের চিন্তা। মৃত্যুর মধ্য দিয়ে আরেক জীবনে প্রাণসঞ্চারের চিন্তা। তিনি লিখেছেনÑ ‘যাব চলে হাসি মুখে মনে নাহি রবে কোন খেদ কেন না মাটির সাথে আমি রহিব অভেদ এ দেহ মোর রক্ত মাংসসহ মাটির মায়ের কোলে রহি অহরহ সঞ্চারিবে তৃণ তরু পল্লবের মূলে।’ ‘ছোটবেলায় আমি খুব চাপা ছিলাম। কারোর কাছে কোনো কথা বলা বা জিজ্ঞেস করার ইচ্ছা বা সাহসই হতো না। কিন্তু একা মনে মনে আমি বলতাম অনেক কিছু। দেখতাম ফুল, পাখি, চাঁদ, তারা আলো-আঁধার, মেঘ-বৃষ্টি-নদী-পুকুর। এরা আমার মনে কত অদ্ভুত ভাবের প্রশ্ন তুলত। এ সব কেন? এসব কী? এরা কোথা থেকে আসে? কেন এলো? কী হবে এদের? আর আমার অফুরন্ত আগ্রহ ছিল ফুল ফোটা দেখতে। কী করে একটির পর একটি পাপড়ি মেলে? কী করে এরা গন্ধ ছড়ায়? বহুরাত আমি এই নিয়ে ভেবেছি। এমনকি আমার প্রথম সন্তান হওয়ার পর ষোলো-সতেরো বছর বয়স পর্যন্ত এই এক নেশা আমার ছিল; রাত্রে উঠে বাইরে চলে যেতাম ফুল ফোটা দেখতে; আর সঙ্গে সঙ্গে কত যে কী কল্পনায় দেখেছি তা ভাবলে আমার নিজেকে নিজের এখন পাগল মনে হয়।’ [একালে আমাদের কাল / পৃষ্ঠা -৫৬৬-৫৬৭ / সুফিয়া কামালের রচনাসংগ্রহ] প্রেম তাঁর কবিতায় সবসময়ই প্রভাব বিস্তার করে আছে। ‘দীওয়ান’ কাব্যগ্রন্থে সেই পরিচয় আরও বিধৃত। কিন্তু দুইজন মানব-মানবীর প্রেমের চেয়ে বিশ্বের সকল মানুষের প্রতি তাঁর ভালবাসা তাঁর কবিতায় মূর্ত হয়ে ফুঠে উঠেছে বেশি। এ বিষয়ে তাঁর অনেক কবিতা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে লং আইল্যান্ড-এ মিলনী সংঘ আয়োজিত নবম বঙ্গ সম্মেলনের (৪, ৫, ৬ আগস্ট ১৯৮৯) জন্য লিখিত কবিতায় তিনি লিখেছেনÑ ‘দূর হোক হিংসা, দ্বেষ, সম্বরিয়া মারণাস্ত্র রাশি সাম্য, প্রেমে মানবাত্মা উঠুক উদ্ভাসি।’ [সম্মেলন ] তবে ‘লুমুম্বার আফ্রিকা’ কবিতায় অন্য বক্তব্য উপস্থাপিত। মানুষের ভাল করার পথ দীর্ঘদিনের সংগ্রামের পথ। তিনি বলেন : ‘এ বিপুল বিশ্বারণ্যে লুমুম্বার শোণিত প্রবাহ ছড়াইল দীপ্তময় পাবক প্রদাহ- জাগরণ! মানবাধিকারবোধ জ্বালা শহীদের কণ্ঠে বাজে শোণিতাক্ত অপরাজিতার নীল মালা আফ্রিকার রাত্রি শেষ। দিগন্তে প্রদীপ্ত সূর্যকর অগ্নিবাহু মেলে দিয়ে উদ্ভাসিয়া তুলিছে প্রহর।’ স্বদেশের বীরযোদ্ধা, শহীদ এবং সংগ্রামী নেতা-নেত্রীদের প্রতি তাঁর যেমন অপরিসীম শ্রদ্ধা ছিল তেমনি শ্রদ্ধা পোষণ করতেন বিশ্বের অন্য প্রান্তের, অন্য ভাষার নেতা, সংগ্রামী নেত্রীদের প্রতিও। তাদের নিয়ে আছে কবিতা। মানবের সংগ্রামকে তিনি সুফীবাদ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখতেন না। ‘মানুষে মানুষে হোক পরিচয় কালিমাবিহীন।’ সুফিয়া কামালের মধ্যে প্রচ- রকমের স্বদেশভাব জাগ্রত থাকলেও আন্তর্জাতিকতাবোধ সমপরিমাণেই বিদ্যমান ছিল। ফলে দেশে দেশে শোষণ ও পরাধীনতার বিরুদ্ধে, হিংসা ও বিদ্বেষের বিরুদ্ধে মানুষের লড়াইয়ে তাঁর কবিতা সমকালীন বিষয় বা বোধ আক্রান্ত হয়ে চিরকালীন আশায় রূপ লাভ করে। বৃহত্তর উপলব্ধিতে সঞ্জীবিত হয়। শান্তির জন্য, স্বাধীনতার জন্য যাঁরা আত্মাহুতি দিয়েছেন তাঁদের সকলের প্রতি ছিল তাঁর অপরিমেয় শ্রদ্ধা। বিশ্বের সকলের তরে জাত, ধর্ম, বর্ণ, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে তাঁর শান্তি কামনা মুখ্য হয়ে ওঠে সঙ্গতভাবেই। নিম্নে কয়েকটি কবিতার অংশবিশেষ উল্লেখ করা হলোÑ ‘এ সৌধে উৎকীর্ণ আছে যাঁহাদের চিত্র ও নাম শ্রদ্ধায় তাঁদের স্মরিলাম, অন্যায়ের প্রতিবাদে পণ করি প্রাণ রাখিয়াছে মানুষের আত্মার সম্মান, মৃত্যুরে করেছে তারা জয় তাঁদের স্মরণে তাই বিনত আমার হৃদয়।’ [ সাকো ও ভেনজেটিকে শ্রদ্ধাঞ্জলি ] ‘যাঁহারে জনতা জানে, সত্যের, মুক্তির বাণী যাঁর অন্ধকার আফ্রিকার বুকে করে প্রাণের সঞ্চার’ [ম্যান্ডেলা /অগ্রন্থিত কবিতা ] শান্তি কামী সুফিয়া কামাল আজকের হিংসা-বিদ্বেষ ও সন্ত্রাসপূর্ণ বিশ্ব দেখে শঙ্কিত হয়েছেন। ‘মহাত্মার বাণী’ কবিতায়Ñ ‘মহা মানবের মহা শান্তির বাণী সে কি আজ রবে ধুলায় লুটায়ে- দেবে না আনি? মানবাত্মার জাগ্রত চেতনাবোধ টুটাইয়া অবরোধ ভ্রান্তির যবনিকা ছিন্ন করিয়া আবার না দেখা আত্মচেতনালোক?’ [মহাত্মার বাণী / অগ্রন্থিত কবিতা / সুফিয়া কামাল রচনা সংগ্রহ ] ‘মাতা অমৃতা’ কবিতায় মাদার তেরেসা প্রসঙ্গে বলেছেন-‘মানবের মর্যাদায় বহায়েছে আনন্দের ধারা।’ এলিসা নিউ, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজীর অধ্যাপক এবং আমেরিকান কবিতার মুখ্য জ্ঞানীদের একজন, সুফিয়া কামালের কবিতায় তাঁর অখ- এবং বিশ্বজনীন চেতনা সম্পর্কে লিখেছেন : (“সুফিয়া কামাল ছিলেন এমন একজন যাঁর বিরল প্রতিভা ছিল তাঁর চারপাশের সমস্ত কিছুর সঙ্গে এক সম্পর্ক লালন করা, তাদের সঙ্গে অনবরত কথাবার্তা চালিয়ে যাওয়া। যাঁরা তাঁকে জেনেছেন তাঁরা এটাও জানেন যে, তিনি ছিলেন এমন একজন মানুষ যিনি খুব সহজেই তাঁর উষ্ণতা জড়ানো শক্তি আর উজ্জ্বল উপস্থিতি তাঁর কাব্য-সম্ভারে, রাজনৈতিক কর্মতৎপরতা এবং প্রতিদিনকার জীবনে অনুসৃত করতে পেরেছিলেন। ঠিক যেমনভাবে তাঁর ‘নবজাতকের প্রতি’ কবিতায় (১৯৮৯) এক মায়ের ভালবাসা সমস্ত বিশ্বকে ধারণ করে রাখে, বিচ্ছিন্নতা, মনুষ্যত্বহীনতা প্রকৃতি বিধ্বংসিকতা, পীড়ন, নিষ্পেষণ এবং বঞ্চনার বিরুদ্ধে সুফিয়া কামালের আজীবনের যে যুদ্ধ তা স্থাপিত আছে তাঁর একান্ত ব্যক্তিক, মাতৃসুলভ ঔদার্যের মূল্যবোধ এবং চর্চায়।” ÔSufia Kamal was one whose rare gift was to maintain a constant colloqyu, an ongoing conversation, and a relationship of nurturing attention with all those around her. She was,as those who knwe her attest, a person who easily translated her own warm force and vivid presence back and forth between poetic composition, political activity and the daily –ness of life. Just as, in such poems as `To the Newborn Children(1989), the love of a mother takes the whole world in ,Sufia KamalÕs lifelong opposition to alienation, dehumani“ation, destruction of nature, tyranû, oppression and expoitation rested on the value, and practice , of a very maternal, very personal generosity.Õ [Foreword, Mother of Pearls and Other poems by Sufia Kamal, Bangla Academy, 2001).
×