ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

যক্ষ্মা : অতীত ও বর্তমান

প্রকাশিত: ০৪:২৬, ১ ডিসেম্বর ২০১৫

যক্ষ্মা : অতীত ও বর্তমান

টিউবারকুলোসিস বা যক্ষ্মা একটি প্রাচীন অবহেলিত রোগ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক পরিসংখ্যান অনুসারে ২০১৩ সালে ৯ (নয়) মিলিয়ন নতুন যক্ষ্মা রোগী নির্ণয় করা হয়েছিল এবং ঐ সালে ১.৫ মিলিয়ন যক্ষ্মা রোগী মারা যান। এদের মধ্যে আবার ৩,৬০,০০০ ব্যক্তি এইডস রোগেও আক্রান্ত হয়। বাংলাদেশে প্রতিদিন নতুন ৮৮০ ব্যক্তির যক্ষ্মা নির্ণয় করা হয় এবং প্রতিদিন ১৭৬ জন এই রোগে মারা যান। বর্তমানে আমরা ও সারা বিশ্ব মাল্টি ড্রাগ রেজিস্টেন্ট টিবি (গউজ-ঞই), এক্সটেন্সসিভলি ড্রাগ রেজিস্টেন্ট টিবি (ঢউজ-ঞই) ও টোটাল ড্রাগ রেজিস্টেন্ট টিবি (ঞউজ-ঞই) এর মতো ভয়াবহ যক্ষ্মা রোগ মোকাবেলা করা হচ্ছে। ২০১০-২০১১-এর এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশে গউজ-ঞই তে আক্রান্তদের ১.৪% নতুন ও ২৮.৫% পুনঃ চিকিৎসা প্রাপ্ত। বর্তমানে রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসার ক্ষেত্রে অতীব উন্নতি সাধিত হয়েছে। আমরাও এখন বেশকিছু আধুানিক রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা পদ্ধতি প্রয়োগ করছি। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট : প্রাগ ঐতিহাসিক যুগে (১৭ হাজার বছর আগের) যক্ষ্মার প্রমাণ মিলেছে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাচারাল ট্রাপকেভ, ইওমি-এ। প্রাচীনতম লিখিত প্রমাণ পাওয়া যায় খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতাব্দীতে আসিরিয়ান সমরাজ্যের সময়কালে। যাতে লেখা ছিল রোগীরা ঘনঘন কাশি দেয়, তাদের কফ ঘন হয় ও মাঝে মাঝে তাতে রক্ত থাকে। রোগীরা প্রচুর ঘামে ও রোগ যখন প্রকট হয় তখন তারা ডায়রিয়ায় ভোগে। হিপোক্রাটিস, গ্লান ও ইসহাক জানুর লেখাতে যক্ষ্মা সম্পর্কে জানা যায়। রবার্ট কক ১৮৮২ সালে ২৪ মার্চ ( বিশ্ব যক্ষ্মা দিবস) প্রথম যক্ষ্মা জীবাণু আবিষ্কার করেন। ১৮৯০ সালে তিনি যক্ষ্মা নির্ণয় করার জন্য টিউবারকুলিন আবিষ্কার করেন। ১৮৯৫ সালে রনজেন ঢ-জধু আবিষ্কার করেন। যার মাধ্যমে ফুসফুসের যক্ষ্মা নির্ণয় দ্রুত ও সহজতর হয়। মিসরের রাজা তুতেন হামেন, ডকহলিডে, রড্রিক চোপেন, পাকিস্তানের মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ও কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের মতো বিখ্যাত ব্যক্তিরা যক্ষ্মা রোগে মারা গেছেন বলে জানা যায়। যক্ষ্মার লক্ষণসমূহ : দীর্ঘদিনের কাশি, কাশির সঙ্গে কফ, জ্বর, রাত্রিকালীন ঘাম, রুচি কমে যাওয়া এবং ওজন কমা যক্ষ্মা রোগের লক্ষণ। কাশির সঙ্গে মাঝে মাঝে রক্তও যেতে পারে। যক্ষ্মা নির্ণয় : কফ, মূত্র, পাকস্থলী থেকে সংগৃহীত রস, মেরুদ- থেকে সংগৃহীত তরল- এর অঋই- ঝঃধরহরহম পরীক্ষা। বর্তমানে প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ নির্ণয়ের জন্য গোল্ড কোয়ান্টে ফেরন টেস্ট, টি-স্পট টেস্ট ব্যবহৃত হচ্ছে। এলইডি ফ্লুরোসেন্স মাইক্রোসকপির মাধ্যমে সহজে টিবি জীবাণু নির্ণয় করা যাচ্ছে। রক্তরসসহ শরীরের বিভিন্ন তরলের এডিএ নির্ণয়ের মাধ্যমে যক্ষ্মা রোগ চিকিৎসা প্রদান সহজতর হচ্ছে। এছাড়াও বাংলাদেশে বর্তমানে কফ ও বিভিন্ন টিস্যুর জীনএক্সপার্ট টেস্ট, পিসিআর, কালচার (সলিড ও লিকুইড) ও ড্রাগ সাসপটিবিলিটি টেস্ট পরীক্ষার মাধ্যমে যক্ষ্মার জীবাণু নির্ণয় ও এরা কোন ওষুধের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে কি-না জানা সহজ হয়েছে। ফলে গউজ-ঞই, ঢউজ-ঞই রোগী নির্ণয় ও চিকিৎসা প্রদান করা যাচ্ছে। পূর্বে সেনেটোরিয়ামে বিশুদ্ধ বাতাস, পর্যাপ্ত পুষ্টি ও ভেষজ ওষুধের মাধ্যমে চিকিৎসা করা হতো। বর্তমানে পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাদ্য প্রদান ও নন-রেজিস্ট্রেন্ট টিবির জন্য ৬ মাস বা ৯ মাসব্যাপী চিকিৎসা দেয়া হয়। গউজ-ঞই জন্য কমপক্ষে ২০ মাস ও ঢউজ-ঞই-এর জন্য কমপক্ষে ২৪ মাসের চিকিৎসা দেয়া হয়। এই দীর্ঘ চিকিৎসা প্রদানের সময় অনেক রোগী ঠিকমত ওষুধ নেন না বা হারিয়ে যান। যা সমাজের জন্য হুমকিস্বরূপ। তাই নতুন ওষুধ ও স্বল্পকালীন চিকিৎসা পদ্ধতি সময়ের দাবি। বর্তমানে বেশকিছু নতুন ওষুধ (যেমন- ব্যাডাকুইলিন, ডিলামানিড) ও স্বল্পকালীন চিকিৎসা পদ্ধতি ট্রায়েলের পর বাস্তব প্রয়োগের পর্যায় রয়েছে। বাংলাদেশের মতো উন্নতশীল দেশে যক্ষ্মা নির্মূল খুবই দুরূহ বিষয়। তথাপি যক্ষ্মা সম্পর্কে সাধারণ জনগণ, মাঠকর্মী ও চিকিৎসকদের মধ্যে যক্ষ্মার ভয়াবহতা (গউজ-ঞই, ঢউজ-ঞই), প্রতিরোধ সম্পর্কে পর্যাপ্ত সচেতনতা সৃষ্টির পাশাপাশি দ্রুত ও নির্ভরযোগ্য রোগ নির্ণয় পদ্ধতি মাঠপর্যায়ে ছড়িয়ে দিলে যক্ষ্মা রোগী নির্ণয় ও চিকিৎসার মাধ্যমে এসব ভয়াবহ যক্ষ্মা রোগের বিস্তার রোধ করাও সম্ভব। ডাঃ বশীর আহাম্মদ সহযোগী অধ্যাপক, বক্ষব্যাধি বিষেশজ্ঞ, জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল
×