ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সংস্কৃতি সংবাদ

চৌরাসিয়ার বাঁশির সুরে শেষ হলো উচ্চাঙ্গসঙ্গীত উৎসব

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ২ ডিসেম্বর ২০১৫

চৌরাসিয়ার বাঁশির সুরে শেষ হলো উচ্চাঙ্গসঙ্গীত উৎসব

মনোয়ার হোসেন ॥ শাস্ত্রীয় সঙ্গীতানুরাগীদের মন রাঙিয়ে কেমন করে যেন কেটে গেল ঘোরলাগা পাঁচটি রাত। সুরের অনুরণনের শুরুটা হয়েছিল শুক্রবার। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের অমিত সুধা ছড়িয়ে বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসঙ্গীত উৎসব শেষ হলো মঙ্গলবার। মাঝে ঘটে গেল ৫০ ঘণ্টার সুরভ্রমণ। প্রতিদিন ১০ ঘণ্টা করে অনুষ্ঠিত হয়েছে ধ্রুপদী সঙ্গীতের বৈচিত্র্যময় পরিবেশনা। সন্ধ্যায় শুরু হয়ে রাত গড়িয়ে ভোরের সূচনালগ্ন পর্যন্ত আর্মি স্টেডিয়ামে বয়ে গেছে সুরেলা ঝড়। ওস্তাদ, প-িত, বিদূষী ও গুরুরা নানা পরিবেশনায় উজাড় করে উপস্থাপন করেছেন আপন শৈলী ও কারুকার্য। মোহাবিষ্ট কণ্ঠসঙ্গীতের সঙ্গে ঝঙ্কার তুলেছে সেতার, সরোদ, সন্তুর ও মধুময় বাঁশির অনন্য শব্দধ্বনি কিংবা উচ্চাঙ্গের অপরূপ নৃত্যশৈলী। চতুর্থতম উৎসবে নতুন সংযোজন হিসেবে শ্রোতাদের রাঙিয়েছে ওস্তাদ জাকির হোসেনের তবলার বোল। শোনা হয়েছে জয়ন্তী কুমারের পরিবেশিত সরস্বতী বীণার সুর। এমন বৈভবময় ভরপুর সুরভ্রমণে সিক্ত হয়েছে বিনিদ্র রজনী পার করা অগণন শ্রোতা-দর্শক। উৎসবে অংশ নিয়েছেন বাংলাদেশ ও ভারতের প্রায় ২০০ শিল্পী। মঙ্গলবার উৎসরে সমাপনী পরিবেশনার প্রধান আকর্ষণ ছিলেন বাঁশরিয়া প-িত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া। শেষ রাতে মঞ্চে আসেন উপমহাদেশের প্রবাদপ্রতিম এই বংশীবাদক। শুরুতে ধীর লয়ে বাজিয়ে যান এই শিল্পী। কিছুক্ষণের মধ্যেই উচ্চ লয়ে চড়িয়ে দেন সুর। শব্দতরঙ্গে ভেঙে যায় রাতের নিস্তব্ধতা। সুরেলা শব্দের অনুরণনে ঝড় বয়ে যায় শ্রোতার অন্তরাত্মায়। বাঁশির মধুর সুরে গভীর রাতটি ধাবিত হয় ভোরের পানে। রাতজাগা নির্ঘুম সঙ্গীতানুরাগীর অন্তরে ছড়িয়ে দেন প্রশান্তির ছোঁয়া। মোহনীয় পরিবেশনায় মন্ত্রমুগ্ধ সঙ্গীপিপাসুরা কয়েক দফা করতালির সঙ্গে দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানান এই কিংবদন্তি বংশীবাদককে। তাঁর বাঁশির সুরেই শেষ হয় চতুর্থতম উচ্চাঙ্গসঙ্গীত উৎসব। বেঙ্গল ফাউন্ডেশন আয়োজিত ও স্কয়ার নিবেদিত চিত্রশিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীকে উৎসর্গকৃত উৎসবের সমাপনী অধিবেশন শুরু হয় যথারীতি সন্ধ্যা ৭টায়। প্রথমেই পরিবেশিত হয় ধামার গান। অনিমেষ বিজয় চৌধুরীর পরিচালনায় সিলেটের দল গীতবিতান বাংলাদেশের শিল্পীরা মঞ্চে আসেন। তারা দেশ রাগে ধামার ও রাগ ভূপালিতে চতুরঙ্গ পরিবেশন করেন। অনিমেষ বিজয় চৌধুরীর সঙ্গে সহশিল্পী হিসেবে ছিলেন কুমকুম ভৌমিক, নূর-ই-আফরোজ, পরেশ চন্দ্র পাল, রুমা চন্দ, শাগুফতা হক, সুব্রত মিত্র ও সোনিয়া রায়। পাখওয়াজে ছিলেন আলমগীর পারভেজ। তানপুরায় অভিজিৎ কু-ু। পরিবেশনাটির সার্বিক তত্ত্বাবধানে ছিলেন অধ্যাপক ড. অসিত রায়। এরপর ভরতনাট্যম পরিবেশন করেন বিদূষী আলারমেল ভালি। ভরতনাট্যমের বিখ্যাত এই শিল্পী তার অনবদ্য পরিবেশনা দিয়ে মাতিয়ে রাখেন সবাইকে। তিনি রতি সুখসারী, উননুনীর ভিককিনান, মাততাভাদদুরা পরিবেশন করেন। আভোগী রাগে নৃত্যলহরী পরিবেশনের মধ্য দিয়ে শেষ করেন তার পরিবেশনা। শিল্পীর সঙ্গে পারকাশনে ছিলেন শক্তিভেল এম সুব্রামানিয়ম, সিমবলস বাজিয়েছেন ভি সি কেসাভালু, বেহালাতে ইশ্বর রামাকৃষ্ণণন এবং কণ্ঠ সঙ্গীতে সহযোগিতা করেন বসুধা রবি। শিল্পীদের হাতে উৎসব স্মারক তুলে দেন প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী। ভরতনাট্যম পরিবেশনা শেষে বসে উৎসবের সমাপনী আনুষ্ঠানিকতা। সমাপনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন ব্র্যাক ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান স্যার ফজলে হাসান আবেদ। বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিকবিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী, বিনিয়োগ বোর্ডের এক্সিকিউটিভ চেয়ারম্যান ড. সৈয়দ এ সামাদ। অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার পঙ্কজ শরণ ও ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আনিসুল হক। স্বাগত বক্তব্য রাখেন বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আবুল খায়ের। সভাপতিত্ব করেন এমেরিটাস অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান। প্রধান অতিথির বক্তব্যে ফজলে হাসান আবেদ বলেন, এই উৎসবে আমরা চিত্রশিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীকে হারিয়েছি। এবারের উৎসবটি তাই তাঁকে উৎসর্গ করা হয়েছে। এ উৎসব দেশে শুদ্ধ সঙ্গীতের জাগরণ সৃষ্টি করেছে। এর ফলে নতুন প্রজন্ম উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের প্রতি আরও বেশি উৎসাহিত হবে। সভাপতির বক্তব্যে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের গুরুত্ব তুলে ধরে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় পাঞ্জাবে নৃশংস হত্যাকা-ের ঘটনা ঘটেছিল। তখন ওস্তাদ আবদুল করিম খাঁ বলেছিলেন, ভারতের ঘরে ঘরে যদি উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের চর্চা হতো তাহলে এমন ঘটনা ঘটতো না। সঙ্গীত বা সুকুমার চর্চার বিকাশ ঘটলে মানুষ হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে যায়। ভারতে বা উপমহাদেশে উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের যে সাধনা হয় তা মুসলমান ও হিন্দু সমাজের যৌথ অবদান। এই উৎসবকে অনন্য উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, দেশী-বিদেশী শিল্পীরা এখানে এসে পাঁচ দিন ধরে তাঁদের নানা পরিবেশনা মেলে ধরছেন। শুধু তাই নয় তাঁরা এখানে খুবই নিরাপদে অবস্থান করছেন। পরিবেশনা শেষে আবার নিজ দেশে নিরাপদে ফিরে যাচ্ছেন। তিনি আরও বলেন, একটি উৎসবে পাঁচ দিন ধরে হাজার হাজার মানুষ মনের আনন্দে সঙ্গীত উপভোগ করছেÑএটা একটা অসামান্য ঘটনা। স্বাগত বক্তব্যে আবুল খায়ের বলেন, এ উৎসবের চতুর্থ দিন সোমবার ৫৬ হাজার মানুষের সমাগম ঘটেছে। এদের মধ্যে অনেকে শিক্ষার্থীও ছিলেন। তাঁদের ভেতরে ভাল গান প্রবেশ করলে দেশকে তারা আরও ভালভাবে সাজাতে পারবে। দেশে উচ্চাঙ্গসঙ্গীত চর্চার বিকাশে গড়ে তোলা হয়েছে বেঙ্গল পরম্পরা সঙ্গীতালয়। সেখানে ভারতের ১৭ জন সঙ্গীত শিক্ষক এদেশের ১০৫ জন সঙ্গীত শিক্ষার্থীকে উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের তালিম দিচ্ছেন। পঙ্কজ শরণ বলেন, দুই দেশের সংস্কৃতির ধারা এক। একে অবলম্বন করে আমরা এগিয়ে যেতে পারব। সংস্কৃতিকে অবলম্বন করে দৃঢ় হবে আমাদের বন্ধন। সংস্কৃতির আশ্রয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের সেই বন্ধন সারাবিশ্বে উদাহরণ হয়ে থাকবে। আনিসুল হক বলেন, কেবল অন্ধকার ও হতাশার কথা বললেই হয় না, একটি আলো অন্তত জ্বালাতে হয়। এই কাজটিই করছে বেঙ্গল ফাউন্ডেশন। পৃথিবীর আর কোন দেশে এতো সুন্দরভাবে হাজার হাজার মানুষের এভাবে গান শোনার নজির নেই। সমাপনী পর্ব শেষে আবার সঙ্গীতের মূর্ছনায় ভেসে যাওয়ার পালা। ময়মনসিংহের গৌরীপুরের প্রবাদপ্রতিম সেতারবাদক ওস্তাদ বিলায়েত খাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র ইরশাদ খান পরিবেশন করেন ‘সুরবাহার’। কানাডাবাসী ইরশাদ খান তার প্রজন্মের একজন স্বনামধন্য সুরবাহার শিল্পী। ইরশাদ খানের অসাধারণ প্রায়োগিকজ্ঞান ও মানসিক বোধ তার বাদনকে নিয়ে গেছেন এক ভিন্ন উচ্চতায়। এরপর মঞ্চে আসেন সামিহান কশলকর। গোয়ালিয়র ঘরানার এই শিল্পীর কণ্ঠের খেয়াল ছিল বেশ উপভোগ্য। দীর্ঘক্ষণ আলাপের মধ্য দিয়ে পরিবেশন করেন রাগ যোগ। বিলায়েত খাঁর পুত্র ওস্তাদ সুজাত খান পরিবেশন করেন সেতার। ইমদাদখানি ঘরানার স্বনামধন্য কণ্ঠশিল্পী ও সেতারবাদক ওস্তাদ সুজাত খান। তিনি যে রীতিতে সেতার বাদন করেন তা গায়কী অঙ্গ হিসেবে পরিচিত। তার সেতার বাদনে কণ্ঠের অনুকরণের চেষ্টা বেশ আনন্দ দিয়েছে শ্রোতাদের। এরপর মঞ্চে আসেন এই উৎসবের আরেক আকর্ষণ ওস্তাদ রশিদ খান। রামপুর সহস ওয়ান ঘরানার শিল্পী রশিদ খানের তার কন্ঠ মাধুর্য দিয়ে মাতিয়ে রাখেন সবাইকে। ওস্তাদ রশিদ খান তার বিশিষ্ট গায়কির জন্য বিশ^জুড়ে খ্যাতি অর্জন করেছেন। পদ্মশ্রী সম্মাননায় ভূষিত এই শিল্পীর কণ্ঠে কারুকার্যে মেতেছিল পুরো স্টেডিয়াম। সব শেষে ছিল প-িত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়ার বাঁশির অনবদ্য পরিবেশনা।
×