ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

এনামুল হক

এবার উদীয়মান বিশ্বে ঋণ সঙ্কট!

প্রকাশিত: ০৩:৫৭, ২৯ নভেম্বর ২০১৫

এবার উদীয়মান বিশ্বে ঋণ সঙ্কট!

বিশ্বে ঋণ সঙ্কটের যেন শেষ নেই। চলমান সঙ্কট প্রথম দুটি পর্যায় অতিক্রম করে এখন তৃতীয় পর্যায়ে প্রবেশ করেছে। এবার সেটা কেন্দ্রীভূত হয়েছে উদীয়মান বাজারগুলোতে। যুক্তরাষ্ট্রের আবাসন শিল্পে বিপর্যয় নামার মধ্য দিয়ে ঋণ সঙ্কটের প্রায় দশ বছর হয়ে গেছে। এরপর গ্রীসের ঋণ পরিশোধে অক্ষমতা থেকে ইউরো সঙ্কট সৃষ্টিরও প্রায় ছয় বছর হলো। এখন তৃতীয় দফা ঋণ সঙ্কট শুরু হয়েছে তৃতীয় বিশ্বের উদীয়মান অর্থনীতিতে। সেই সঙ্কটের প্রভাব পুরোপুরি বিবেচনায় নিলে দেখা যাবে যে, বিশ্ব অর্থনীতির অবস্থা সত্যিই অতি নাজুক। ২০০৭ সালে ধনী বিশ্বে যখন ঋণ সঙ্কট শুরু হয়েছিল সে সময় উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোতে ঋণের প্রবাহে তেজীভাব এসেছিল। এসব দেশের বেসরকারী খাতের ঋণ ২০০৭ সালের শেষ দিকে জিডিপির ৭৩ শতাংশ থেকে বেড়ে ১০৭ শতাংশে পৌঁছে। ব্যাংকের প্রদত্ত ঋণ এবং কোম্পানির ইস্যুকৃত বন্ডও এর মধ্যে ছিল। এসব দেশে ঋণের এই জোয়ারটা বহুলাংশে এসেছিল ধনী বিশ্বে ঋণ সঙ্কটের জবাবে। ধনী দেশগুলোর রফতানি বাজারে মন্দার আশঙ্কায় চীন সরকার ২০০৯ সালে ঋণের প্রবাহ ব্যাপকভাবে বাড়িয়ে দেয়। এদিকে, ধনী বিশ্বে সুদের হার অতি সামান্য অঙ্কে নেমে আসায় সেখান থেকে বিনিয়োগকারীরা তাদের মূলধন গুটিয়ে নিয়ে অধিক আকর্ষণীয় স্থানের সন্ধান করতে থাকে। উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোতে তারা সেই সুযোগ পায় সেখানকার সুদের হার বেশি থাকার জন্য। ফলে মূলধনের ঢল নামে ধনী বিশ্ব থেকে উদীয়মান অর্থনীতির দেশে। তবে বেসরকারী খাতে এই ঋণপ্রবাহের তিন-চতুর্থাংশই গ্রহণ করে ব্যবসায়ীরা। ফলে এসব দেশে কর্পোরেট ঋণ ২০০৮ সালে যেখানে ছিল জিডিপির ৫০ শতাংশেরও কম ২০১৪ সাল নাগাদ তা প্রায় ৭৫ শতাংশে উন্নীত হয়। এই ঋণের সরবরাহ বেশিরভাগ হয় এশিয়ায় বিশেষ করে চীনে। তবে তুরস্ক, ব্রাজিল ও চিলিতেও জিডিপির অনুপাতে ঋণের প্রবাহ বাড়ে। এই ঋণের সিংহভাগ গিয়েছিল নির্মাণ খাত ও তেল এবং গ্যাস শিল্পে। এখন ঋণ সরবরাহে এই তেজীভাবের অবসান ঘটতে চলেছে। ঋণপ্রবাহে যখন জোয়ার নামে তখন ধরে নিতে হয় সামনে সঙ্কট দানা বাঁধছে। অনাগত সঙ্কটের এটাই হলো সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য সঙ্কেত। দেখা গেছে, জিডিপির সঙ্গে ঋণের অনুপাত ৯ শতাংশ পয়েন্ট বেড়ে গেলে বিভিন্ন ধরনের দুর্ভাগ্য এবং দৈব-দুর্বিপাকের আশঙ্কাও বেড়ে যায়। ঋণপ্রবাহ তুঙ্গে পৌঁছার পরবর্তী বিভিন্ন পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, উদীয়মান দেশগুলোর প্রবৃদ্ধি ২০০০-এর দশকের শেষ দিকে এবং ২০১০-এর দশকের প্রথমভাগে যা ছিল তার তুলনায় অনেক মন্থর হয়ে যাবে। ইতোমধ্যে ব্রাজিল ও রাশিয়ায় মন্দা দেখা দিয়েছে। তাই সামগ্রিকভাবে উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোর প্রবৃদ্ধি বিশ্বের বাকি অংশের বিপর্যয় ঠেকিয়ে রাখবেÑ এমন প্রত্যাশা থাকা ঠিক হবে না। অবশ্য এমন নিরানন্দ চিত্রটাকে অতিরঞ্জিত করে দেখাও ঠিক হবে না বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। বিভিন্ন দৃষ্টান্ত থেকে দেখা যায়, কর্পোরেট ঋণ বাড়লেও তা অতটা ক্ষতিকর নয় যতটা ক্ষতিকর হয়েছিল ২০০০-এর দশকের আমেরিকার ভোক্তা ঋণ। আর এটাও পুনরুল্লেখ করা প্রয়োজন যে, উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোতে গৃহীত ঋণের সিংহভাগই হলো কর্পোরেট ঋণ। গবেষণায় দেখা যায়, ভোক্তা ঋণ বেড়ে যাওয়ার ফলে পরবর্তী পর্যায়ে মাথাপিছু জিডিপির প্রবৃদ্ধি যতটা হ্রাস পেয়েছে, কর্পোরেট ঋণ বৃদ্ধির পরিণতিতে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হ্রাস পেয়েছে সে তুলনায় অর্ধেক। অর্থাৎ ঋণদান যেখানে ভোক্তা পরিবারের ক্ষেত্রে নয় বরং কোম্পানিগুলোর ক্ষেত্রে করা হয় সেখানে ক্রমবর্ধমান ঋণ এবং জিডিপি প্রবৃদ্ধি হ্রাসের মধ্যকার যোগসূত্রটা অপেক্ষাকৃত দুর্বল। আমেরিকায় কর্পোরেট ঋণের ধস যতটা ক্ষতির কারণ হয়েছিল তার চেয়ে অনেক বেশি ক্ষতি করেছিল বাড়ির দাম পড়ে যাওয়ায় মর্টগেজ ঋণের ধস। কারণ এতে সকল শ্রেণীর ভোক্তার সম্পদ হ্রাস পেয়েছিল। ঋণের প্রবাহ বৃদ্ধির পরিণতিতে ইতোমধ্যে ব্রাজিল ও রাশিয়া মন্দা আক্রান্ত হয়েছে। আইএমএফের হিসাবে ব্রাজিলের জিডিপি এ বছর প্রায় ৩ শতাংশ এবং রাশিয়ার ৪ শতাংশ হ্রাস পাবে। দক্ষিণ আফ্রিকা, তুরস্ক ও মালয়েশিয়ার মুদ্রার মূল্যমান গত দুই বছরে হ্রাস পেয়েছে। ২০০৭ সালের পর ধনী দেশগুলো থেকে চলে আসা পুঁজি বা মূলধনে উদীয়মান দেশগুলোর অর্থবাজার সয়লাব হয়ে গিয়েছিল। এখন উদীয়মান দেশগুলো থেকে সেই মূলধন অন্যদিকে চলে যাচ্ছে। আমেরিকায় সুদের হার বৃদ্ধি হয়তবা এর একটা কারণ। এই পরিস্থিতিতে উদীয়মান দেশগুলো সম্পর্কে সাধারণভাবে আশাবাদী হওয়া কঠিন। তবে ক্ষতিটা ঠিক কার হবে তা নির্ণয় করাও সমভাবে কঠিন। উদীয়মান দেশ দু’রকমের আছে। যেসব দেশে ঋণের অঙ্কটা বেশি মোটামুটিভাবে সেগুলোর কঠিন সঙ্কটে পড়ার আশঙ্কা খুব বেশি নেই। চিরায়ত ধাঁচের উদীয়মান বাজারের দেশগুলোর চলতি হিসাবের ঘাটতি থাকে এবং এরা মুদ্রাস্ফীতিপ্রবণ। এসব দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংককে মুদ্রা বিনিময় হারের ওপর অত্যধিক মাত্রায় নজর রাখতে হয়। কারণ বিনিময় হার খুব বেশি কমলে মুদ্রাস্ফীতি ঘটবে। আবার খুব বেশি বাড়লে রফতানি হবে ক্ষতিগ্রস্ত। এই দেশগুলো বাদে অন্য আর যে ধরনের উদীয়মান দেশ আছে সেগুলোর চলতি হিসাবে স্বাচ্ছন্দ্যকর মাত্রায় উদ্বৃত্ত থাকে, বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থাকে এবং সরকারী পর্যায়ে অর্থলগ্নি ব্যবস্থাও ভারি সুন্দর। তবে এদের বেসরকারী খাতে ঋণের পরিমাণ বিপুল এবং পণ্য উৎপাদনের ক্ষমতাও অত্যধিক। এর ফলে এসব দেশের মুদ্রা সঙ্কোচন ঘটার প্রবণতা থাকে। অতিমাত্রায় ঋণগ্রস্ত উদীয়মান দেশগুলো যেমন চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর এবং সম্ভবত থাইল্যান্ড এই দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ে। মূলধন চলে যাওয়ায় ঋণের আকস্মিক ধস নামলে এদের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা কম থাকে। এদের বেশিরভাগেরই লেনদেন ভারসাম্যের সঙ্কট মোকাবেলা করার মতো শক্তিশালী ও বিশাল রক্ষণাত্মক ব্যবস্থা আছে। অর্থাৎ এরা স্থিতিশীল এবং এই স্থিতিশীলতার আরও একটা অর্থ হলো অতিরিক্ত ঋণের কারণে উদ্ভূত সঙ্কট বছরের পর বছর চলতে পারে। মুদ্রাস্ফীতি না থাকায় সুদের হার কমিয়ে রাখা যেতে পারে। তার মানে ঋণ খাতে ব্যয়ের অঙ্কটাও কিছুদিন আয়ত্তযোগ্য থাকতে পারে। তবে ব্রাজিল ও তুরস্কসহ অন্য আর যে ধরনের ক্ল্যাসিক উদীয়মান দেশ আছে সেগুলো অধিকতর মাত্রায় আশু ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এসব দেশে ২০০৭ সালের পর বেসরকারী খাতে ঋণের পাহাড় গড়ে ওঠে, যার সিংহভাগই ছিল কর্পোরেট হাউসগুলোর নেয়া। তাদের চলতি হিসাবে বিশাল অঙ্কের ঘাটতি থাকার কারণে জিডিপির প্রবৃদ্ধি বজায় রাখার জন্য এই দেশগুলো বৈদেশিক সাহায্যের ওপর নির্ভর করতে বাধ্য হয়। সুদের হার বৃদ্ধির সম্ভাবনা লক্ষ্য করে বাইরে চলে যাওয়া মূলধন আবার আমেরিকায় ফিরে আসতে থাকায় এই দেশগুলো অধিকতর বিপন্ন হয়ে পড়েছে। মুদ্রার দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে না পারায় মুদ্রাস্ফীতি বেড়েছে। মুদ্রাস্ফীতির রাশ টেনে ধরা এবং মূলধনের বহির্গমন মন্থর করার জন্য সুদের হার বাড়াতে হয়েছে। তাতে করে ঋণ পরিশোধের খরচটাও বেড়ে যাচ্ছে। এমন অবস্থায় ঋণ সমস্যা মোকাবেলার চাপ বাড়ছে এবং অর্থনীতির ওপর এর প্রভাব অত্যন্ত নাটকীয়ভাবে পড়ছে। সত্যিকারের সঙ্কটের ক্ষেত্রে এই দেশগুলোর বিপদের ঝুঁকিই সর্বাধিক। এই শ্রেণীর বিপন্ন সব দেশেরই যে চলতি হিসাবে ঘাটতি রয়েছে তা নয়। মালয়েশিয়ায় চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত আছে। তারপরও দেশটি এই শ্রেণীতে পড়ে। কারণ এর বেসরকারী খাতের ঋণের পরিমাণ অনেক বেশি এবং তা জিডিপির ১৮ শতাংশ। এর মুদ্রা দুর্বল এবং চীনের সঙ্গে এর বাণিজ্য সম্পর্ক সুদৃঢ় বন্ধনে আবদ্ধ থাকায় অর্থনীতি মন্থর হয়ে পড়ছে। তৃতীয় এক শ্রেণীর উদীয়মান অর্থনীতির দেশ আছে যাদের অর্থনীতি হয় বেসরকারী খাতের ঋণের কারণে অপেক্ষাকৃত কম ক্ষতিগ্রস্ত, নয়ত প্রবৃদ্ধির ব্যাপারে তাদের আশাবাদী হওয়ার অন্যান্য কারণ আছে। ভারত এই শ্রেণীর দেশের মধ্যে পড়ে। এশিয়ার অন্যান্য দেশের মতো ভারতেও কর্পোরেট ঋণ ২০০৭ সালের পর বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে এর বিনিয়োগেও জোয়ার এসেছে এবং তাতে অন্যান্য জায়গায় ক্ষতিটা পুষিয়ে গেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিভিন্ন সংস্কারমূলক পদক্ষেপের ফলে অর্থনীতিতে গতি এসেছে। আইএমএফের হিসাবে ২০১৬ সালে ভারতের জিডিপি ৭৩ শতাংশ বাড়বে। তার ফলে ভারত বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল বৃহৎ অর্থনীতির দেশে পরিণত হবে। চীনের অর্থনীতি মন্থর হওয়ার কারণে এশিয়ার অন্যান্য দেশ যতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ভারতের ক্ষতি হয়েছে তার তুলনায় কম। তেলের দাম অর্ধেকে নেমে আসায় ভারতের অর্থনীতিতে তেজীভাব এসেছে। কারণ ভারত তার ব্যবহৃত তেলের ৮০ ভাগই বিদেশ থেকে আমদানি করে থাকে। ভারতের চলতি হিসাব ভারসাম্যের কাছাকাছি পৌঁছেছে। ২০১৩ সালে মুদ্রাস্ফীতি ছিল দুই অঙ্কের ঘরে। গত সেপ্টেম্বরে তা ৪.৪ শতাংশে নেমে এসেছে। সুদের হারও এ বছর ৮ শতাংশ থেকে ধীরে ধীরে নেমে এসেছে ৬.৭৫ শতাংশে। ব্রাজিল ও রাশিয়ার অর্থনৈতিক মন্দা এবং চীনের শেয়ারবাজারের অস্থিরতার কারণে ভারত বিনিয়োগকারীদের জন্য এক আকর্ষণীয় স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে। ভারতের মতো পাকিস্তানও তেলের মূল্য হ্রাস থেকে লাভবান হয়েছে। এর মুদ্রাস্ফীতি নাটকীয়ভাবে কমে গেছে এবং জিডিপির প্রবৃদ্ধি বেড়েছে। আর্জেন্টিনার বেসরকারী খাতে ঋণ নেই বললেই চলে এবং দেশটির টানা অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনার যে দুর্নাম আছে এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মরিসিও ম্যাকরি জয়ী হলে সেই দুর্নাম ঘুচে যেতে পারে। মেক্সিকোর ঋণ ২০০৭ সালের পর সামান্য বেড়েছে। দেশটি বেসরকারী খাতের ঋণ সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসছে। এসব উজ্জ্বল দিক থাকা সত্ত্বেও বিশ্ব অর্থনীতির পূর্বাভাসটা কিন্তু নিরানন্দ। বলা হচ্ছে, সামনের বছরটি বিশ্ব অর্থনীতির জন্য আরেকটি বিবর্ণ ও ম্রিয়মাণ বছর। এ অবস্থায় আইএমএফ উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোতে আগামী বছর উঁচুমাত্রার প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে বলে ভবিষ্যদ্বাণী করলেও বাস্তব অবস্থা হচ্ছে- এই দেশগুলোতে আগামী বছরটা প্রবৃদ্ধি মন্থর হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। সূত্র : দ্য ইকোনমিস্ট অবলম্বনে
×