ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

দাউদ হায়দার

কোন্ ভাঙনের পথে এলে

প্রকাশিত: ০৩:৩৪, ৪ ডিসেম্বর ২০১৫

কোন্ ভাঙনের পথে এলে

পোক্ত হয়ে শুরুতেই ভিন্ন কথা বলছে তুরস্ক, “আমরা শান্তি, গণতন্ত্র ও যুদ্ধের বিরুদ্ধে। আমরা চাই বৈশ্বিক মানবতা।” আমেরিকা, ন্যাটো যুদ্ধের বিরুদ্ধে? এই প্রশ্নে তুরস্ক চুপ, রা কাড়েনি। আমেরিকা মুসলিম দেশগুলোকে দেখিয়েছে, দেখাচ্ছে মুসলিম দেশ তুরস্ক ন্যাটোর খোঁয়াড়ে, তোমরাও ঢুকে পড়ো। সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের তেলসাম্রাজ্য আমেরিকা তথা ন্যাটোরই খানসামা, আজ্ঞাবহ। টু শব্দ করার পাটা নেই বুকে। তুরস্কেরই দুই প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মেসুত ইলমাজ (মাদারল্যান্ড পার্টি) এবং বুলেন্ট এচেভিত (ডেমোক্র্যাটিক লেফ্ট পার্টি) সতর্ক করে বলেছিলেন, জাস্টিস পার্টি (এখন জাস্টিস এ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি) হাড়মজ্জায় ইসলামিক পার্টি। সময়মতো জানবেন। মিথ্যে প্রফেসি নয়। আবদুল্লাহ গুল প্রধানমন্ত্রী হয়ে জাস্টিস এ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির খোলনলচে পাল্টাতে শুরু করলেও, গোপনীয়তা ছিল। কিন্তু রিসেপ তাইপে এরদোগান ধার ধারেননি, একেবারে খোলাসা করে দিয়েছেন। দ্বিতীয়বার (২০০৭-২০১১) নির্বাচিত হয়েই হুঙ্কার, “তুরস্ক ইসলামিক দেশ।” ২৯ অগাস্টে (২০১৫) পুনর্নির্বাচনে জয়ী, কণ্ঠ এবার জোরালো। কয়েক বছর ধরেই আমরা দেখছি, প্রতিটি জনসভায়, রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে স্ত্রীকে নিয়ে হাজির, মাথায় হিজাব। দেশবাসীকে বলেন, ‘ইসলামী আদবকায়দা, কালচার সমুন্নত রাখতে হবে।’ কেবল রাখা নয়, রাষ্ট্রীয় পর্যায়েও বিধান জারি। তুরস্কের নানা শহর, রাজ্যে গিয়েছি বহুবার, আঙ্কারার চেয়ে ইস্তান্বুল, ইজিমির, আন্তালিয়া প্রিয় এর আগে দেখিনি, এখন দেখছি (গত বছর ইস্তান্বুলে গিয়ে) বহু তরুণীর মাথায় হিজাব। ইস্তান্বুলে অবশ্য নাইটক্লাব, বেলি ড্যান্স হল জমজমাট। এক ক্লাবে (বেলি ড্যান্সের) ঢুকে দেখি নর্তকীর মাথায় হিজাব। নতুন ফ্যাশনে, কম্বিশনে মন্দ লাগে না নাচ। তুরস্কেরই বিখ্যাত দৈনিক হুরিয়াতের এক সাংবাদিক বললেন, এরদোগানের জামানায় ইসলামি নাচ। নাচের খ্যামটা মহড়াও দৃশ্যত, পতিতালয়ে । রাশিয়ার বিস্তর বেশ্যা তুরস্কে, সরকারী নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ইস্তান্বুলের নানা অলিগলিতে রুশ তরুণী। পুলিশকে ঘুষ দিয়ে দিব্যি বহাল তবিয়তে। জানিয়ে রাখা জরুরী, তুরস্কের আন্তালিয়ায় এবং ইজমিরে সবচেয়ে বড় ঘাঁটি রাশিয়ার। প্রতিবছর চার মিলিয়নের বেশি রুশ ভ্রামণিক তুরস্কে, অর্ধেকই আন্তালিয়ায়। কারণ এই, এখানে রুশ কালচারের রমরমা, গজিয়েছে গত ১৫ বছরে এবং বিস্তর রুশ রমণী তুর্কি বিয়ে করে আস্তানা গেড়েছে। রাশিয়ার সঙ্গে তুরস্কের আর্থিক, বাণিজ্যিক সম্পর্ক, লেনদেন ৩৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি। পর্যটনে এগারো ভাগ (রুশ পর্যটক)। বাকি লেনদেন কারিগরি, খাদ্য-পানায়, ইলেক্ট্রনিক্স, গ্যাস। রাশিয়ার গ্যাস ছাড়া তুরস্ক অচল। পারমাণবিক চুল্লির যে চুক্তি রাশিয়ার সঙ্গে, রাশিয়া ছাড়া কেউ মেটাতে পারবে না। এত জেনেও তুরস্ক কেন রুশ বোমারু বিমান ভূপাতিত করেছে? পাইলটকে হত্যা করেছে? তুরস্কের সাফাই আমরা করিনি, এই বয়ান মিথ্যে। বয়ান ছিল, সুলতান আবদুল হামিদ ব্রিগেডের দল করেছে। কি আশ্চর্য!! ‘আবদুল হামিদ ব্রিগেড দল তো তুরস্কেরই তৈরি। তুরস্কের গোয়েন্দাবাহিনীই তো এই দলের প্রশিক্ষক, অস্ত্রও দিয়েছে, সরবরাহ করছে এখনও। মডারেট জিহাদি আবদুল হামিদ ব্রিগেড বাহিনীর চালিকাশক্তি তুরস্ক, প্রত্যেকের জানা। তুরস্ক আইএস-এর সঙ্গে সম্পর্কিত গোড়া থেকেই, রাশিয়া বলছে শুরু থেকেই। আমেরিকা, ন্যাটোভুক্তদেশগুলো মুখ সেলাই করে চুপ। হেতু, তুরস্ককে দিয়ে রাশিয়াকে শায়েস্তা করার বদমাইশি। রাশিয়ার বোমারু বিমান ধ্বংস, পাইলট হত্যায় তুরস্ক ভেবেছিল আমেরিকা, ন্যাটোর বাহবা, সাহায্য পাবে। আমেরিকা, ন্যাটো অ্যাইগুঁই করে যা বলছে, ধোপে টেকে না। মজার ঘটনা এই, আমেরিকা, ন্যাটো এখন চুপ, যা ব্যাটা, তোর বগল তুই চুলকা। ছাগলের তিন নম্বর বাচ্চা তুরস্ক, লাফালাফিই সার, দুধ না খেয়ে বাঘের কবলে। রাশিয়া বলছে, কি করে ঘাড় মটকাতে হয় জানি। তোর বাপ, বাপের সাধ্যি নেই উদ্ধারের। তুরস্কের কান্নাকাটি অঝোরে, এরদোগান মরিয়া ফয়সালার, নতজানু বলতে বাংলা ভাষায় যে বিশেষণ, তার চেয়েও বেশি। ভবি ভোলার নয়, সোভিয়েত ইউনিয়ন ধসের পরে শ্বেতভালুক চুপ ছিল। গা-গতর ঝেড়ে দাঁড়িয়েছে আবার, মনে রাখবেন নতুন ভালুক ভøাদিমির পুতিন। আমেরিকার বিপদ। ন্যাটোর প্রমাদ। রাশিয়ার তথা কানার মনে-মনেই জানা। খাবুলয় তো মাখালু কি কামে। তুরস্ক ভেবেছি আমেরিকা, ন্যাটোর আস্কারায় ভাত মাখিয়ে ছড়ালেই পার পাবে। সেদিন আর নেই। রাশিয়া ছাড়ার পাত্র নয় আর, ঢেড় দয়েছে, ভাত মাখালু, খেতে হবে। খাওয়াবো। রাশিয়ার এই জেদে, রবীন্দ্রসঙ্গীতই কণ্ঠে, কোন্ ভাঙনের পথে এলে, তুরস্ক? পাবনার দোহারপাড়ায় একটি প্রবাদ আছে, “খাবুলয় তো মাখালু কি কামে (খাবি না তো মাখিয়েছিস কেন)”। চোখের সামনে যদি ভাত-তরকারি থাকে গামলায়, ইচ্ছে করে চটকাতে, খাক বা না খাক। দোষ নেই ছাওয়ালপলের। দোষ বংশের। দোষ রক্তের। এ্যালোপ্যাথি-হোমিওপ্যাথি- কবিরাজি-হেকিমি-আয়ুর্বেদে আরোগ্য সহজ নয়। মুস্তফা কামাল আতাতুর্ক চেষ্টা করেছিলেন রক্তবীজ সমূলে ধ্বংসের, পারেননি। এক বছরও ক্ষমতাসীন নন (৩ মে ১৯২০- জানুয়ারি ১৯২১)। ঠিক তবে, দেশকে (তুরস্ক) সেকুলার করার জন্যে কোন বাধা, হুমকি, নিষেধাজ্ঞা তোয়াক্কা করেননি। তৈরি করেছেন রিপাবলিকান পিপলস পার্টি। এও ঠিক, ১৯৫০ সাল পর্যন্ত আর পি পি (রিপাবলিকান পিপলস পার্টি ) রাজত্ব করেছে, ভোটে নির্বাচিত হয়ে। অতঃপর ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রবেশ। আবার আর পি পি’র। তারপরেই মিলিটারি ক্যু। সামরিক শাসন, তাও মাত্র আট মাস পাঁচ দিন (২০ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৫-২৭ অক্টোবর ১৯৬৫)। আমেরিকার প্রচ- চাপে সামরিক শাসন শিকেয় তুলে সাধারণ নির্বাচনের আয়োজন, সুলেমান ডেমিরিলের জাস্টিস পার্টির আবির্ভাব। বিপুল ভোটে জয়ী। রাজত্ব করে ২৭ অক্টোবর ১৯৬৫ থেকে ২৬ মার্চ ১৯৭১ পর্যন্ত। তখনই সামরিক প্রধান বুলেন্ড ইনোনু টের পান জাস্টিস পার্টির মতিগতি ভালো নয়। সেকুলারের বদলে তুরস্ককে ইসলামী দেশ করার পাঁয়তারা। বুলেন্ড ক্ষমতা দখল করেন। আবার সামরিক সরকার (২০ সেপ্টেম্বর ১৯৮০-১৩ ডিসেম্বর ১৯৮৩)। ক্ষমতাচ্যুত হয়ে সুলেমান ডেমিরেল নতুন দল গঠন করেন, নাম ট্রুু পাথ পার্টি। নাম পাল্টালেও পার্টির নীতি, কার্যকলাপ একই। নির্বাচনে জয়ী হয়ে আড়াই বছর রাজত্ব (২০ নবেম্বর ১৯৯১-১৬ মে ১৯৯৩)। ক্ষমতা ছাড়েন বটে, বসিয়ে দেন তানসু সিলারকে (২৫ জুন ১৯৯৩-৬ মার্চ ১৯৯৬), তিনিই তুরস্কের প্রথম ও শেষ প্রধানমন্ত্রী (এখন পর্যন্ত)। তানসু সিলারের আমলে জার্মানির সঙ্গে তুরস্কের প্রচ- দহরম-মহরম। দেখতুম, প্রায়ই জার্মানি সফরে আসেন (আড়াই বছরে দশ বার)। দেখতে অতিশয় সুন্দরী, প্রৌঢ়া নন, শরীরও মজবুত, গাট্টাগোট্টা। জার্মান মিডিয়ার, বিশেষত ইয়েলো ট্যাবলয়েডের, মুখরোচক রসিকতাও। কারণও আছে। জার্মান চ্যান্সেলর (তৎকালীন) হেলমুট কোল বড় বেশি তুরস্কপ্রেমী। তুরস্ককে ইইউ (ইউরোপীয় ইউনিয়ন)-ভুক্ত করার জন্যে আদাজল খেয়ে লেগেছেন। ভেবেছিলেন, ওঁর মতো প্রভাবশালী রাষ্ট্রকর্তা ইউরোপীয় ইউনিয়নে দ্বিতীয় কেউ নেই আর, দুই জার্মানি এক হয়েছে, একত্রীকরণে ওঁর ভূমিকা ও দাপট ঐতিহাসিক, উপরন্তু, ইউরোপে জার্মানি সবচেয়ে ধনী ও বড় দেশ, ইসি (ইউরোপীয় কমিশন)-তে সদস্য সংখ্যা এক-তৃতীয়াংশ, অতএব, জার্মানির আবদার ইইউ-র বাকি দেশ মানতে বাধ্য। পয়লা বাদ সাধে ফ্রান্স। অতঃপর ইতালি, স্পেন, বেনেলুক্স (বেলজিয়াম-নেদারল্যান্ড-লুক্সেমবুর্গ)। প্রমাণ দিয়ে বলে তুরস্ক ভিতরে-ভিতরে ইসলামিক দেশ, মানবাধিকার নেই, নারী-পুরুষের সমতা নেই এবং লোক-দেখানো গণতন্ত্র। জার্মানির বিরোধী দলও বাদ সাধে, তুরস্ককে কিছুতেই ইইউভুক্ত করতে দেবে না। জনমতও তৈরি করে। কুর্দিস পার্টিও (জার্মান শাখা) তুলে ধরে তুর্কি সরকারের হত্যা, বর্বরতা। সভায়। মিছিলে। তুরস্ক খুবই আশা করেছিল যত বাধাবিপত্তিই আসুক চ্যান্সেলর হেলমুট কোলই কা-ারি, বৈতরণী পার করাবেন নিশ্চয়। কেন এই আশা? কেনই-বা হেলমুট কোলের ঘটকালি এতটা? রহস্য আছে বৈ কী। খোলাসাও হয় মিডিয়ায় (সচিত্র)। ঝকঝকে এক তরুণী, বয়স তিরিশের কম, মিস ইউনিভার্সের চেয়েও সুন্দরী, হেলমুট ও তাঁর স্ত্রী হানালোরের সেবাযতœ করছেন খুব। ওঁদের সঙ্গে যাচ্ছেন নানা অনুষ্ঠানে। তরুণী তুর্কি। জার্মান নাগরিক অবশ্য। ফ্রাঙ্কফুর্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির ছাত্রী, পিএইচডি ডিগ্রিধারিণী। হেলমুট-হানালোরের দ্বিতীয় ছেলের বান্ধবী তথা প্রেমিকা। বাগদত্তা। বিয়েও হবে যথাসময়ে। হেলমুট কোল তো একবার তুরস্ক সফরে গিয়ে (ইস্তান্বুলে) ভাবী পত্রবধূর বাড়িও পরিদর্শন করেন, বলা হয় তখন, “একজন সাধারণ তুর্কির বাস, জীবনযাপন কী রকম, দেখতে গিয়েছিলেন। “ দেখে নিশ্চয় আঁশ মিটেছিল। চ্যান্সেলর থাকাকালীনই বিয়ে, ঘটা করে নয়। তুরস্কের আশায় গুড়ে বালি, ইইউভুক্ত হওয়ার কোন চান্স নেই, পথও নেই। তুরস্কের গণতন্ত্র, মানবাধিকার নিয়ে সমূহ প্রশ্ন। তিনটি সংবাদপত্র এখন বন্ধ। মিডিয়ায় সরকারী মোড়লি, বহু সাংবাদিক বন্দী, নিখোঁজ, গায়েব। মুক্তচিন্তা নিষেধ। বুদ্ধিজীবী পলাতক। গ্রেফতারি পরোয়ানা। নোবেল বিজয়ী সাহিত্যিক ওরহান পামক কী কম নাজেহাল, কিংবা বহুমান্য ঔপন্যাসিক ইয়াসার কেমাল? তুরস্ক এখনো আর্মেনিয়ান ম্যাসাকার, হত্যাযজ্ঞ মানতে রাজি নয়, বেমালুম অস্বীকার করে। এই অস্বীকারেই তুরস্কের সততা প্রশ্নবিদ্ধ। এবং ইইউ-ভুক্তিতে প্রথম অন্তরায়। আর্মেনিয়া যদিও ইইউ-য়ে শামিল নয়, রাশিয়ার সঙ্গেই হরিহর আত্মা, কিন্তু, ইইউ (পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো) মনে করে রাশিয়া থেকে বেরিয়ে ইইউ-য়ে যোগ দেবে একদিন। তুরস্ক ন্যাটোয় যোগ দিয়েছে আমেরিকার চাপেই, আমেরিকা বলছে নিজের স্বার্থে (আফ্রিকার অ্যাঙ্গোলা কি স্বার্থে যোগ দিয়েছে?)। তো, আমেরিকার স্বার্থ, ন্যাটোর স্বার্থে পোক্ত হতে চায় তুরস্ক। daudhaider21@googlemail
×