ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

আমির আর সেক্রেটারি পদ নিয়ে টানাপোড়েন;###;রিক্রুটমেন্ট বন্ধ, নাম শুনলেই মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে নতুন প্রজন্ম

নেতৃত্ব সঙ্কটে জামায়াত শিবির, তৃণমূলের কেউ কথা শুনছে না

প্রকাশিত: ০৫:৪০, ৪ ডিসেম্বর ২০১৫

নেতৃত্ব সঙ্কটে জামায়াত শিবির, তৃণমূলের কেউ কথা শুনছে না

বিভাষ বাড়ৈ ॥ আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংগঠনের আদলে প্রতিষ্ঠিত হলেও এবার নেতৃত্ব সঙ্কটের মুখে পড়েছে দলগতভাবে যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত জামায়াত। বিএনপিসহ দেশী-বিদেশী গোষ্ঠীর আশীর্বাদে দাপট দেখালেও বাস্তবে ভেঙ্গে পড়েছে দলের চেন অব কমান্ড। আমির ও সেক্রেটারির পদ নিয়ে চলছে টানাপোড়েন। একাত্তরে গণহত্যার জন্য অধিকাংশ শীর্ষ নেতা দীর্ঘদিন কারান্তরীণ। কয়েক নেতার ফাঁসির পর এবার সেক্রেটারি মুজাহিদের ফাঁসির আগে ক্ষমা চাওয়া, আমির মতিউর রহমান নিজামীর বিচারের শেষপর্যায়ে এসে দোষ স্বীকারের ঘটনায় দলটির হিসেবনিকেশ উল্টে দিয়েছে। প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়সারির অধিকাংশ নেতা আটক থাকায় চতুর্থ ও পঞ্চম স্তরে অনেকটা সাধারণ নেতাকর্মীরা নেতৃত্ব দিলেও মাঠপর্যায়ে কেউ কথা শুনছে না। জামায়াত-শিবিরের একাধিক সূত্র স্বীকার করেছে- প্রতিষ্ঠার পর প্রথমবারের মতো মাঠপর্যায়ে নেতাকর্মীদের মাঝে নানামুখী টানাপোড়েন নিয়ে বেকায়দায় জামায়াতের ‘পাওয়ার হাউস’ হিসেবে স্বীকৃত ছাত্রশিবিরও। দেশজুড়ে সরকারের কঠোর অবস্থান ও জনরোষের মুখে পরিস্থিতি সামাল দিতে প্রথমবারের মতো সংগঠনটি বন্ধ করে দিয়েছে রিক্রুটমেন্টও। তরুণরা নতুন করে কেউ শিবিরে যোগ দিতে চাইছে না- তৃণমূল থেকে এমন তথ্য এসেছে শিবিরের কেন্দ্রে। জানা গেছে, জামায়াত-শিবিরের নেতৃত্ব সঙ্কট এমন পর্যায়ে চলে গেছে যে, কোন সিদ্ধান্তই এখন আর জামায়াত ঠিকভাবে নিতে পারছে না। আবার গোপন বৈঠক করে কর্মসূচী বা অন্য কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে চাইলে নেতারা জড়িয়ে পড়ছেন মতবিরোধে। বর্তমান নেতাদের মাঝে সমন্বয়হীনতায় ক্ষমতার দ্বন্দ্ব আর জামায়াতের সঙ্গে শিবিরের মতবিরোধে সিদ্ধান্ত নিতেও পারছে না উগ্রবাদী এ গোষ্ঠী। আছে গঠনতন্ত্র মানা নিয়েও মতবিরোধ। বিশেষ পরিস্থিতি বিবেচনায় রেখে গঠনতন্ত্র সংশোধন করে আমির নির্বাচনপদ্ধতি স্থগিত রয়েছে। তবে গঠনতন্ত্র সংশোধনেও গঠনতান্ত্রিক শর্ত মানা হয়নি বলে অভিযোগ তুলেছে শিবিরের অনেক নেতা। ২০০৯ সালের নবেম্বরে সর্বোচ্চ ভোট পেয়ে আমির নির্বাচিত হন মতিউর রহমান নিজামী। ২০১০-১২ সেশনের জন্য নির্বাচিত হওয়ার পর ২০১০ সালে তিনি গ্রেফতার হন। এরপর ভারপ্রাপ্ত আমির করা হয় নায়েবে আমির মকবুল আহমাদকে। এরপর গঠনতান্ত্রিক বাধ্যবাধকতার কারণে ৬ মাসের বেশি ভারপ্রাপ্ত থাকা যায় নাÑ এমন শর্তের জন্য ২০১১ সালে বিশেষ পরিস্থিতি দেখিয়ে মকবুল আহমাদের মেয়াদ ফের বৃদ্ধি করা হয়। সর্বশেষ ২০১২ সালের শুরুতে গঠনতান্ত্রিক নিয়ম লঙ্ঘিত হবেÑ এমন মনে করে গঠনতন্ত্র সংশোধন করে জামায়াত। রোকন সম্মেলনে ব্যর্থ হয়ে ‘বিশেষ পরিস্থিতি’ প্রদর্শন করে মকবুল আহমাদকেই ভারপ্রাপ্ত দায়িত্বে রাখা হয়। কিন্তু সেক্রেটারি ও দুই সহকারী সেক্রেটারির ফাঁসি কার্যকর ছাড়াও জামায়াতের আমির, নায়েবে আমিরসহ শীর্ষ প্রায় সব নেতা যুদ্ধাপরাধের দায়ে জেলে। ইতোপূর্বে সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কাদের মোল্লা, কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকর এবং দলটির গুরুত্বপূর্ণ নায়েবে আমির অধ্যাপক একেএম নাজির আহমাদের মৃত্যু ও আরেক নায়েবে আমির মাওলানা আবুল কালাম মুহাম্মদ ইউসূফের হঠাৎ মৃত্যুর কারণে এ নেতৃত্বে সঙ্কটের বিষয়টি সামনে চলে আসে। নেতাকর্মীদের মনে প্রশ্ন, ধারাবাহিকভাবে প্রবীণ নেতাদের পদ শূন্য হওয়ায় কমান্ডিং নেতৃত্ব সঙ্কট তৈরি হয়েছে জামায়াতে। দেশব্যাপী নানা অপরাধে একের পর এক নেতাকর্মী গ্রেফতার হওয়ায় সক্রিয় নেতাকর্মীরাও রয়েছেন আত্মগোপনে। দলীয় কার্যালয় দূরের কথা, বাসা-বাড়ি, ব্যক্তিগত অফিস, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কোথাও একটানা অবস্থান করছেন না তারা। ঝটিকা মিছিল, ভাংচুর ছাড়া চলছে না প্রকাশ্য কোন সাংগঠনিক কার্যক্রম। নিত্যনতুন কৌশল নির্ধারণ করেও খুব বেশি সুবিধা করতে পারছে না দলটি। সরকারের কঠোর অবস্থানে অনেকে দেশত্যাগ করে বিভিন্ন দেশে চাকরির জন্য পাড়ি জমাচ্ছেন বলেও তৃণমূল থেকে কেন্দ্রে তথ্য আসছে। আবার কেউ কেউ রাজনীতি ছেড়ে বিভিন্ন কোম্পানিতে চাকরি নেয়ার চেষ্টা করছেন। এ বিষয়টিও ভাবিয়ে তুলেছে জামায়াতের শীর্ষ নেতৃত্বকে। এদিকে কেউ এ নিয়ে খোলামেলা কথা বলতে রাজি না হলেও তারা বলছেন, সঙ্কটে পড়লেও মাঠপর্যায়ে দল ত্যাগ করে চলে যাওয়া কিংবা দলের ঘোষণার পরও মাঠে নামেনি এমন ঘটনা আগে কখনও ঘটেনি। এ অবস্থায় দলের ভবিষ্যত নিয়ে নেতাকর্মীদের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে হতাশা। দলের নেতাকর্মীদের একটা বড় অংশ আটক থাকায় এবং সরকারের কঠোর অবস্থানের কারণে জামায়াত ও ছাত্রশিবির এ মুহূর্তে ঝুঁকি নিতে রাজি নয় বলে জানিয়েছেন মাঠপর্যায়ের নেতারা। দেশের যেসব এলাকায় জামায়াতের শক্ত অবস্থান, সেসব এলাকায়ও হরতালে দলটির তেমন তৎপরতা দেখা যায় না এখন। সূত্রগুলো বলছে, এই মুহূর্তে দলের শীর্ষ পদ নিয়েও ইতিহাসের সবচেয়ে বড় সঙ্কটে পড়েছে জামায়াত। এর আগে পদ-পদবির জন্য উগ্রবাদী এ দলটিতে এমন বিরোধ দেখা যায়নি। জামায়াতের একাধিক দায়িত্বশীল নেতা বলেছেন, এখন শূন্যপদে নিয়োগ পেতে আগ্রহী। কেউ কেউ ভেতরে ভেতরে চেষ্টা শুরু করেছেন। এ অবস্থায় দলের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে অস্বস্তি দেখা দিয়েছে। ওই নেতার দাবি, রফিকুল ইসলাম খান সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল পদের সঙ্গে ঢাকা মহানগর আমিরের পদটিও ধরে রাখতে আগ্রহী। দলের জ্যেষ্ঠ নেতারা বিষয়টি নিয়ে অস্বস্তিতে আছেন। কারণ এক ব্যক্তিকে গুরুত্বপূর্ণ দুটি পদের দায়িত্ব দেয়া হবে দলের জন্য নতুন নজির। এছাড়া এটি দলের গঠনতন্ত্রেরও বিরোধী। জামায়াত নেতারা দাবি করছেন, তাদের দলে বিধান অনুযায়ী কেউ দলের পদ-পদবির জন্য প্রার্থী হতে পারেন না। এমনকি এর জন্য ইচ্ছাও ব্যক্ত করতে পারে না। কিন্তু খুব কম সময়ের মধ্যে জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের ধারাবাহিক ফাঁসির ঘটনায় পরবর্তী নেতৃত্বের দাবি নিয়ে এখন অনেকটাই বিভক্ত দলটির নীতিনির্ধারকরা। নতুন নেতৃত্ব নিয়ে জামায়াতে মোট চারটি শক্তিশালী মত দাঁড়িয়ে গেছে। একপক্ষ চায় বর্তমান ভারপ্রাপ্ত আমির মকবুল আহমাদ ও ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল শফিকুর রহমানকে স্থায়ীভাবে আমির ও সেক্রেটারি জেনারেল করা হোক। আরেকটি অংশ চায় নায়েবে আমির মজিবুর রহমানকে দলের আমির ও ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাককে সেক্রেটারি করা হোক। একটি অংশ চায় শফিকুর রহমানকে জামায়াতের আমির ও ঢাকা মহানগরীর বর্তমান আমির রফিকুল ইসলাম খানকে দলের সেক্রেটারি জেনারেল করা হোক। শফিকুর রহমানকে আমির করে সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহেরকে সেক্রটারি করার মতও রয়েছে অনেকের। প্রতিষ্ঠার পর প্রথমবারের মতো মাঠপর্যায়ে নেতাকর্মীদের মাঝে নানামুখী টানাপোড়েন নিয়ে বেকায়দায় জামায়াতের ‘পাওয়ার হাউস’ হিসেবে স্বীকৃত ছাত্রশিবির। শিবির অতীতে এতবড় সঙ্কটে পড়েনি বলেই মনে করছেন সংগঠনটির নেতারা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিবিরের উপস্থিতি একতরফা আর নেই। চট্টগ্রাম ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছিল সংগঠনটির দাপুটে। সেখানেও দাপট একচ্ছত্র নেই। শিবিরের মাঠপর্যায় থেকে আসা নানা তথ্য ভাবিয়ে তুলেছে জামায়াত-শিবিরকেই। সারাদেশে শিবির করাকে এখন আর ভালচোখে দেখছে না পরিবার। আসছে সংসার থেকেও চাপ। শিবির নেতাকর্মীদের বাবা-মা ভাই-বোনরাও আছেন আতঙ্কে। ছেলে কখন ধরা পড়ে। কখন কারাগারে যায়। কখন সংঘর্ষে পড়ে- এ উদ্বেগ তাদের নিত্যসঙ্গী। অনেক অভিভাবকই চাইছেন তার সন্তানরা শিবির ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসুক। অনেক অভিভাবক অভিযোগ করছেন, তাদের সন্তানদের লাঠিয়াল হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। কারণ অনেকেই জেনে গেছেন জামায়াত-শিবির যত না ইসলামী সংগঠন তার চেয়ে বেশি রাজনৈতিক প্লাটফর্ম। শিবিরের এসব সঙ্কট নিয়ে দলের নেতারা কেউ মুখ খুলছেন না। প্রতি মুহূর্তে তারা মোবাইলের সিম বদলান ধরা পড়ার ভয়ে। থাকারও নির্দিষ্ট জায়গা নেই। নিত্য পুলিশ তাদের ধাওয়া করছে। এ নিয়েও সংগঠনটির মধ্যে চলছে টানাপোড়েন। তবে শিবিরের অনেক নেতা সন্দেহ করছেন সরকার হয়ত তাদের মধ্যেই নিজেদের লোক ঢুকিয়ে দিয়েছে। তা না হলে কী করে নেতারা হুটহাট ধরা পড়েন। এদিকে এসব প্রতিকূল পরিস্থিতির কারণে বেশ কিছুদিন ধরে প্রথমবারের মতো সংগঠনটি রিক্রুটমেন্ট বন্ধ রেখেছে। তরুণরা নতুন করে কেউ শিবিরে যোগ দিচ্ছে না। কারণ শিবির পরিচয়টি এখন ঝুঁকিপূর্ণ। সাধারণ মানুষের মধ্যে শিবিরের গ্রহণযোগ্যতা এখন নেতিবাচকতার সর্বনিম্ন পর্যায়ে। গণজাগরণ মঞ্চ শিবিরকে অনেকটাই কোণঠাসা করতে পেরেছে। গণজাগরণ মঞ্চ তরুণদের মধ্যে একটি বিষয় ছড়িয়ে দিতে পেরেছে যে, জামায়াত-শিবির এরা বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধী। এ বিষয়টিও ভাবিয়ে তুলেছে শিবিরকে।
×