ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বিশ্ব এইডস দিবস;###;অধ্যাপক ডা. মো. নজরুল ইসলাম

এইডস প্রতিরোধে প্রয়োজন সচেতনতা

প্রকাশিত: ০৪:০৭, ১ ডিসেম্বর ২০১৫

এইডস প্রতিরোধে প্রয়োজন সচেতনতা

আজ থেকে ৩৪ বছর আগে ১৯৮১ সালে ডা. গটলিয়েব আমেরিকার সমকামীদের মধ্যে এইডসের প্রথম রিপোর্ট প্রকাশ করেন। তখনও জানা যায়নি এইডস একটি ভাইরাসজনিত অসুখ। সমকামীদের মধ্যে ডায়রিয়ার প্রাদুর্ভাব দেখা দেয় এবং চিকিৎসা করে তাদের বাঁচানো যায়নি। কিছু সমকামীর মধ্যে দেখা দিল ঘুষঘুষে জ্বর, অরুচি ও ওজন কমে যাওয়া, রাতে শরীর ঘেমে যাওয়া, শরীরের লসিকা গ্রন্থি ফুলে যাওয়া ও অস্বাভাবিক ধরনের ম্যালিগন্যান্ট টিউমার কেপোসিস সারকোমা। ম্যালিগন্যান্ট টিউমার কেপোসিস সারকোমা সাধারণত ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের রোগ। এটি দেখা যায় বুড়ো মানুষের পায়ে। কিন্তু গটলিয়েবের রোগীরা আমেরিকান (ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের নয়), সবাই বয়সে তরুণ এবং শরীরের যে কোন জায়গায় এটা দেখা দেয়। তাই এটাকে বলা হয় অস্বাভাবিক কেপোসিস সারকোমা। আরেকটি অতি দুর্লভ অসুখ সমকামীদের মধ্যে পাওয়া গিয়েছিল। অসুখটির নাম নিউমোসিসটিস কারিনি নিউমোনিয়া রোগটি কদাচিৎ দেখা যেত রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাসপাপ্ত মানুষের মধ্যে। কেমোথেরাপির সাহায্যে ক্যান্সার চিকিৎসার সময় রোগীদের মধ্যে ইমিউন ডেফিসিয়েন্সি সৃষ্টি হয়। ১৯৬৭ থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত বারো বছরে আমেরিকাতে এসব রোগীর মধ্যে ২টি নিউমোসিসেটিস কারিনি আক্রান্ত রোগী পাওয়া যায়। পক্ষান্তরে ডা. গটলিয়েব ৮ মাসে ৫টি নিউমোসিসটি কারিনি নিউমোনিয়া রোগী পেলেন সমকামীদের মধ্যে এবং যথারীতি এদেরও মৃত্যু হয়েছিল। কিছুদিনের মধ্যে বোঝা গেল, অরক্ষিত যৌন মিলনই এইডস ছড়ানোর প্রধান কারণ। এছাড়া রক্ত পরিসঞ্চালন ইনজেকশনের নিডল সিরিঞ্জ, শল্য চিকিৎসা, দাঁতের চিকিৎসা, কান ফোঁড়ানো, নাক ফোঁড়ানো, উল্কি আঁকার মাধ্যমেও অওউঝ ছড়াতে পারে। ১৯৮৩ সালে চধৎরং এর চধংঃবঁৎ ওহংঃরঃঁঃব-এর অধ্যাপক লুক মনটেনার এক অওউঝ রোগী থেকে (যিনি খুসঢ়য ধফবহড়ঢ়ধঃযু তে ভুগছিলেন) এক প্রকার রেট্রো ভাইরাস আবিষ্কার করেন। তিনি ভাইরাসটির নাম রাখেন খুসঢ়যধফবহড়ঢ়ধঃযু অংংড়পরধঃবফ ঠরৎঁং বা খঅঠ। পরের বছর ১৯৮৪ সালে টঝঅ-এর ঈধহপবৎ ওহংঃরঃঁঃব-এর উরৎবপঃড়ৎ উৎ. জড়নবৎঃ এধষষড় অওউঝ রোগী থেকে আর একটি রেট্রো ভাইরাস আবিষ্কার করেন। তিনি এটির নাম রাখেন ঐঞখঠ-ওওও. উৎ. এধষষড় ১৯৮৫ সালে পরীক্ষা করে দেখেন যে, ভাইরাস দুটি একই ভাইরাস। সে বছরই ওহঃবৎহধঃরড়হধষ ঈড়সসরঃঃবব ভড়ৎ ঞধীড়হড়সু ড়ভ ঠরৎঁং এর জবঃৎড় ঠরৎঁং ংঁন ঈড়সসরঃঃবব ভাইরাসটির নাম রাখেন ঐঁসধহ ওসসঁহব উবভরপরবহপু ঠরৎঁং বা ঐওঠ। ১৯৮৬ সালে অধ্যাপক মনটেনার আফ্রিকান এক অওউঝ রোগী থেকে একটি ঐওঠ আবিষ্কার করেন যেটা ঋৎধহপব, ঊঁৎড়ঢ়ব এর অন্যান্য দেশ ও টঝঅ এর ঐওঠ থেকে কিছুটা আলাদা। ঐ বছরই হার্ভার্ড স্কুল অব মেডিসিনের ভাইরোলজি ডিপার্টমেন্টে আফ্রিকান এক অওউঝ রোগী থেকে একটি ঐওঠ আবিষ্কার করা হয় যা টঝঅ-এর ঐওঠ থেকে আলাদা। পরীক্ষা করে দেখা গেল, ঐওঠটি চধংঃবঁৎ ওহংঃরঃঁঃব-এর অধ্যাপক মনটেনারের আফ্রিকান ঐওঠটির সঙ্গে হুবহু মিল রয়েছে। সে বছরই ওহঃবৎহধঃরড়হধষ ঈড়সসরঃঃবব ভড়ৎ ঞধীড়হড়সু ড়ভ ঠরৎঁং-এর জবঃৎড় ঠরৎঁং ংঁন ঈড়সসরঃঃবব অসবৎরপধ, ঊঁৎড়ঢ়ব-এ সংক্রমিত ঐওঠটিকে ঐওঠ-১ এবং আফ্রিকান ঐওঠটিকে ঐওঠ-২ নামে অভিহিত করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সহায়তায় ১৯৮৭ সালে ওচএগজ-এর ভাইরোলজি বিভাগে ঐওঠ ঞবংঃ-এর খধনড়ৎধঃড়ৎু প্রতিষ্ঠিত হয়। তখন থেকে ঐওঠ শনাক্ত করার জন্য বাংলাদেশের ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর রক্ত এই খধনড়ৎধঃড়ৎুতে পরীক্ষা করা হয়। ১৯৮৭ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত প্রায় ১৪ হাজার ব্যক্তির রক্তের নমুনা পরীক্ষা করেও ঐওঠ পাওয়া যায়নি। ১৯৮৯ সালের শেষদিকে এক বিদেশী যিনি কিনা সোনা চোরাচালানের জন্য উযধশধ ঈবহঃৎধষ ঔধরষ-এ বন্দী ছিলেন তার রক্তে প্রথম ঐওঠ পাওয়া যায়। পরের বছর ১৯৯০ সালে দুজন বাংলাদেশীর রক্তে ঐওঠ পাওয়া যায়। তাদের একজন ৬ মাস পর মারা যান। তিনি জাহাজে চাকরি করতেন। অন্যজন মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে চাকরি করতেন। তিনি এখনও বেঁচে আছেন। ১৯৮৯ সালে ১, ১৯৯০ সালে ২, ১৯৯১ সালে ৬, ২০০০ সালে ৩১, ২০১০ সালে ৩৪৩, ২০১৪ সালে ৪৩৩ ঐওঠ আক্রান্ত রোগীর সন্ধান পাওয়া যায় বাংলাদেশে। ১৯৮৯ সাল থেকে ২০১৪ সালের ১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশে মোট ঐওঠ আক্রান্তের সংখ্যা ৩৬৭৪-এর মধ্যে ৫৬৩ জন মৃত্যুবরণ করেছেন। ২০১৪ সালে ৪৩৩ জন আক্রান্তের মধ্যে ২৩ (৫%) জনের বয়স ০-৯ বছর। প্রায় সবাই আক্রান্ত মায়ের থেকে সংক্রমিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৬ ঐওঠ আক্রান্ত অন্তঃসত্ত্বা মায়ের নিরাপদ পদ্ধতি প্রয়োগ করে বাচ্চা প্রসব করানো হয়েছে। এর মধ্যে ২২ শিশুকে মায়ের ঐওঠ থেকে রক্ষা করা গেছে। আর ৪ জনের টেস্ট এখনও শেষ হয়নি। যদি উপরোক্ত ২৩ মা নিরাপদ প্রসব সম্বন্ধে সচেতন থাকতেন বা জানতেন তবে তাদেরও নিরাপদ পদ্ধতিতে প্রসব করানো যেত এবং তাদের সন্তানরাও ঐওঠ মুক্ত হিসেবেই এই পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হতে পারত। ২০১৪ সালে ৪৩৩ আক্রান্তের মধ্যে ৪০৫ (৯৪%) জনের বয়স ১৯ বছরের বেশি, এর মধ্যে ৩২৩ (৭৫%) এর বয়স ২৫ থেকে ৪৯ বছর। এরা সবাই প্রায় অরক্ষিত যৌন মিলনের মাধ্যমে ঐওঠ আক্রান্ত হয়েছেন, যা কিনা কনডম ব্যবহারের মাধ্যমে প্রতিরোধ করা যেত। তারা সবাই সচেতনতার অভাবে ঐওঠ আক্রান্ত হয়েছেন। ঐওঠ সংক্রমণ : অনিরাপদ পদ্ধতিতে রক্ত পরিসঞ্চালন, ইনজেকশনের সুচ, সিরিঞ্জ, শল্য চিকিৎসা, দাঁতের চিকিৎসা, কান বা নাক ফোঁড়ানো, উল্কি লাগানোর মাধ্যমেও হতে পারে। তাই ঐওঠ সংক্রমণের পদ্ধতি সম্বন্ধে সচেতন হওয়া এবং দৈনন্দিন জীবনে এই সচেতনতা কাজে লাগানো ঐওঠ সংক্রমণ প্রতিরোধ করার প্রকৃষ্ট পদ্ধতি। লেখক : প্রাক্তন উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়
×