ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

সংস্কৃতি সংবাদ

প্রাণের স্পন্দনে উদযাপিত হলো বাংলা একাডেমির হীরক জয়ন্তী

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ৪ ডিসেম্বর ২০১৫

প্রাণের স্পন্দনে উদযাপিত হলো বাংলা একাডেমির হীরক জয়ন্তী

স্টাফ রিপোর্টার ॥ হেমন্তের মেঘলা বিকেল। বাংলা একাডেমির বর্ধমান ভবনের নিকটবর্তী রবীন্দ্র চত্বরে যেন ছড়িয়েছে প্রাণের স্পন্দন। সবুজ ঘাসের ওপর বিছিয়ে দেয়া চেয়ারে বসে চলছে মনখোলা আড্ডা আর পারস্পরিক ভাববিনিময়। আড্ডার ফাঁকে ফাঁকে চলে চা-নাশতার পর্ব। সেই প্রাণের আড্ডায় জড়ো হয়েছেন কবি, কথাশিল্পী, শিক্ষাবিদ, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, ভাষা সংগ্রামী, প্রকাশক, একাডেমির ফেলো, সদস্যসহ নানা ভুবনের উজ্জ্বল মানুষরা। কীর্তিমান মানুষদের সম্মিলনের উপলক্ষ ছিল বাংলা একাডেমির হীরকজয়ন্তী উদ্্যাপন। বাঙালীর মননের সাক্ষ্যবহ প্রতিষ্ঠানটি ষাট বছর অতিক্রমের আয়োজনটি ছিল বর্ণিল। নানা আনুষ্ঠানিকতায় সাজানো হীরকজয়ন্তীর দুই দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালার সূচনা হয় সকালে। ভাষা শহীদদের স্মরণ করে একাডেমির পক্ষ থেকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ফুলেল শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করা হয়। একাডেমির সদস্যসহ বরেণ্য ব্যক্তিত্বদের প্রদান করা হয় শ্রদ্ধাঞ্জলি। এছাড়াও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, পটুয়া কামরুল হাসান ও ভাষাবিজ্ঞানী ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র সমাধি সৌধেও পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হয়। দুপুরে বাংলা একাডেমির পুকুরপাড়ে একাডেমির কর্মকর্তা ও কর্মচারীবৃন্দ সাংস্কৃতিক পরিবেশনায় অংশ নেন। প্রথম দিনের দ্বিতীয় পর্বের আনুষ্ঠানিকতার সূচনা হয় বিকেলে। একাডেমির সদস্যসহ বিশিষ্টজনদের প্রদান করা হয় সংবর্ধনা। একাডেমির নভেরা প্রদর্শনী কক্ষে বাঙালী মনীষার দীপ্ত প্রতিকৃতি শীর্ষক ২৪ দিনব্যাপী প্রদর্শনীর উদ্বোধন করা হয়। উৎসব উপলক্ষে প্রকাশিত বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠাবার্ষিক বক্তৃতা গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন করা হয়। অনুষ্ঠিত হয় স্মারক বক্তৃতা। সব শেষে সাংস্কৃতিক পর্বে সঙ্গীত পরিবেশ করেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের নাতনি পশ্চিমবঙ্গের বিশিষ্ট কণ্ঠশিল্পী অনিন্দিতা কাজী এবং সঙ্গীতশিল্পী রফিকুল আলম ও শিল্পী অণিমা রায়। রবীন্দ্র চত্বরে অনুষ্ঠিত সংবর্ধনা অনুষ্ঠানটি পরিণত হয় বরেণ্য ব্যক্তিত্বদের সম্মিলনে। হৃদয়ের উচ্ছ্বাসে প্রাণের টানে সেখানে হাজির হয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সৈয়দ হাসান ইমাম, ড. গোলাম মুরশিদ, কথাশিল্পী আনোয়ারা সৈয়দ হক, বিচারপতি কাজী এবাদুল হক, ভাষাসংগ্রামী রওশন আরা বাচ্চু, রাজনীতিক ও প্রাবন্ধিক মোনায়েম সরকার, নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার, ড. নিয়াজ জামান, এশিয়াটিক সোসাইটির সভাপতি অধ্যাপক নজরুল ইসলাম, পশ্চিমবঙ্গের চিত্রসমালোচক প্রণবরঞ্জন রায়, কবি কাজী রোজী, প্রকাশক মাজহারুল ইসলাম নানা অঙ্গনের মানুষরা হাজির হয়েছিলেন একাডেমির আমন্ত্রণে। হীরকজয়ন্তীর আয়োজনের অতিথি পশ্চিমবঙ্গ বাংলা একাডেমির সভাপতি নাট্যজন শাঁওলী মিত্র, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সভাপতি বারিদবরণ ঘোষ, নজরুল-দৌহিত্রী অনিন্দিতা কাজীও ছিলেন এ আড্ডায়। আড্ডার মাঝেই কথা হয় সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের সঙ্গে। বললেন, অবিশ^াস্য মনে হয়, বাংলা একাডেমির ৬০ বছর হয়ে গেল। এ ভবনে এসে দেখেছি ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, সরদার ফজলুল করিমদের কাজ করতে। ঊনসত্তরে গণঅভ্যুত্থানের সময় এই স্তরেই পাঠ করেছিলাম কবিতা। কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই একাডেমিজুড়ে। রবীন্দ্র চত্বরের সবুজ ঘাসের ওপর দাঁড়িয়ে এক ছাত্রের সঙ্গে কথা বলছিলেন অধ্যাপক নজরুল ইসলাম। বললেন, আমার এখানে তেমন একটা আসা হয় না, কিন্তু এ ধরনের আয়োজনে না এসে পারলাম না। এখানে সবার সঙ্গে দেখা হচ্ছে, কথা হচ্ছে; ভাল লাগছে। এখান থেকে এ স্তরে নিয়মিত আড্ডার ইচ্ছাটা নিয়ে ঘরে ফিরছি। সংবর্ধনা শেষে একাডেমির নভেরা প্রদর্শনী কক্ষে ‘বাঙালী মনীষার দীপ্ত প্রতিকৃতি’ শীর্ষক ২৪ দিনব্যাপী প্রদর্শনীর উ™ে^াধন হয়। এখানে দুই বাংলার বাঙালী মনীষীদের প্রতিকৃতি ঘুরে দেখছিলেন শাঁওলী মিত্র। কথা হয় এই নাট্যজনের সঙ্গে। বললেন, এর আগে অভিনেত্রী হিসেবে কয়েকবার ঢাকায় এসেছিলাম। এবারই প্রথম বাংলা একাডেমিতে আসা। পুরো আয়োজনে মগ্ধ হলাম। বাংলা ভাষার জন্য যারা আত্মাদান করেছেন, তাদের স্মরণে এমন প্রতিষ্ঠান সত্যিই অসাধারণ। দুই বাংলার বাংলা একাডেমির তুলনা করতে গিয়ে বললেন, মাত্রই এলাম তোমাদের এখানে, এত তাড়াতাড়ি কি বলা যায়? বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বহু বছর আগে। আর বাংলা আকাদেমির যাত্রা শুরুর বয়সটা এখনও খুবই অল্প। এ প্রদর্শনী কক্ষেই কথা হয় নজরুলের নাতনি কণ্ঠ ও আবৃত্তিশিল্পী অনিন্দিতা কাজীর সঙ্গে। অনুভূতি জানতে চাইলে বললেন, এদেশে এলে অনুভব করি শেকড়ের টান। সংস্কৃতি, বাংলা ভাষা ও কাজী নজরুল ইসলাম সবকিছু যেন মিলেমিশে এক হয়ে যায়। আর নজরুলকে সবচেয়ে বড় স্বীকৃতি দিয়েছে বাংলাদেশ। তাঁর সৃষ্টিকর্মকে যেভাবে এদেশ ধারণা করেছে, তা অনন্য। সংবর্ধনা ও প্রদর্শনীর উদ্বোধনী আয়োজন শেষে একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে হীরকজয়ন্তীর স্মারক বক্তৃতা দেন ভারতের চেন্নাইয়ের লেখক ও গবেষক ভি বি গণেশন। তিনি বাংলাদেশের আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ ও ভারতের ইউ ভি স্বামীনাথ আয়ারের পুঁথিসাহিত্য নিয়ে তুলনামূলক আলোচনা করেন। এ পর্বে প্রধান অতিথি ছিলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। একাডেমির সভাপতি ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের সভাপতিত্বে বিশেষ অতিথি ছিলেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা একাডেমির সভাপতি শাঁওলী মিত্র ও বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সভাপতি বারিদবরণ ঘোষ। স্বাগত ভাষণ দেন একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান। প্রধান অতিথির বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, বাংলা একাডমি প্রতিষ্ঠার দিন ১৯৫৫ সালে ঢাকায় থাকা সত্ত্বেও আমি অনিবার্য কারণে অংশ নিতে পারিনি। কিন্তু আজ একাডেমির হীরকজয়ন্তী উৎসবে এসে সে দুঃখ ঘুচে গেছে। একাডেমি বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে যেসব উচ্চাভিলাষী ও গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পন্ন করেছে সেজন্য একাডেমির সারা বিশ্বের বাংলা ভাষাবাষী মানুষের ধন্যবাদপ্রাপ্য। সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর বলেন, বাংলা একাডেমি আমাদের প্রাণের প্রতিষ্ঠান। পাকিস্তানী অন্ধকার সময়ে আমরা এই একাডেমিতে সাংস্কৃতিক সংগ্রাম পরিচালনা করেছি। এখন একাডেমি ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে অসাধারণ সব কাজ করে চলেছে। বাংলা একাডেমির একুশের বইমেলা আজ বিশ্বের দীর্ঘতম বইমেলার স্বীকৃতিপ্রাপ্ত। তিনি বলেন, বাংলা একাডেমির ষাট বছর আমাদের সবার জন্য অত্যন্ত আনন্দের মুহূর্ত। স্মারক বক্তৃতায় ভি বি গণেশন বলেন, তামিলনাড়ুর স্বামীনাথ আয়ার আর বাংলার আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের ঐতিহ্য-অনুসন্ধিৎসা আমাদের গভীর আগ্রহের বিষয়। আমি অত্যন্ত আনন্দিত যে এ বক্তৃতানুষ্ঠান আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের নামাঙ্কিত মিলনায়তনেই অনুষ্ঠিত হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গ বাংলা একাডেমির সভাপতি বিশিষ্ট নাট্যজন শাঁওলী মিত্র বলেন, বাংলাদেশের বাংলা একাডেমি এবং পশ্চিমবঙ্গের বাংলা একাডেমি যৌথভাবে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে গবেষণা করতে পারে। অনুষ্ঠানে নজরুল-পৌত্রী অনিন্দিতা কাজী নজরুলকে নিয়ে লেখা বঙ্গবন্ধুর একটি রচনার সংক্ষিপ্ত ভাষ্য পাঠ করে বাংলাদেশ ও নজরুলের অচ্ছেদ্য সম্পর্কের কথা স্মরণ করেন। সাংস্কৃতিক পর্বে সঙ্গীত পরিবেশ করেন বিশিষ্ট শিল্পী অনিন্দিতা কাজী, শিল্পী রফিকুল আলম এবং শিল্পী অণিমা রায়। অনুষ্ঠানে বাংলা একাডেমির ইতিহাস ঐতিহ্য এবং সাম্প্রতিক কর্মতৎপরতা নিয়ে একটি প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শিত হয়। স্মারক বক্তৃতানুষ্ঠানের শুরুতে কবিগুরুর ‘শুভকর্ম পথে ধরো নির্ভয়ের গান’ শীর্ষক সঙ্গীত পরিবেশন করেন লিলি ইসলাম। সাংস্কৃতিক পর্বে সঙ্গীত পরিবেশন করেন শিল্পী রফিকুল আলম ও অণিমা রায়। প্রতিবন্ধী শিল্পীদের সাংস্কৃতিক পরিবেশনা ॥ মানুষের অদম্য ইচ্ছাই নিয়ে যেতে পারে তাঁর কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে। মনের জোরে শারীরিক সমস্যাকে পাশ কাটিয়ে জড়িতে হতে পারে সংস্কৃতিচর্চা। বৃহস্পতিবার তেমনই কয়েকজন শিল্পীর সাংস্কৃতিক পরিবেশনা অনুষ্ঠিত হলো শিল্পকলা একাডেমির নন্দনমঞ্চে। হেমন্ত সন্ধ্যায় একাডেমির উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হলো প্রতিবন্ধী শিল্পীদের অংশগ্রহণে আমরা করব জয় শীর্ষক আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। প্রতিবন্ধী শিল্পীরা সঙ্গীত পরিবেশনের পাশাপাশি উপস্থাপন করলেন যন্ত্রসঙ্গীতের সুর মূর্ছনা। ‘এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ’ বইয়ের মোড়ক উন্মোচন ॥ প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের উদ্যোগে রচিত ‘এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ’ বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করেছেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে বইটির মোড়ক উন্মোচন করেন শিক্ষামন্ত্রী।
×