ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

সামাজিক প্রতিরোধ কমিটির সংবাদ সম্মেলন

মেয়েদের বিয়ের বয়স ন্যূনতম ১৮ বছর বহাল রাখার দাবি

প্রকাশিত: ০৫:৪৯, ৩ ডিসেম্বর ২০১৫

মেয়েদের বিয়ের বয়স ন্যূনতম ১৮ বছর বহাল রাখার দাবি

বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টার ॥ ১৮ বছর বয়সের নিচের নারীরা মাতৃত্ব গ্রহণ ও সন্তান জন্মদানের জন্য উপযুক্ত হয়ে ওঠে না। শিশু বয়সে সন্তান জন্মদানের কারণে সেই সব শিশু কন্যাদের জন্য প্রজনন স্বাস্থ্য ঝুঁকি, মাতৃমৃত্যুর হার এবং শিশু মৃত্যুর হার বৃদ্ধিসহ তাদের সারা জীবন ক্ষতিকর স্বাস্থ্য পরিস্থিতির সৃষ্টি করে যা তাদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে। তাই কন্যা শিশুর বিয়ের ন্যূনতম বয়স শর্তহীনভাবে ১৮ বছর বহাল রাখতে হবে। কোন অবস্থাতেই ১৮ বছরের আগে কোন কন্যা শিশুর বিয়ে হতে পারবে না। ১৮ বছরের আগে বিয়ে হলে নারীর ক্ষমতায়ন এবং উন্নয়নে সরকারের গ্রহণ করা সব ধরনের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যাবে। তাই বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন-২০১৪ এর ১৬নং ধারার বিশেষ বিধান বাতিল করতে হবে। এই বিশেষ বিধান রেখে বিয়ের বয়স কমানো হলে তা হবে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। আইন পাসের নামে দেশকে পিছিয়ে নিয়ে যাওয়ার কোন সুযোগ নেই। বুধবার বিকেলে জাতীয় প্রেসক্লাব মিলনায়তনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলন থেকে এই দাবি জানিয়েছেন দেশের নারী, মানবাধিকার এবং উন্নয়ন সংগঠনের নেতাকর্মীরা। ৬৮ নারী, মানবাধিকার ও উন্নয়ন সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত ‘সামাজিক প্রতিরোধ কমিটি’ এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে। সংবাদ সম্মেলন পরিচালনা করেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়েশা খানম। সংবাদ সম্মেলনের লিখিত বক্তব্যে জাতীয় নারী জোটের আহ্বায়ক আফরোজা হক রীনা বলেন, বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনের খসড়ায় ১৮ বছরের কম বয়সী কন্যা শিশুদের বিয়ে দেয়ার বিষয়ে ‘বিশেষ বিধান’ বহাল রাখা হয়েছে। আইন মন্ত্রণালয়ের লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগ মতামত দিয়ে খসড়াটি মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে। এই বিশেষ বিধান অনুযায়ী ‘কোন বিশেষ কারণে’র উদ্ভব হলে পিতামাতা বা অভিভাবকের সম্মতি অথবা আদালতের অনুমতিক্রমে ১৬ বছরের কন্যা শিশুর বিয়ে হলে সেটি বাল্যবিবাহ বলে গণ্য হবে না। এমন আত্মঘাতী সিদ্ধান্তে নারী, মানবাধিকার ও উন্নয়ন সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত ‘সামাজিক প্রতিরোধ কমিটি’ গভীর উদ্বেগ ও বিস্ময় প্রকাশ করছে এবং তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছে। তিনি আরও বলেন, ১৮ বছরের নিচে কন্যা শিশুর বিয়ের বিশেষ বিধান রাখলে তা হবে আন্তর্জাতিক শিশু অধিকার আইন (সিআরসি), আন্তর্জাতিক সিডও সনদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এই বিধান বহাল রেখে আইন পাস হলে তা টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রার তিন ও পাঁচ নং ধারার সঙ্গেও সাংঘর্ষিক হবে। বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক এ্যান্ড হেলথ সার্ভের সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, এক দশক ধরে দেশে ৬৬ শতাংশ ক্ষেত্রে ১৯ বছর বয়সের আগেই বাল্যবিয়ের শিকার নারীরা গর্ভবতী হচ্ছেন। এই বয়সসীমায় মা হওয়া ৩০ শতাংশ নারী এবং ৪১ শতাংশ শিশু অপুষ্টিতে ভুগছে। ২০১৪ সালের ইউনিসেফের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ১৫ বছরের কম বয়সী বিবাহিত মেয়েদের ২০ শতাংশ ২৪ বছর বয়স হওয়ার আগেই দুই বা ততোধিক সন্তানের মা হচ্ছেন। ফলে তাদের ক্ষেত্রে প্রসূতি মৃত্যুর হার এবং অপুষ্টিজনিত সমস্যা বেশি হচ্ছে। বিভিন্নমুখী নেতিবাচক অভিজ্ঞতা জানা সত্ত্বেও কেন নতুন করে একটি পশ্চাৎমুখী সিদ্ধান্তের কথা ভাবা হচ্ছে প্রশ্ন তুলে তিনি আরও বলেন, এই সিদ্ধান্ত নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে ব্যাপক ও চরম নেতিবাচক ক্ষেত্র তৈরি করবে। বাল্যবিবাহ সংঘটিত হওয়ার মূল কারণসমূহ দূর করার জন্য সরকার ও সমাজকে বহুমুখী পদক্ষেপ নিতে হবে। বিয়ের বয়স কমিয়ে নয়, প্রয়োজনীয় প্রাসঙ্গিক বিভিন্ন রাষ্ট্রীয়, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক পদক্ষেপ আরও বৃদ্ধি করে সেইসব বাধা দূর করা সম্ভব। মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকির এক মন্তব্যের সমালোচনা করে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়েশা খানম বলেন, আপনি বলেছেন এটি করলে ‘সামাজিক সমস্যা কমে যাবে।’ কিন্তু এই বয়সে একটি মেয়ের বিয়ে হলে যে মাতৃমৃত্যু বেড়ে যাবে, শিশুমৃত্যু হার বেড়ে যাবে, সেদিকে তো কেউ লক্ষ্য করছে না। এই বয়সে বিয়ে হলে একজন নারী সামাজিকভাবে একটি ‘দুষ্টু চক্রে’ আবদ্ধ হয়ে যাবে। সে সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিকভাবে কখনও আত্মনির্ভরশীল হতে পারবে না। জনগণের নির্বাচিত একজন প্রতিনিধি হিসেবে আপনারা প্রয়োজনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করুন। এটিই প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্র। কোনভাবেই ১৮ বছরের আগে কোন নারীর বিয়ে হতে পারবে না। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এবং গণস্বাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, আজ এমন একটা সময়ে আমরা প্রতিবাদ করছি, এই ডিসেম্বর মাসেই আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছিলাম। আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা যে বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন তা ধূলিসাত করে দেয়া হচ্ছে। অবস্থা এমন যে মাথা ব্যথা তাই মাথা কেটে ফেলে দিতে হবে। তিনি আরও বলেন, আমার প্রশ্ন নীতি-নির্ধারকদের মধ্যে কারা এই সিদ্ধান্ত নিলেন বা তাদের মাথায় কেন বিষয়টি এমনভাবে ধরা পড়ল? হয় তো তাদের বোঝানো হয়েছে এই আইন বাস্তবায়িত হলে বাল্যবিবাহের হার কমে যাবে কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে এর ফল খুবই ভয়াবহ হবে। অতএব এমন কোন অবস্থানে যাবেন না, যাতে করে আমাদের আন্দোলনে নামতে হয়। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সিনিয়র উপ-পরিচালক এ্যাডভোকেট রওশন জাহান পারভীন বলেন, এই সিদ্ধান্ত নারীর সব অধিকার খর্ব করার সিদ্ধান্ত। আমরা কখনই এটি মেনে নেব না। এই বিষয়ের সঙ্গে কখনই আপোষ করব না। যতদিন প্রয়োজন আন্দোলন করে যাব। স্টেপস টুওয়ার্ডস ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক রঞ্জন কর্মকার বলেন, আইনের ১৬নং ধারা খোদ মূল আইনের সঙ্গেই সাংঘর্ষিক। এটি মূল আইনকে অকার্যকর করে দেবে। কর্মজীবী নারীর নির্বাহী পরিচালক রোকেয়া রফিক বেবি বলেন, নারীকে আঠারো বয়সের আগে বিয়ে দিলে, নারী নিজেকে প্রস্তুত করতে সময় পায় না। সরকার এতদিন নারীর ক্ষমতায়ন ও উন্নয়নের জন্য যতকিছু করেছে, এই আইন পাস হলে তার সবকিছু অর্থহীন হয়ে যাবে। প্রকৃত অর্থে এদেশে আঠারোর নামে ১৬ বছরের মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেয়া হয়। এই ধারা নিয়ে আইন পাস হলে কার্যত ১৪ বছরেই মেয়েদের বিয়ে দেয়া শুরু হবে। দীপ্ত ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক জাকিয়া কে হাসান বলেন, আমরা অত্যন্ত ক্ষুব্ধ। এতদিন ধরে নারীর যত অর্জন তা এই আইন পাস হলে ভূলণ্ঠিত হবে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিবেদনে আমরা চমৎকার-চমৎকার কথা বলছি, অথচ এই আইন এগুলোর সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
×