ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বীমা কোম্পানিগুলো অডিটরদের কাজ করতে দেয় না কোন্্ সাহসে?

প্রকাশিত: ০৩:৩২, ৪ ডিসেম্বর ২০১৫

বীমা কোম্পানিগুলো অডিটরদের কাজ করতে দেয় না কোন্্ সাহসে?

যত বিপদ গরিবদের। যত ক্ষতি গ্রামবাসী ও গরিব এবং নিম্নবিত্তদের। যতই লেখালেখি হোক না কেন এর থেকে এই শ্রেণীর লোকদের বাঁচার কোন পথ নেই। কথাগুলো বলছি একটা খবর দেখে। খবরের শিরোনাম ‘পলিসির টাকা নয়ছয় বীমা কোম্পানিগুলো নিরীক্ষকদের কোন তথ্য দিচ্ছে না।’ খবরের ভেতরে না গিয়েও বোঝা যায় শিরোনাম কী বলছে। তবু একটু ভেতরে যাওয়া দরকার। দেশের ছয়টি বীমা কোম্পানির হিসাবপত্র নিরীক্ষা করাচ্ছে ‘ইনসিউরেন্স ডেভেলপমেন্ট রেগুলেটরি অথরিটি”। এগুলো বিশেষ নিরীক্ষা। করানো হচ্ছে ‘ইনডিপেনডেন্ট অডিটরদের দিয়ে।’ নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর নাম দেখে বোঝা যাচ্ছে ‘অডিটর’রা যথেষ্ট দক্ষ প্রতিষ্ঠান। তারা যথারীতি অভিযুক্ত ছয়টি বীমা কোম্পানির ওপর কাজ শুরু করতে তাদের কার্যালয়ে যায়। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ কোম্পানিগুলো ‘পলিসি হোল্ডার’দের টাকা নয়ছয় করছে, যথেচ্ছভাবে ব্যয় করছে। দাবি পরিশোধ করছে না। রিপোর্টটিতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, দেশে বর্তমানে ৭০ লাখের মতো জীবনবীমা গ্রহীতা আছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হচ্ছে এই বীমা গ্রহীতাদের অধিকাংশই গ্রামবাসী। এখানে উল্লেখ্য, শহরের মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্তরা, এমনকী নিম্নবিত্তরা পর্যন্ত বীমা কোম্পানিগুলোর ধারেকাছে যেতে চায় না। এর কারণ কী? কারণ হচ্ছে, এই বীমা কোম্পানিগুলোর ‘ক্লেইম সেটেলমেন্ট রেকর্ড’ খুবই খারাপ। এমতাবস্থায় এরা চলে যায় গ্রামাঞ্চলে। গ্রামাঞ্চলের মানুষ আজকাল কিছু সঞ্চয় করে। বিদেশ থেকে যে রেমিটেন্স আসে তার একাংশ এই বীমা খাতে যায়। গ্রামের লোকদের অশিক্ষা ও জ্ঞানাভাবের সুযোগ নিয়ে এক শ্রেণীর বীমার দালাল গ্রাম-গঞ্জ চষে বেড়ায়। ত্রুটিপূর্ণ নথি তৈরির মাধ্যমেই তারা তাদের কাজ শুরু করে। অবস্থা এমন হয় যে, কোনভাবেই আর পলিসির টাকা আদায় করা সম্ভব হয় না। আমি ময়মনসিংহ অঞ্চলের দুটো ঘটনা নিয়ে আপ্রাণ চেষ্টা করেছি দুটো নিতান্তই গরিব জেলে পরিবারকে সাহায্য করতে। পলিসি হোল্ডার মারা গেছে। বীমা কোম্পানির দাবি ‘শ্মশানঘাটের সার্টিফিকেট’ লাগবে, দিতে হবে পুলিশ রিপোর্টসহ আরও অনেক কাগজপত্র। গ্রামে শ্মশানঘাট এখন কোথায়? এ কথা সবারই জানা। বহু তদবির করে আমি ব্যর্থÑঢাকা ও ময়মনসিংহের মামলা। অসম্ভব খরচের ঝামেলা। আমি নিশ্চিত সারা বাংলাদেশে এমন ঘটনা হাজার হাজার। নিরীহ মানুষের সঞ্চয়ের টাকা বীমার এক শ্রেণীর দালাল লুট করে নিচ্ছে। এদের অত্যাচার ‘এনজিও’,‘যুবক’,‘ডেস্টিনি’ ইত্যাদির চেয়ে কম নয়। আমি বহুবার লিখেছি দেশে এমতিতেই সঞ্চয় কম। তার ওপর গ্রামের লুটেরারা সামান্য সঞ্চয়ের টাকাও মেরে দিচ্ছে। মানুষকে দাঁড়াতে দিচ্ছে না। বিপরীতে দেখা যাচ্ছে কিছু কিছু বীমা কোম্পানি মতিঝিলের আশপাশের সব সম্পত্তির মালিক হচ্ছে ধীরে ধীরে। প্রচুর বীমা কোম্পানির বিরুদ্ধে শত শত অভিযোগ। আমাদের কপাল ভাল। এখন একটা প্রতিষ্ঠান হয়েছে ‘ইডরা’। তবে প্রতিষ্ঠানের কাজ আরও দক্ষতাসম্পন্ন হওয়া দরকার। ফাউল কোম্পানিগুলোর যাতে দ্রুত বিচার হয় তা দেখা দরকার। এমন কোম্পানিও আমরা দেখলাম যার মালিক কেঁদে কেঁদে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সস্তায় ঋণ নিয়ে নিলেন। অথচ তার বীমা কোম্পানিটি রি-ইনসিউরেন্স পর্যন্ত করাত না। আমি জোরালোভাবে বলতে চাই, এ অবস্থার অবসান ঘটুক। আরও নিবিড়ভাবে এই খাতকে পর্যবেক্ষণ করা হোক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কিছু কিছু কাজ এখন দৃশ্যমান। এমতাবস্থায় ‘ইডরার’ উচিত যেসব কোম্পানি অডিটরদের তথ্য দিচ্ছে না সেখানে অবজারভার বসানো। জানি না এ ক্ষমতা তাদের আছে কীনা-না থাকলে এই ক্ষমতা অবিলম্বে তাদের দেয়া হোক। সুস্থ বীমা কোম্পানি ও খাত না থাকলে আমাদের আর্থিক খাত স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে না। দুটো খবর পাশাপাশি পড়ে আমি একুট কনফিউজড হয়ে পড়েছি। আমাদের বিশিষ্ট চেম্বার অব কমার্স ‘এমসিসিআই’ বলছে, দেশের অর্থনীতির মূল সূচকগুলো অক্টোবর-ডিসেম্বরে অগ্রগতি দেখাবে। আমদানি, রফতানি ও রেমিটেন্স ইত্যাদির তথ্য বিশ্লেষণ করে তারা বলছে, অগ্রগতির সূচকগুলো উর্ধমুখী। আমি তাদের তথ্যের দিকে যাচ্ছি না। আমি যাচ্ছি আরেকটি খবরে। আর সেটা হচ্ছে ‘আইএমফে’। আইএমএফ বলছে, সরকারের রাজস্ব আয়ে চলতি বছরে বিশাল ঘাটতি হবে। আইএমএফের সাথে ‘এমসিসিআই’র সম্পর্কে ভাল বলেই জানি। প্রশ্ন, অর্থনীতি যদি সচল থাকে তাহলে রাজস্ব ঘাটতি হবে কেন? আইএমএফ বলছে, সরকারের রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে ২ লাখ ৮ হাজার ৪৪৩ কোটি টাকা। এর বিপরীতে আদায় হবে মাত্র ১ লাখ ৭৬ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। নতুন বেতন স্কেল প্রবর্তনের ফলে ঘাটতি আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা যাচ্ছে। প্রশ্নটি এখানে বেশ বড়। আমাদের আমদানি, রফতানি যদি প্রাক্কলিত হারে চালু থাকে, অন্যান্য কর্মকা-টি ঠিক থাকে তাহলে এত ঘাটতি হবে কেন? আর যদি সত্যি সত্যি তা হয় তাহলে তা হবে সর্বনাশা ব্যাপার। এতে বাজেট শৃঙ্খলা ভেঙ্গে পড়বে। এটা কী মাত্রাতিরিক্ত রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রার ঠিক করার ফল? এ সম্পর্কে নানা খবর দৈনিক কাগজে ছাপা হচ্ছে। সরকারের উচিত এ ব্যাপারে সময় দেয়া। কারণ রাজস্ব ঘাটতির কবলে পড়া সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়। হাতে হাতে বড় বড় কাজ। একটার বিপর্যয়ে আরেকটা বিপর্যয় চলে আসতে পারে? এদিকে বড়ই আশার একটা খবর, আমরা দেখলাম কাগজে। এক গবেষক বলেছেন, ঢাকা শহরের ‘ট্রাফিক কনজেশন’ হ্রাস করে বাংলাদেশ তার জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার দ্বিগুণ করে ফেলতে পারে। আমরা জানি সরকার যারপরনাই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার পারতপক্ষে সহসা ৭ শতাংশে উন্নীত করতে। কিছুতেই তা হচ্ছে না। এর মধ্যে খবর ঢাকা শহরের যানজট কমাতে পারলে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হার হবে ১৩ শতাংশ। গবেষকের গবেষণায় ফুল চন্দন পড়ুক। তিনি বলেছেন, বছরে যানজটে দেশের ক্ষতি হয় ১২ দশমিক ৫৬ বিলিয়ন ডলার, যা জিডিপির সাড়ে সাত শতাংশের সমান। অতএব হিসাবটা খুবই সোজা। এই খবরের পর আমরা দেখলাম ঢাকা উত্তরের মেয়র সাহেবকে রাস্তায়। তিনি সৈন্যসামন্ত নিয়ে গিয়েছিলেন তেজগাঁও ট্রাক স্ট্যান্ডে। এটা অবৈধ, তাই তিনি তা তুলে দিতে চান। মহতী উদ্যোগ সন্দেহ নেই। ফল কী পেলাম? কিছুই তো হলো না। মেয়র সাহেব নিজেই আটকা পড়লেন উচ্ছৃঙ্খল শ্রমিকদের হাতে। এটাই যদি হয় ঘটনা তাহলে ঢাকাকে যানজটমুক্ত করা হবে একটা দুঃসাধ্য কাজ। যে দেশের সংসদ সদস্যরা বলেন, রিক্সা তুলে দিলে রংপুরের লোক না খেয়ে থাকবে সে দেশে রাস্তা যানজটমুক্ত করা কঠিন বৈকি! তবে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে মেয়র সাহেব একটা উদাহরণ সৃষ্টি করতে পারেন। সেটা নিজের ঘরেই। যতদূর জানি উনি একজন বড় ব্যবসায়ী। সম্ভবত গার্মেন্টস ব্যবসায়ী। তাদের একটা বিল্ডিং আছে হোটেল সোনারগাঁওয়ের কাছে। এটা অবৈধ স্থাপনা বলেই জানি। তিনি এটা ভেঙ্গে একটা নজির স্থাপন করতে পারেন। আইনগত বাধা থাকলে তা দূর করে ফেলুন, তারপর ভাঙ্গুন। আমি মনে করি এটি করলে তার নৈতিক শক্তি বৃদ্ধি পাবে। মানুষ তার পক্ষে যানজটমুক্ত আন্দোলনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাস্তায় নামবে। পরিশেষে আরেকটি খবরের উল্লেখ করে আজকের লেখা শেষ করতে চাই। খবরটিতে বলা হয়েছে, সরকার বিদেশী বড় বড় কোম্পানিকে স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত করতে বদ্ধপরিকর। যেমন ইউনিলিভার বাংলাদেশ লিমিটেড। এই কোম্পানিটি পৃথিবীর দেশে দেশে বিভিন্ন স্টক এক্সচেঞ্জের সঙ্গে তালিকাভুক্ত। বাংলাদেশই একমাত্র ব্যতিক্রম। এরকম আরও বহু উদাহরণ আছে। বহুজাতিক কোম্পানিগুলো লাভজনক, তারা প্রচুর মুনাফা দেশে করে। কিন্তু দেশের মানুষ তার ভাগ পায় না। কারণ তাদের শেয়ার বাজারে নেই। উল্টো বরং এসব কোম্পানি, প্রতিবছর বহু লোকের চাকরি খায় যদিও তারা লাভজনক প্রকল্প। এসব ঘটছে আমাদের দুর্বল কর্তৃত্বের জন্য। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে আমরা দেখছি বিদেশী নানা জুলুমের বিরুদ্ধে সোচ্চার। তিনি রাখঢাক করে কথা বলেন না। কিন্তু তার সরকারের ‘সারিন্দারা এসব ব্যাপারে মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকেন। তাদের মাথায় ‘বিশ্ব ব্যাংক’, আইএমএফ। তারা নাখোশ হতে পারে এমন কোন কথা তারা বলেন না। প্রশ্ন, বিদেশী কোম্পানিগুলোকে শেয়ার বাজারে আনতে গেলেও বিশ্বব্যাংক নাখোশ হবে! লেখক : ম্যানেজমেন্ট ইকোনমিস্ট ও সাবেক শিক্ষক, ঢাবি
×