ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

আবু সুফিয়ান কবির

এমন একটা মা দেনা

প্রকাশিত: ০৭:০৩, ৩০ নভেম্বর ২০১৫

এমন একটা মা দেনা

১৯৭৫ সালের ২৪ ডিসেম্বর টিভির একটি বিশেষ সঙ্গীতানুষ্ঠানে ‘এমন একটা মা দেনা’ এই গানটি প্রথম প্রচারের পর ব্যাপক সাড়া পড়ে। সাদা-কালো টিভির জগতে সেই সময় মুখে মুখে গানটি রণিত হতে থাকে অজস্র তরুণের কণ্ঠে। প্রতিটি ব্যক্তির জীবনে মায়ের অস্বিত্ব এতটা প্রকট যে, মানুষ মায়ের মহত্ত্বকে লালন করে নিজ অন্তরে। বর্তমান রঙ্গিন টিভির জগতে ও আধুনিক সব প্রযুক্তির যুগে সন্তানদের সামনে যেমন নানান সম্ভাবনায় দুয়ার খুলে গেছে, তেমনি আছে অশুভ নানান বিষয়ের হাতছানি। এই সময় তাই মায়েদের আরও সচেতন হতে হবে, নিতে হবে যুক্তিযুক্ত প্রাসঙ্গিক সিদ্ধান্ত। সম্প্রতিক সময়ে এক মায়ের তৎপরতায় তার সন্তানকে পুলিশের হাতে সোদর্প করার ঘটনা আমারা দেখেছি। পাবনার ঈশ্বরদীতে ‘ফেইথ বাইবেল চার্চ’-এর যাজক লুক সরকার হত্যাচেষ্টায় জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠায় রকিবুল ইসলাম (২২) নামে এক তরুণকে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছেন মা আজমিরা খাতুন। ছেলের বিরুদ্ধে হত্যাচেষ্টা ও জঙ্গী-সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ ওঠায় ব্যথিত এই মা বাধ্য হয়ে দীর্ঘ ২২ বছর ধরে লালন-পালন করে বড় করা আদরের সন্তানের বিরুদ্ধে এই কঠিন নিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হন। এই মা আদর্শ মায়ের প্রতীক হয়ে থাকবেন সবার হৃদয়ে অনন্তকাল। এই মা বুঝতে পেরেছেন জঙ্গীবাদ হলো এমন এক বিষ, যা তরুণদের মধ্যে দ্রুত ছড়িয়ে দেয়া যায়। জঙ্গীবাদ একজন সহজ-সরল তরুণকে খুনীতে পরিতণ করে। এই বিষ ধ্বংস করেছে আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের সোনালী অধ্যায়। এই বিষ ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা চলছে বাংলাদেশে। তাই এই বিষ যেন না ছড়িয়ে পড়তে পারে সেই কারণে মায়েদের আজমিরা খাতুনের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে। যে সন্তান দেশের, সমাজের অস্তিত্বের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে প্রয়োজনে মায়েদের কঠোর ও কঠিন হতে হবে। আমরা সবাই বলতে চাই, আমাদের আজমিরা খাতুনের মতো ‘এমন একটা মা দেনা’, যে সন্তানকে লালন-পালন করে বড় করবে আবার আত্মঘাতী হয়ে পড়লে তাকে পুলিশে দিতেও দ্বিধাবোধ করবে না। সামাজে প্রতিটি গৃহে প্রতিটি দম্পতি সন্তান কমনা করে। একটি পরিবারে সন্তানের উপস্থিতি সেই পরিবারে শুধু কল্যাণ বয়ে আনে না, সেই সঙ্গে সেই গৃহে সৌন্দর্য বাড়িয়ে দেয়। মানবসন্তান পশু-পাখির মতো নয়, তাই মানবসন্তানকে আদর-যতœ, স্নেহ-মমতা ও শাসন দিয়ে বড় করতে হয়। বর্তমান যুগে সন্তান লালন-পালনে পরিবারের মায়েদের বিরাট দায়িত্ব রয়েছে। কেননা মায়েরা যেমন স্নেহপ্রবণ তেমনি তাকে প্রয়োজনে কঠোর শাসনের মধ্যে রাখতে হয়। ফলে সন্তান বিপথে যেতে পারে না। বর্তমান আধুনিক বিশ্বে অনেক অবারিত স্বপ্নের দার খুলে যাচ্ছে। সৃষ্টি হচ্ছে নানান সম্ভাবনা। সন্তানের সামনে যেমন সোনালী সম্ভাবনা হাতছানি দিচ্ছে, তার সঙ্গে আছে কালো দংশন। আজ তরুণ ও কিশোরদের বিভ্রান্ত করা হচ্ছে নানান স্বপ্নের কথা বলে। কাউকে আত্মঘাতী করে তোলা হচ্ছে। তাদের ঠেলে দেয়া হচ্ছে নানান কুপথে। কোন এক অজানা মোহে যেন আপনার সন্তান কোন অবস্থাতেই সন্ত্রাস বা জঙ্গীবাদের সঙ্গে জড়িয়ে না পড়ে সেদিক খেয়াল রাখার দায়িত্ব এখন মায়েদের। এক গবেষণায় দেখা গেছে, জন্ম নেয়ার পর থেকে যে সন্তান দুই বছর মায়ের সংস্পর্শে থাকে সে বুদ্ধিমান হয় অনেক বেশি। তাই সন্তানের সংস্পর্শে যতটুকু পারা যায় থাকার চেষ্টা করতে হবে প্রতিটা মাকে। সন্তানকে প্রথম থেকে বড় করতে তুলতে হবে আদর্শবান হিসেবে। পড়ালেখার পাশাপাশি সন্তানকে সমাজের সব বিষয়ের ওপর সচেতন করে তুলতে হবে। ভাল ও খারাপের মধ্য যেন পার্থক্য বুঝতে পারে তাই সন্তানকে মায়ের সময় দেয়া বেশ জরুরী। এক গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব সন্তান জন্মের পর দুই বছর মায়ের সংস্পর্শে থাকে সে খুব বুদ্ধিমান হয়। সব ধর্মের আদর্শে আছে সেবার বিষয়টি। অন্যের প্রতি প্রতিহিংসাপ্রবণ না হয়ে তাকে নিজের মহৎ গুণাবলী দিয়ে কিভাবে নিজের আয়ত্তে আনা যায় সেসব বিষয়ে শিক্ষা দেয়ার দায়িত্ব হচ্ছে প্রতিটা মায়ের। আপনার সন্তান যখন দ্বিতীয় বা তৃতীয় শ্রেণীর শিক্ষার্থী, তখন প্রয়োজন হলে তাকে মহানবীর শত্রুর সেবা গল্পটির সারমর্ম বুঝিয়ে দিন। সেই অনেক দিন আগের কথা। মহানবীর চলার পথে এক দুষ্ট বুড়ি কাঁটা পুঁতে রাখতেন। সেই পথে চলতে মাহনবী প্রতিদিন ক্ষতবিক্ষত ও রক্তাক্ত হতেন। কিন্তু মহানবী নীরবে পায়ের কাঁটা তুলে নিজ পথে চলে যেতেন। একদিন মহানবী দেখলেন তাঁর পথে কাঁটা নেই। তিনি ভাবলেন এই বুুড়ি হয়ত অসুস্থ হয়েছে। তাই তিনি বুড়ির বাড়িতে গেলেন। সেবা-যতœ করে বুড়িকে সুস্থ করে তুললেন। এটাই হলো মানুষের আদর্শ। কারও মতের বিরুদ্ধে গেলে তাকে হত্যা করতে হবে বা তাকে আঘাত দিতে হবে- এটা কখনও গ্রহণযোগ্য নয় বরং তাকে নিজ মহৎ গুণ দিয়ে কিভাবে সুন্দর পথে আনা যায় সেই চেষ্টাই চালাতে হবে। আর আপনার সন্তানকে আপনি এভাবেই শিক্ষা দিন। তাকে মানুষ করে তুলুন মহৎ আদর্শের গুণাবলী দিয়ে। শিশুর কোন সুন্দর আচরণ বা প্রশংসনীয় কাজ চোখে পড়লে তার প্রশংসা করতে হবে। এক্ষেত্রে তাকে পুরস্কারও দেয়া যেতে পারে। তার কাজের প্রশংসা করতে হবে অন্যের সামনেও। অন্যায় কিছু করলে, মিথ্যা বললে তা মানুষের সামনে না বলে বরং তার ভাল-মন্দ বিষয়ে জ্ঞান দিতে হবে। বাচ্চারা হর-হামেশা দুষ্টুমি করে থাকে। তখন তাকে শাসন করার সময় কোন অতিরিক্ত শব্দ ব্যবহার করা বা তার মনে আঘাত দেয় এ ধরনের কথা বলা যাবে না। অলসতা থেকে মুক্ত করতে বাচ্চাকে দিনের কিছু সময় হাঁটাচলা ও খেলাধুলায় অভ্যস্ত করতে হবে। বাবা-মার কিছু নিয়ে সন্তান যেন তার বন্ধু-বান্ধব ও সঙ্গী-সাথীদের বড়াই না করে সে বিষয়ে তাকে সচেতন করতে হবে। তাকে বরং বিনয়, সঙ্গীদের সম্মান এবং তাদের সঙ্গে কথাবার্তায় কোমলতার স্বভাব আনতে শেখাবেন। তাদের বোঝাবেন ত্যাগই সবচেয়ে বড় সম্মান। না বলে কারও কোন জিনিস নেয়া অমার্জনীয় অপরাধ। তাই তাকে সে বিষয়ে সচেতন করতে হবে। শিশুরা যখন বয়ঃসন্ধিক্ষণে আসে তখন তারা বাবা-মাকে গুরুত্ব দিতে চায় না। তারা যা করে তাতেই আনন্দ খুঁজে পায়। এই সময়টিতে মায়েদের উচিত সন্তানের খুব কাছাকাছি থাকা। এই সময় তাকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করতে মহৎ ব্যক্তিদের জীবন ও সংগ্রামের কাহিনী পড়ালে সে নিজেকে গড়ে তুলতে পারে। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমাদের যে স্বাধীনতা তার যে সঠিক ইতিহাস এবং সেই সঙ্গে এর সঙ্গে যে মহানায়কদের জীবনী তা সন্তানদের পড়তে উদ্বুদ্ধ করুন। দেশের সৃষ্টি ও এর যে অর্জন তার সঠিক ইতিহাসটা তাকে জানাবেন। তাহলে সে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হবে এবং ভবিষ্যত জীবনে একজন সৎ নাগরিক হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে পারবে। যে সত্য ইতিহাস জানে সে কখনও দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ে না। সে যদি দামী মোবাইল নেয়ার জন্য তার বন্ধুদের উদাহরণ দেয় তাহলে আপনি তাকে বরং যাদের মোবাইল নেই তাদের জীবনের নানান ভাল দিকের কথা বলবেন। আপনি ঘরে অন্যের সমালোচনা করলে সে মনে আদর্শ ধারণ করতে পারবে না। তাকে সংগ্রাম ও সাধনা করতে শেখান। তার কৌতূহলী মনের নানান প্রশ্নের সঠিক যুক্তিযুক্ত জবাব দিন। সে কতটুকু সফল না সফল নয় তা অন্য কোরও সঙ্গে তুলনা না করে বলবেন, তুমি ইচ্ছা করলে আরও সফল হতে পারবে, ইত্যাদি। ছবি : আরিফ আহমেদ মডেল : বাঁধন ও তার মেয়ে
×