ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

আবুল মাল আবদুল মুহিত

ছেলেবেলা ও ছাত্রজীবন

প্রকাশিত: ০৩:৩২, ৩০ নভেম্বর ২০১৫

ছেলেবেলা ও ছাত্রজীবন

ঢাকায় ছাত্রজীবনের সূচনা (২৯ নবেম্বরের পর) ২৩ তারিখের প্রেসনোটে সরকার জানায় যে, মাত্র ২ জন এদিন নিহত ও আহত হয় ৪৫ এবং আরও স্বীকার করে যে, কার্জন হলের মোড়, হাইকোর্টের গেট, নবাবপুর রোড এবং বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় পুলিশকে অবৈধ শোভাযাত্রা বন্ধ করতে পদক্ষেপ নিতে হয়। জনমনে ধারণা হয় যে, ২১ ফেব্রুয়ারি ৭ ও ২২ তারিখে ১০ জন মানুষ শাহাদত বরণ করে। এদের মধ্যে একমাত্র আবুল বরকত এবং সফিউর রহমানের আত্মীয়-স্বজন তাদের দাফন সম্পন্ন করেন। পূর্ববাংলা প্রাদেশিক পরিষদের বিবরণ অনুযায়ী পরিষদে ২০ তারিখে যখন বাজেট অধিবেশন শুরু হয় তখন ভাষা সমস্যা সম্বন্ধে বেশ কয়েকটি মুলতবি প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। এসব প্রস্তাবের বিষয়বস্তু ছিল অযৌক্তিকভাবে ১৪৪ ধারার নিষেধাজ্ঞা জারি করা, রাজবন্দী শেখ মুজিবুর রহমানের অনশন ধর্মঘট, পাকিস্তান অবজারভারের প্রকাশনার ওপর নিষেধাজ্ঞা এবং ভাষার বিষয়ে সরকারের সিদ্ধান্ত। জেনে রাখা ভাল যে, ভাষার বিষয়ে সরকার মওলানা আকরম খাঁর নেতৃত্বে ১৯৪৯ সালে ৯ মার্চে একটি কমিটি নিযুক্ত করে এবং তারা তাদের প্রতিবেদন দেন ১৯৫০ সালের ৭ ডিসেম্বর। কিন্তু সরকার সেই প্রতিবেদন প্রকাশ থেকে বিরত থাকে। ২১ তারিখে প্রাদেশিক পরিষদ অধিবেশন শুরু হয় গুলিবর্ষণের পরে এবং মওলানা তর্কবাগিশ তখন একটি মুলতবি প্রস্তাব পেশ করেন। কংগ্রেসের ৪ জন সদস্য এই বিষয়ে মুলতবি প্রস্তাব পেশ করতে চান। প্রস্তাবকদের প্রধান দাবি ছিল, মুখ্যমন্ত্রী অকুস্থলে যাবেন এবং প্রকৃত অবস্থা সম্বন্ধে পরিষদে বক্তব্য রাখবেন। মওলানা তর্কবাগিশ এইসব প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা না হওয়ায় পরিষদ থেকে বেরিয়ে যান। অন্যান্য সদস্য যারা প্রতিবাদ করেন তারা ছিলেন শামসুদ্দিন আহমেদ, বসন্ত দাস, ধীরেন্দ্র দত্ত, ভোলানাথ বিশ্বাস, শরফুদ্দিন আহমেদ, মসিহউদ্দিন আহমদ প্রমুখ। তারা কোন মুলতবি প্রস্তাব উত্থাপন করতে পারলেন না। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে কংগ্রেস দলের সব সদস্য এবং আরও কিছু সদস্য পরিষদ থেকে ওয়াক আউট করেন। তাদের সংখ্যা সংবাদ মাধ্যমের বিভিন্ন প্রতিবেদনে ১২ থেকে ৩৫ পর্যন্ত বলে জানা যায়। জেনে রাখা ভাল যে, তখন মোট পরিষদের সদস্যসংখ্যা ছিল ১৪৬ এবং সেদিনের উপস্থিতি ছিল মাত্র ৮৩ জন। আওয়ামী লীগের সদস্য ছিলেন আলী আহমদ খান, শামসুদ্দিন আহমদ, আনোয়ারা খাতুন, খয়রাত হোসেন এবং আলী আহমদ চৌধুরী। ২২ তারিখের প্রাদেশিক পরিষদ অধিবেশনে তর্কবাগিশ এবং খয়রাত হোসেন গত দিনের গুলিবর্ষণ সম্বন্ধে আলোচনার জন্য মুলতবি প্রস্তাব পেশ করেন। শহীদদের জন্য দুঃখ প্রকাশের উদ্দেশ্যে প্রস্তাব করেন আলী আহমদ খান। এইসব কোন প্রস্তাবই গ্রহণ করা করা হলো না। পরিবর্তে পরিষদ নেতা নুরুল আমিন বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার জন্য একটি সিদ্ধান্ত প্রস্তাব প্রদান করেন। কিন্তু একইসঙ্গে আরও বলেন যে, ১৪৪ ধারার নিষেধাজ্ঞা জারি করার প্রয়োজন ছিল এবং দুষ্কৃতকারীদের আইন অমান্য অনুচিত ছিল। এইটি নিয়ে বেশ আলোচনা হয়। কিন্তু নুরুল আমিনের প্রস্তাবই অবশেষে পাস হয়। ২২ থেকে ২৫ তারিখ পর্যন্ত ঢাকায় এবং অন্যান্য শহরেও একই ধরনের অসহযোগ আন্দোলন চলতে থাকে। সরকারী দফতরে লোকজনের উপস্থিতি খুবই সীমিত ছিল। ২২ তারিখে সংসদ সদস্য এবং আজাদের সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দিন প্রাদেশিক পরিষদ থেকে ইস্তফা দেন। চট্টগ্রামে বামপন্থী নেতা এবং লেখক মাহবুব-উল-আলম চৌধুরী ২২ তারিখে ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’ নামে একটি অসাধারণ কবিতা প্রকাশ করেন। সরকার সঙ্গে সঙ্গেই এই প্রকাশনাটি বাজেয়াপ্ত করেন এবং মাহবুব-উল-আলম চৌধুরী পালিয়ে গিয়ে আত্মরক্ষা করেন। পূর্ববাংলায় ২টি সংবাদ মাধ্যম মর্নিং নিউজ এবং সংবাদ এই আন্দোলনে ভারতীয় এবং কম্যুনিস্টদের হাত আছে বলে বিবৃতি দেয় এবং করাচীর উধহি পত্রিকা ৬ মার্চ ১৯৫২ সালে ঘোষণা করে যে, ২১ ফেব্রুয়ারির আন্দোলনটি ছিল একেবারেই রাষ্ট্রদ্রোহিতা। ২১ তারিখে সরকার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে সাবধান থাকতে বলে এবং অনুরোধ করে যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শীর্ষ ব্যক্তিরা যেন ছাত্রদের ১৪৪ ধারার নিষেধাজ্ঞা মেনে নিতে পরামর্শ দেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন, কলা বিভাগের ডীন ইতরাত হোসেন জুবেরী, প্রক্টর মোজাফফর আহমদ চৌধুরী, সলিমুল্লাহ হলের প্রভোস্ট মোঃ ওসমান গনি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যক্ষ কে. জে. নিউম্যান, দর্শন বিভাগের অধ্যক্ষ গোলাম জিলানী তারা সবাই কলা ভবনে উপস্থিত ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যখন পুলিশ টিয়ার গ্যাস ছুড়ল তখন উপাচার্য প্রতিবাদ করেন কিন্তু তাতে কোন ফল হলো না। তাদের অবস্থিতিকালেই লাঠিচার্জ এবং গ্রেফতার পর্ব শুরু হলো। আন্দোলন যখন ৪র্থ দিনে পৌঁছল তখন কলা ভবনে শিক্ষকদের কমন রুমে কলা বিভাগের ডীনের নেতৃত্বে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভাটির প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী ও মোজাফফর আহমদ চৌধুরী। এই সভায় বক্তব্য রাখেন অর্থনীতির অধ্যক্ষ এসভি আয়ার, মোজাফফর আহমদ চৌধুরী ও মুনীর চৌধুরী। তারা দাবি করলেন, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে এবং পূর্ববাংলায় শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ঘোষণা করা হোক। তারা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে পুলিশের আক্রমণের নিন্দা জানালেন এবং ঘটনার বিষয়ে একটি বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি জানালেন। একইসঙ্গে ১৪৪ ধারার নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আশপাশ থেকে পুলিশ ক্যাম্প উঠিয়ে নেবার দাবি করলেন। এছাড়াও তারা সংবাদ মাধ্যমের ওপর জারি করা নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার ও ভাষা আন্দোলনে যেসব পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং যারা গ্রেফতার হয়েছে তাদের ক্ষতিপূরণ দেয়ার দাবি তুলেন। ২৬ তারিখে এই সভার প্রধান উদ্যোক্তা মোজাফফর আহমদ চৌধুরী এবং মুনীর চৌধুরীকে গ্রেফতার করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন উৎসবের তারিখ ছিল ২৩ ফেব্রুয়ারি। সেটা অবশ্য অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করা হয়। অন্যদিকে, ২২ ফেব্রুয়ারি রাতে যে জায়গায় প্রথম শহীদ প্রাণদান করেন সেখানে মেডিক্যাল কলেজের কতিপয় ছাত্র একটি শহীদ মিনার স্থাপন করেন। ২২ তারিখে সলিমুলল্লাহ হলের মিলনায়তনে ভাষা আন্দোলনের একটি সচিবালয় স্থাপিত হয়। সেখানে যেসব কাজ ছিল: (১) বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংযোগ এবং তাদের কার্যাবলী পর্যবেক্ষণ; (২) ঢাকার সরদারদের সঙ্গে সংযোগ; (৩) মফস্বল শহরগুলোর সঙ্গে সংযোগ; (৪) প্রতিদিনের কার্যক্রম প্রণয়ন ও ঘোষণা। এই সচিবালয়ে পুলিশ ২৫ তারিখ দুপুরে হামলা করল। হলটিকে তখন চারদিক থেকে পুলিশ বাহিনী ঘিরে ফেলল। আমি সে সময় বিভিন্ন মহলে সংযোগ রাখার খাতিরে হলের বাইরে ছিলাম। যখন ফিরলাম তখন দেখি হলটির চারপাশে পুলিশের একটি বিরাট বেষ্টনী। কিছুক্ষণ পর দেখলাম, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং হলের প্রভোস্ট পুলিশের সঙ্গে দেন-দরবার করলেন। আলোচনা শেষে পুলিশ বাইরে তাদের বেষ্টনী অব্যাহত রাখল। উপাচার্য ও প্রভোস্ট হলে প্রবেশ করলেন। কিছুক্ষণ পরে তারা বেরিয়ে এলেন এবং হলের মাইক্রোফোনটি পুলিশের হাতে দিয়ে দিলেন। সে যাত্রা পুলিশ বেষ্টনী প্রত্যাহার করে চলে গেল। পরের দিন দুপুরের আগেই পুলিশ হলের চারপাশে অবস্থান নিল এবং তাদের একটি ছোট দল হলে প্রবেশ করল। উপাচার্য এবং প্রভোস্টকে তারা হলে প্রবেশ করতে দিল না। যে দলটি হলে প্রবেশ করল তাতে ছিলেন প্রাদেশিক মুখ্যসচিব আজিজ আহমেদ, চট্টগ্রামের কমিশনার নিয়াজ আহমেদ খান, ঢাকার পুলিশ ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ সেই সঙ্গে কিছু কর্তাব্যক্তি ও বিশাল পুলিশ বাহিনী। পুলিশ বাহিনীর নেতৃত্বে ছিল মামুন মাসুদ বলে একজন অতিরিক্ত পুলিশ সুপারিন্টেন্ডেন্ট (এই ব্যক্তি সম্বন্ধে একটু পরেই বিস্তৃত কাহিনী শোনাব)। পুলিশ সুপার জিহাদী উন্মাদনায় পুলিশ বাহিনীকে নিয়ে বিভিন্ন কামরা আক্রমণ করল এবং অনেক ছাত্রকে গ্রেফতার করল। মামুন মাসুদ আবাসিক হাউস টিউটর সাহেবের দরজায়ও লাথি দিল। ড. মফিজ তখন দরজা খুলে জিজ্ঞাসা করলেন, কি ব্যাপার? সঙ্গে সঙ্গে সে তাকেও গ্রেফতার করল। তারা যখন হল আক্রমণ করে আমি তখন হল মিলনায়তনে ছিলাম। আমি কোন উপায় না দেখে তাদের পেছনে পেছনে হাঁটতে থাকি। সৌভাগ্যবশত পুলিশের ডিআইজি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ দেখলাম খুবই নির্লিপ্ত এবং তার সঙ্গে আমি কথা বলার সুযোগ নিলাম। তিনি সজ্জন ছিলেন, কলকাতার বাঙালী তবে ঊর্দু ভাষী। তিনি আমাকে বললেন, আমি কি তাকে কোথাও একটু বসবার জায়গা দিতে পারি। আমি এই সুযোগটি গ্রহণ করে আমার ১৪১ নম্বর কামরায় নিয়ে গেলাম। তিনি সেখানে গল্পগুজবে মেতে বসলেন। অচিরেই প্রতিভাত হলো যে, আমাদের পরিবারের সঙ্গে কোন এক সময় তিনি বেশ ঘনিষ্ঠ ছিলেন। তার পিতা আবু সায়ীদ আবদুল্লাহ ছিলেন সিলেট মুরারীচাঁদ কলেজের প্রথম মুসলমান অধ্যক্ষ। তারা তিন ভাই সিলেটে বেশ কিছুদিন পড়াশোনা করেন। আবু সায়ীদ আব্দুল্লাহর সঙ্গে আমার দাদার খুব ভাল সম্পর্ক ছিল। সেসব নিয়েও ডিআইজি সাহেবের সঙ্গে কথাবার্তা হলো। ডিআইজি সাহেব জিজ্ঞেস করলেন যে, আমার আব্বা কে? যখন আমি তার পরিচয় দিলাম তখন তিনি বললেন যে, আমার আব্বার মোচটা কি এখনও আছে। তিনি আমার কামরায় থাকায় আমি রক্ষা পেলাম। আমার কামরায় আমি একা থাকতাম যদিও এটা দুই ছাত্রের জন্য নির্দিষ্ট ছিল। এ কারণে আমার কামরায় ভাষা আন্দোলনের প্রচুর প্রচারপত্র একটি শূন্য বিছানার নিচে স্তূপ করা ছিল। আমার সৌভাগ্য যে, এগুলো ডিআইজি সাহেবের দৃষ্টিতে পড়ল আকর্ষণ করল না এবং তিনি আমার কামরায় আছেন বলে পুলিশের কেউ সেখানে ঢুকল না। পুলিশ তাদের ধ্বংস এবং গ্রেফতারযজ্ঞ শেষ করে হল ছেড়ে চলে গেল। আমার কাছেই থাকতেন আমার এক বছরের জ্যেষ্ঠ ছাত্র রুহুল আমিন। তার কামরায় ছিল একটি বন্দুক। এই বন্দুকের মালিক ছিলেন তার পিতা একজন পুলিশ কর্মকর্তা এবং এটা লাইসেন্সসহ তার সঙ্গে ছিল। কারণ এটাকে মেরামতের জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়। সরকার এস এম হলে তাদের ঘৃণ্য আক্রমণের পক্ষে মিথ্যা খবর দেয় যে, হলে আগ্নেয়াস্ত্র পাওয়া যায়। আগ্নেয়াস্ত্রটি ছিল এই লাইসেন্সওয়ালা বন্দুক। পুলিশ বাহিনী যখন হল ছেড়ে যাচ্ছে তখন আমরা দেখলাম, যেসব ছাত্র আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে তাদের মধ্যে কেউই গ্রেফতার হয়নি। পরিবর্তে নিরীহ ছাত্ররাই গ্রেফতার হয়েছে। চলবে...
×