ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

‘দুঃখিনীরে মনেতে রাখিও অবলা জানিয়ারে শ্যাম আমায় না ভুলিও...’

প্রকাশিত: ০৫:২৪, ২৮ নভেম্বর ২০১৫

‘দুঃখিনীরে মনেতে রাখিও অবলা জানিয়ারে শ্যাম আমায় না ভুলিও...’

মোরসালিন মিজান শ্রীকৃষ্ণ বিচ্ছেদের যে অনল সে তো আর কারও নয়, কেবল রাধার। অথচ দিব্যি পুড়েছিলেন সুনামগঞ্জের এক মরমী কবি। পুড়ে পুড়ে খাঁটি সোনা হয়েছিলেন। তাঁর নাম আজ আর কারও অজানা নয়। হ্যাঁ, রাধারমণ। মধ্যযুগীয় সঙ্গীত সাধক। জীবনভর সঞ্চিত বিরহ যেন মনের খাঁচায় পুষতেন। প্রিয়জনকে হারানোর ব্যথা কত তীব্র হয়, হতে পারে, রাধারমণের গান না শুনলে অনুমান করা মুশকিল। এ প্রসঙ্গে বিপুল জনপ্রিয় একটি গানের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে, যেখানে চির বিরহী কণ্ঠ আর্তনাদ করছেÑ আগে যদি জানতাম রে ভ্রমর যাইবা রে ছাড়িয়া/ মাথার কেশ দুই ভাগ করে রাখিতাম বান্ধিয়ারে/ ভ্রমর কইও গিয়া...। কৃষ্ণ হারা জীবনের কোন মানে খুঁজে পেতেন না রাধা। সেই অভিব্যক্তির কথা তুলে ধরে শিল্পীমন গেয়ে ওঠেÑ ললিতায় নেও গলার মালা/ বিশখায় নেও হাতের বালা গো/ খুলিয়া নেও কানের পাশা/ আর আশা নাই বাঁচিতে...। আর অসংখ্য মর্মস্পর্শী কথা ও সুরের তিনি স্রষ্টা। শত বছর আগে গত হয়েছেন। এখন সৃষ্টির মাঝেই তাঁকে খুঁজে ফেরা। স্থানীয় শিল্পীরা ভক্ত অনুরাগীরা পরম যতেœ তাঁর গান করেন। তবে, সেই অকৃত্রিম সুর রাজধানী শহর পর্যন্ত এসে পৌঁছে না। বহুকাল পৌঁছেনি। আর তারপর চমৎকার একটি উদ্যোগ রাধারমণ উৎসব। গত কয়েক বছর ধরে শিল্পকলা একাডেমির খোলা চত্বরে উৎসবের আয়োজন করা হয়ে আসছে। একাডেমির সহায়তায় এর আয়োজন করছে রাধারমণ সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্র। বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হয়েছে এবারের অনুষ্ঠানমালা। তিন দিনব্যাপী আয়োজনের প্রথম দিনেই মুখরিত ছিল গোটা এলাকা। দ্বিতীয় দিন শুক্রবার হওয়ায় শ্রোতা বেড়ে কয়েকগুণ হয়। আরও জমে ওঠে উৎসব। এদিন উৎসবের উল্লেখযোগ্য শিল্পী ছিলেন ইউসুফ আলী। সেই ১৩ বছর বয়স থেকে রাধারমণে মজেছিলেন। এখন বয়স ৭৫। তবে গান শুনে বয়স অনুমান করা দুঃসাধ্য কাজ। হৃদয়ের গভীর আবেগ কণ্ঠে তুলে তিনি গাইলেনÑ তোমার মনে কান্দাইবার বাসনারে প্রাণনাথ আমি দুঃখীনিরে/ তুমি গেলায় পরবাসে ও বন্ধু আমি রইলাম তোমার আশেরে...। আঞ্চলিক উচ্চারণ সরল উপস্থাপনা তাঁর গানের প্রধান বৈশিষ্ট্য। নারীর মনের ব্যথা পুরুষ কণ্ঠে দারুণ তুলে ধরেন শিল্পী। দ্বিতীয় পরিবেশনাটি ছিল একমÑ রাধার বন্ধুয়ারে দুঃখীনিরে মনেতে রাখিও/ অবলা জানিয়ারে শ্যাম আমায় না ভুলিও...। সিলেটের আরেক জনপ্রিয় শিল্পী জামাল উদ্দিন হোসেন বান্না। ‘মনরে কুপন্থে না যাইও’, ‘কি হেরিলাম কদম তলায়’ ইত্যাদি গানে শ্রোতাদের মুগ্ধ করে রাখেন তিনি। নারী শিল্পীরাও রাধার বিয়োগ ব্যথা প্রকাশ করেছেন। মিতালী চক্রবর্ত্তী গান অত্যন্ত জনপ্রিয় গান। রাধারমণের ভালবাসার মানুষকে কাছে পাওয়ার আকুতিটুকু জানিয়ে তিনি গানÑ ফুলের আসন ফুলের বসনরে,/ আরে ও বন্ধু, ফুলেরই বিছানা/ ও তোমার হৃদকমলে চুয়াচন্দনরে বন্ধু ছিটাইয়া দিলাম না/ শ্যামকালিয়া সোনা বন্ধুরে, ও বন্ধু/ নিরলে তোমারে পাইলাম না...। একই এলাকার লিংকন দাস, অরুণ তালুকদার, মিতালী চক্রবর্ত্তী, মালতী পাল, পঙ্কজ দেব, পপি কর, সন্দীপ্তা রানী ও স্বপ্না দেবনাথের গানেও প্রকাশিত হন অকৃত্রিম রাধারমণ। মৌলভী বাজারের শিল্পীদের মধ্যে ছিলেন রামেশ চন্দ্র দাস ও ফারুক দেওয়ান। রাধারমণ উৎসবের অন্যতম আকর্ষণ ধামাইল নিয়ে মঞ্চে এসেছিল নবীগঞ্জের একটি দল। দলের নারী সদস্যদের পরিবেশনা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনেন শ্রোতা। দেখেনও। কারণ এই পরিবেশনার বিশেষ একটি রীতি আছে। রীতি অনুযায়ী, নারী শিল্পীরা বৃত্তাকারে ঘুরে ঘুরে সমবেত কণ্ঠে সঙ্গগীত পরিবেশন করেন। রাধারমণের নিজের গ্রাম জগন্নাথপুর থেকে এসেছিলেন রাজা মিয়া, হারুণ মিয়া ও মোশারফ হোসেন। তাঁরা যে গান পরিবেশন করেন সেখানে শহুরে বিকৃতি নেই। সহজেই ভেতরটা নিংড়ে নেয়। বিরহ ছড়িয়ে দিয়ে যায় বাতাসে। গাছের পাতায় পাতায়। বিরহের এই উৎসব আজ শনিবার শেষ হবে।
×