ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

প্রাণ গোপাল দত্ত

চিকিৎসা শাস্ত্রে প্রযুক্তি

প্রকাশিত: ০৩:৫১, ২ ডিসেম্বর ২০১৫

চিকিৎসা শাস্ত্রে প্রযুক্তি

প্রযুক্তি ও চিকিৎসা। প্রযুক্তির আবিষ্কার হয়েছে মানুষের দৈহিক, কায়িক পরিশ্রমকে আরও সহজ থেকে সহজতর করে তোলার জন্য, কাজকে সঠিক এবং নিপুণভাবে করার জন্য। প্রযুক্তি মানুষকে সময় বাঁচাতে সাহায্য করছে। আরও সাহায্য করছে সময়ের অপব্যবহার রোধ করতে। প্রযুক্তির গুণে মানুষ আজ অসম্ভবকে সম্ভব করছে। অসাধ্যকে সাধ্যের ভেতর নিয়ে আসছে। আর যদি এ প্রযুক্তির অপব্যবহার হয় তাহলে মানুষের জীবন যেমন দুর্বিষহ হতে পারে, মানুষের জীবনের আর্থিক ব্যয়ভারও ঠিক একইভাবে বেড়ে যেতে পারে। যেহেতু আমি একজন চিকিৎসক। চিকিৎসা বিদ্যার সঙ্গে প্রযুক্তির যে সম্পর্ক তাই নিয়ে আমি কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি এবং সেটাই যদি আমরা দেখি, আমরা দেখতে পাই বিগত দেড় দশক ধরে চিকিৎসা বিজ্ঞানে প্রযুক্তিগত এক আমূল পরিবর্তন হয়ে গেছে। আমরাও যখন চিকিৎসা বিদ্যার ছাত্র ছিলাম, আমাদের ডাক্তারি জীবন যখন শুরু হয়েছিল তখনও আল্ট্রাসনোগ্রাফি পরীক্ষাটা এ দেশে ছিল না বললেই চলে। আল্ট্রাসনোগ্রাফি দিন দিন অনেক বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে। মনো ডাইমেনশন থেকে সেটি টু ডাইমেনশন, থ্রি ডাইমেনশন, এমনকি শেষ পর্যন্ত এটা ফোর ডাইমেনশনে এসে স্থান নিয়েছে। আমি যদি স্বাভাবিকভাবে একটা প্রেগনেনসিকে কল্পনা করি, একজন ভদ্র মহিলা প্রেগনেনসি নিয়ে কোন চিকিৎসকের কাছে আসলে তাকে আমি কতবার আল্ট্রাসনোগ্রাফি করব। আমরা যারা ক্লিনিক্যালি জ্ঞান অর্জন করেছি তাদের কাছে এ প্রযুক্তি একটা সহায়কের ভূমিকা পালন করবে। জন্মের তিন মাসের মধ্যে প্রথম আল্ট্রাসনোগ্রাফি আমরা করতে পারি, যা দিয়ে আমরা জন্মগত ত্রুটি, ভ্রƒণের আনুপাতিক বৃদ্ধি দেখতে পারি। তার পরেও ছয় মাসে বা নয় মাসে আমরা যথাক্রমে জন্মগত ত্রুটি, আনুপাতিক বৃদ্ধি হওয়া বা না হওয়া দেখে নিতে পারি মাকে নিশ্চিত করার জন্য, আমার জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করার জন্য। আমি এটা করতে পারি। কিন্তু প্রতি মাসে আল্ট্রাসনোগ্রাফি, যতবার ডাক্তার দেখাবেন ততবারই করাÑ এটা কোন অবস্থাতেই যুক্তিসঙ্গত নয় এবং প্রফেশনালও নয়। সে ক্ষেত্রে প্রযুক্তি বাণিজ্যিক রূপ লাভ করতে পারে। তারপর ধরুন, এমআরআই এবং সিটিস্ক্যান। এমআরআই এবং সিটিস্ক্যান করতে গেলে আমরা সাধারণত যা দেখি তার প্রয়োজনীয়তা, কখন করতে হবে সেই জিনিসটাকে নিজের বিবেক, রোগীর সার্বিক অবস্থা দিয়ে বিবেচনা করে তারপর আমাদের বলতে হবে। সামান্য কারণে এমআরআই রোগীর জন্য শুধু অসম্ভব ব্যয়বহুল একটি পরীক্ষাই নয়, রাষ্ট্রীয় অর্থেরও অপচয়। কারণ ফিল্মগুলো সবই আমদানি করা। তাছাড়াও প্রতিটি বীঢ়ড়ংঁৎব-এর সঙ্গে মেশিনের আয়ুষ্কালও কমতে থাকে। এমনিভাবে সিটিস্ক্যানও আমাদের করার আগে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে চিন্তা করা উচিত। এই সিটিস্ক্যান আমি করব কিনা, ৬৪ ঝষরপব, ১২৮ ঝষরপব সিকিস্ক্যান করে আমি রোগীকে যে রেডিয়েশন দিচ্ছি সে রেডিয়েশনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্বন্ধেও আমাকে সচেতন থাকতে হবে। ম্যাগনেটিক রেজনেন্স ইমেইজিং-এর প্রযুক্তি আর মোবাইল ফোনের ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ইমপালস এ দুয়ের মধ্যে বেশ সাদৃশ্য যেমন রয়েছে, তেমনি পার্থক্যও আছে। ধরে নেয়া হয় যে, ম্যাগনেটিক রেজনেন্স ইমেইজিং অর্থাৎ এমআরআই তেমন বেশি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখায় না। কিন্তু মোবাইল ফোনের ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ইমপালস মানুষের কানে যে বিভিন্ন উপসর্গের সৃষ্টি করে এটা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত। যদিও সুনির্দিষ্ট তথ্য-উপাত্ত আমরা এখনও উপস্থাপন করতে পারিনি যে, একসেসিভ মোবাইল ইউজের জন্য ব্রেইন টিউমারের মতো দুরারোগ্য ব্যাধি হতে পারে। তবে নিঃসন্দেহে বলা যায় অথবা একজন নাক, কান, গলা রোগ বিশেষজ্ঞ হিসেবে রোগীদের আধিক্য এবং উপস্থিতি দেখে মনে হয় যে, এসব রোগী মোবাইল ফোনের জন্য কানে শোঁ শোঁ ভোঁ ভোঁ আওয়াজ শোনে, দ্বিতীয়ত তারা কানে কিছুটা কম শোনে এবং অতিরিক্ত মাত্রায় মোবাইল ইউজের জন্য শব্দের প্রতি তাদের বিরূপ প্রতিক্রিয়া অর্থাৎ শব্দের প্রতি অসংবেদনশীলতা (ওহঃড়ষবৎধহপব ঃড় ংড়ঁহফ ফবাবষড়ঢ়) সৃষ্টি করে। এসব মিলে আমরা নিঃসন্দেহে বলতে পারি, অতিমাত্রায় মোবাইল টেলিফোনের ব্যবহার একটি ক্ষতিকারক প্রযুক্তি। যদিও এই মোবাইল আজকে যোগাযোগের জন্য এক যুগান্তকারী বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছে। কোন চিকিৎসক, বিশেষজ্ঞ সার্জন, রোগী দেখা, এমনকি অপারেশনের সময় অতিমাত্রায় টেলিফোনে কথা বলেন বা সব কল গ্রহণ করে জবাব দেবার চেষ্টা করেন, ফলশ্রুতিতে ভুল হবার সম্ভাবনা থাকে অনেক বেশি। যেখানে একটি ভুল একজন রোগীর জীবন ধ্বংস করে দিতে পারে। চিকিৎসা শাস্ত্রে প্রযুক্তির নতুন নতুন আবিষ্কারের ফলে আমরা এখন ক্লিনিক্যাল নির্ভরশীলতা অর্থাৎ চোখের দেখা এবং হাতের অনুভূতি সম্পূর্ণভাবে ভুলে যাচ্ছি এবং প্রযুক্তির ওপর বেশিরভাগই নির্ভর করছি। যে কোন ল্যাবরেটরির টেস্ট সেটা সংখ্যায় অপ্রতুল হলেও অথবা তার গড় হার অনেক কম হলেও ভুলের সম্ভাবনাও অবশ্যই থেকে যায়। তাই যখনই আমরা এই ল্যাবরেটরির পরীক্ষার ওপর পুরোমাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে যাই তখন রোগ নির্ণয় প্রেসক্রিপশান ল্যাবরেটরি ফাইন্ডিং-এর ভুলের ওপরে ভিত্তি করে আমাদের রোগ নির্ণয়কে ভুল করে দিতে পারে। আমি এখনও মনে করি যে, চিকিৎসা বিদ্যায় ক্লিনিক্যাল আই অত্যন্ত সুদৃঢ়ভাবে এবং বিচক্ষণতার সঙ্গে প্রয়োগ করা উচিত এবং প্রাথমিক রোগ নির্ণয় ক্লিনিক্যাল ডায়াগনাইসিস দিয়েই শেষ করা উচিত। তার কনফারমেশনের জন্য ল্যাবরেটরি টেস্টের আংশিক বা প্রয়োজনীয় সাহায্য নেয়া যেতে পারে। লেখক : সাবেক ভিসি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়
×