ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

রাজু মোস্তাফিজ

ব্যাঙ্ককের স্বর্ণমন্দির ও কিছু স্মৃতি

প্রকাশিত: ০৬:২৫, ৪ ডিসেম্বর ২০১৫

ব্যাঙ্ককের স্বর্ণমন্দির ও কিছু স্মৃতি

তখন মধ্য রাত। পুরো ব্যাংকক শহর শান্ত হয়ে গেছে। রাস্তায় গাড়ি অনেক কমে গেছে। আমরা হোটেলে ফেরার জন্য গাড়ি পাচ্ছিলাম না। সুকম্ভিত রোডে হোটেল ম্যানহেটাইন যাওয়ার জন্য যদিও দু’একটি গাড়ি পাওয়া যাচ্ছে তার ভাড়া প্রায় দ্বিগুণ। কিছুক্ষণের মধ্যে একটি টুকটুকে (টুকটুক হচ্ছে আমাদের দেশের সিএনজিচালিত টেক্সির মতো, সুন্দর করে সাজানো গাড়ি) উঠে পড়লাম। প্রতিজন একশ বাত করে দিলাম। টুকটুক খুব দ্রুত চলছে ফাঁকা রাস্তা দিয়ে। কিছক্ষণের মধ্যে হোটেলে পৌঁছালাম। খুব ক্লান্ত আমরা। রুমে ঢুকে বিছানায় গা দিতেই ঘুমের কোলে ঢলে পড়লাম। পরদিন খুব সকালে উঠেছি। দুলাল ভাইসহ ব্যাংকক শহরের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরব। কারণ, বিকেলে আমাদের ফ্লাইট। নাস্তা সেরে হোটেলের পাশে রবিনসন মার্কেটে গেলাম। ছয় তলা মার্কেট। প্রতিটি ফ্লোরে বিভিন্ন জিনিস দিয়ে সাজানো। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত খোলা থাকে এই মার্কেট। কিছু চকোলেট কিনে আমরা বেড়িয়ে পড়লাম। আমরা চায়না টাউনে যাব। স্থানীয়দের কাছে শুনেছি এই বাজারে সন্ধ্যার পর থেকে দলে দলে তরুণ-তরুণীরা আসে। রাস্তার পাশে বিভিন্ন ফাস্টফুডের দোকানে তারা খায়, দেয় দীর্ঘক্ষণ আড্ডা। এখানে রয়েছে চীনা মন্দির। সারা বছর প্রচুর পর্যটক আসে এখানে। বাজারের বিভিন্ন খাবারের দোকান এবং সোনার দোকানগুলো চমৎকার সাজানো গোছানো। দিনের সময় এই বাজার ভীড় কম থাকলেও সন্ধ্যার পর প্রচুর ভীড় হয়। আমরা হোটেল ম্যানহাইটান থেকে বের হয়ে চায়না বাজার যাব কিন্তু যানজট আর সময় স্বল্পতার জন্য যেতে পারলাম না। টেক্সি নিয়ে স্বর্ণ মন্দিরে রওনা দিলাম। পুরো শহর খুব ব্যস্ত। হাজার হাজার গাড়ি চলছে। রাস্তায় কোন ধুলোবালি নেই। কোথাও কোন ট্রাফিক পুলিশ চোখে পড়েনি। চুনহুয়া তরুণ টেক্সি ড্রাইভার। মোটামুটি ভাল ইংরেজী বলল সে। আমাদের সঙ্গে কথা হলো স্বর্ণ মন্দির যাওয়া আসায় ২৫০ বাত নেবে। তবে পথে জেমস গ্যালারি নামের একটি শপিংমলে নিয়ে যাবে। আধাঘণ্টার মধ্যে আমরা জেমস গ্যালারি সেন্টারে পৌঁছে গেলাম। বিশাল মার্কেট। বিভিন্ন জুয়েলারি পণ্য থেকে সব রকম জিনিস এই মার্কেটে পাওয়া যায়। সবাই মিলে ঘুরলাম সারা মার্কেট। তবে কেনা হলো না কিছুই। আরও আধা-ঘণ্টা পর স্বর্ণ মন্দিরে পৌঁছালাম। বিশাল মন্দির। আধুনিক স্থাপত্যশৈলী দিয়ে তৈরি। মাঝখানের ঘরে গৌতম বুদ্ধের বিশাল মূর্তি। মন্দিরের পাশে রয়েছে মাঝারি আকারের একটি লাইব্রেরি। প্রতিদিন প্রচুর পর্যটকের সমাগম হয় এখানে। ব্যাংককের অন্যতম দর্শনীয় স্থান এটি। দেরি না করেই মন্দিরে টিকেট কেটে ঢুকে পড়ি। ঘুরে ঘুরে দেখলাম পুরো মন্দির। চার তলা এই মন্দিরটি। গৌতম বুদ্ধের মূর্তির সামনে অনেক পর্যটক পূজা অর্চনায় ব্যস্ত। সৃষ্টির প্রতি একান্ত কৃতজ্ঞতা না দেখলে বিশ^াস করার উপায় নেই। থাইল্যান্ডে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী মানুষের সংখ্যা বেশি। আমরা যখন মন্দির থেকে নিচে নেমে আসি তখন কিছু ফটোগ্রাফার আমাদের ছবি তুলতে চাইলেন। দুলাল ভাই ছবি তুলতে রাজি হলো না। অগত্যা শুধু আমি মন্দিরের সঙ্গে ছবি তুললাম। ফটোগ্রাফার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী অল্প সময়ের মধ্যে আমাকে ধাতব প্লেটের ওপর আমার ছবি দিয়ে দিল। হাতে নিয়ে মন খুশিতে ভরে উঠলো। আমরা টেক্সিতে করে রওনা দেই হোটেলের দিকে। আকাশে ঘনকালো মেঘ। বেশ জোরে বাতাস বইতে শুরু করেছে। যে কোন সময় বৃষ্টি আসতে পারে। কিছুক্ষণের মধ্যে আমরা হোটেলে পৌঁছে গেলাম। দুুপুরের খাবারের পর বিকেলে আমাদের এয়ারপোর্টে পৌঁছাতে হবে। হোটেলে পৌঁছে দুপুরের খাবারের জন্য বেড়িয়ে পড়লাম। সুকুম্ভিত ৬/১১নং রোডে ‘দেশী খাবার’ নামে একটি বাঙালী হোটেলে খাবারের জন্য ঢুকে পড়লাম। এ হোটেলের মালিক বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার যুবক মামুন। কাজের সন্ধানে ৬ বছর আগে থাইল্যান্ডে এসেছিলেন মামুন। এ দেশে বিভিন্ন কাজ করেছেন। চরম কষ্ট করে দিন কাটিয়েছিলেন খেয়ে না খেয়ে। হাল ছাড়েননি মামুন। একটু একটু করে পয়সা রোজগার করে দেড় বছর আগে এখানে বাঙালী হোটেল খুলেছেন। এখানে ভাত, মাছ ও ডালসহ সব বাঙালী খাবার পাওয়া যায়। প্রতিদিন গড়ে ৭০ থেকে ৮০ জন মানুষ দিন-রাত মিলে এখানে খাবার খায়। মামুন জানায়, প্রতিদিন প্রচুর বাংলাদেশী মানুষ থাইল্যান্ডে আসে। সময় যত যাচ্ছে মানুষের ভীড় ততই বাড়ছে। তার খাবার হোটেলে সাত থেকে আটজন কাজ করে। মামুনের আতিথেয়তায় আমরা মুগ্ধ। এখানে তৃপ্তিভরে ভাত-মাছ খেয়ে আমরা আবার বেড়িয়ে পড়লাম। বাহিরে প্রচুর বৃষ্টি। আমরা বৃষ্টি থামার জন্য অপেক্ষা করছি। এক সময় বৃষ্টি কমলে আমরা হোটেলে ফিরি। সেখান থেকে সুবর্ণভূমি এয়ারপোর্টে যাওয়ার জন্য বাসে উঠলাম। বৃষ্টি শেষে আবারও রোদ উঠেছে। মনে হচ্ছিল না কিছুক্ষণ আগে বৃষ্টি হয়েছে। ব্যাংকক শহরের ওপর দিয়ে দ্রুত বাস চলছে। বিশাল বিশাল ফ্লাইওভার পাড়ি দিয়ে গাড়ি ছুটে চলছে। প্রায় ঘণ্টা দেড়েক পরে আমরা পৌঁছালাম সুবর্ণভূমি আন্তর্জাতিক এয়ারপোর্টে। সুবর্ণভূমি আন্তর্জাতিক এয়ারপোর্ট খুবই সুন্দর করে সাজানো। তাদের দেশীয় ঐতিহ্যের বিভিন্ন মূর্তি দিয়ে সাজিয়েছে পুরো এয়ারপোর্ট। এখানে যে কোন পর্যটক এলেই বুঝতে পারবেন থাইদের জীবন আর ঐতিহ্যের বিষয়টি। ডিউটি ফ্রি শপগুলোতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের জিনিস বেচাকেনা হচ্ছে এখানে। এয়ারপোর্টের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করতে প্রায় দু’ঘণ্টা লেগে গেল আমাদের। রাত নয়টার দিকে আমরা থাই এয়ারওয়েজের বিমানে উঠে বসলাম। আমরা যখন ঢাকায় আন্তর্জাতিক শাহজালাল এয়ারপোর্টে পৌঁছলাম তখন রাত সাড়ে এগারটা। আমি যখন গাড়িতে বসে বাসায় ফিরছি, নিজের অজান্তেই তখন ভাবছিলাম, এতো একই আবহাওয়া, একই মাটি, অথচ কত বিস্তর পার্থক্য দুটি দেশের। আমার কাছে এ কয়েক দিনের থাইল্যান্ড ভ্রমণ এখন শুধুই স্মৃতি। শুধুই অতীত। তবে মনকে টানে আবার কবে যাব ওই ছবির মতো সাজানো দেশটি দেখার জন্যে?
×