ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

দুই ব্যক্তি আটক

হোসেনী দালানে হামলার সঙ্গে বগুড়ার ঘটনার যোগসূত্র থাকতে পারে

প্রকাশিত: ০৫:১৯, ২৮ নভেম্বর ২০১৫

হোসেনী দালানে হামলার সঙ্গে বগুড়ার ঘটনার যোগসূত্র থাকতে পারে

সমুদ্র হক/মাহমুদুল আলম নয়ন, বগুড়া অফিস ॥ বগুড়ার গ্রামে শিয়া মসজিদে অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের গুলি হামলার ঘটনায় ২ ব্যক্তিকে আটক করা হয়েছে। এই সন্ত্রাসীরা জঙ্গী এমন প্রমাণ পাচ্ছে পুলিশ। এর বাইরে আর কোন ঘটনা আছে কি না তাও তদন্ত করা হচ্ছে। উল্লেখ্য, বৃহস্পতিবার রাতে বগুড়ার শিবগঞ্জের হরিপুর ও চককানু গ্রামের মধ্যবর্তী স্থানে শিয়া সম্প্রদায়ের মসজিদে মুসল্লিরা নামাজ আদায় করার সময় ৩-৪ জনের অস্ত্রধারী দুর্বৃত্ত গুলিবর্ষণ করলে ১ মুসল্লি নিহত ও ৩ জন আহত হয়। ঢাকায় হোসেনী দালানে শিয়া সম্প্রদায়ের আশুরা অনুষ্ঠানের বোমা হামলার এক মাসের মধ্যে বগুড়ায় শিয়া মসজিদের ভেতরে প্রবেশ করে এশার নামাজে মুসল্লিদের ওপর বেপরোয়া গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটল। এই ঘটনায় এলাকার সোনা মিয়া বাদী হয়ে শিবগঞ্জ থানায় মামলা দায়ের করেন। পুলিশ রাতেই আনোয়ার (৪৮) ও জুয়েল (২৫) নামের দুই ব্যক্তিকে হরিপুর ও মাঝিহট্ট গ্রাম থেকে আটক করে। ঘটনাস্থলে পয়েন্ট টুটু বোরের গুলির ৮টি খোসা উদ্ধার করা হয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশের মতে দুর্বৃত্তরা ২ থেকে ৩ মিনিটের মধ্যে ঘটনা ঘটিয়ে সটকে পড়ে। বগুড়ার পুলিশ সুপার মোঃ আসাদুজ্জামান জানিয়েছেন আপাত দৃষ্টির ধারণা করা হচ্ছে শিয়া বিদ্বেষীরা এই ঘটনা ঘটিয়েছে। তবে এর বাইরের বিষয়গুলোও তদন্তে আনা হয়েছে। পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আখতার হোসেন বলেছেন, ঘটনার সঙ্গে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গীগোষ্ঠীর সম্পৃক্ততা তদন্তে এসেছে। শিয়া সম্প্রদায়ের মুক্তিযোদ্ধা সত্তর বছর বয়সী আবু জাফর ম-ল জানান, মাস তিনেক আগে এলাকার কয়েকটি ওয়াজ মহফিলে এক শ্রেণীর মাওলানা শিয়া সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে উস্কানিমূলক বক্তব্য রাখেন এবং ধর্মীয় বিষেদ্গার করেন। বিষয়টি শিবগঞ্জ থানাকে জানানো হয়েছিল। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন স্থানে জীবন নাশের হুমকি হত্যা ও হত্যার চেষ্টা ঢাকায় শিয়াদের ওপর হামলা ইত্যাদি ঘটনায় সন্ত্রাসী জঙ্গীগোষ্ঠীর সম্পৃক্ততার সঙ্গে শিবগঞ্জের ঘটনার যোগসূত্র রয়েছে বলে তিনি মনে করেন। সুপরিকল্পিত এবং গভীর ষড়যন্ত্রের অংশেই শিয়া সম্প্রদায়ের মসজিদে হামলা চালায় অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা। পুলিশ জানায়, স্পর্শকাতর বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে সর্বোচ্চ তদন্ত চলছে। এই বিষয়ে একজন শিক্ষক (নাম প্রকাশ করতে না চেয়ে) বললেন, এমনও হতে পারে বহির্বিশ্বে দেশে আইএসের উপস্থিতি দেখানোর জন্য অতি সুক্ষè কৌশলে দেশের অভ্যন্তরের কোন গোষ্ঠী এ ধরনের ঘটনা ঘটাচ্ছে। তদন্তকারী কর্মকর্তাগণ কোন কিছুকেই সন্দেহের বাইরে রাখছেন না। দেশের ভেতরের কেউ বা কোন গোষ্ঠী এ ধরনের সেনসেটিভ ঘটনা ঘটাতে পারে কি না তা ও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। শুক্রবার ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায় এলাকায় বিরাজ করছে থমথমে অবস্থা। প্রতিটি পয়েন্টে পুলিশ ও র‌্যাব মোতায়েন করা আছে। বগুড়া জেলা শহর থেকে পাকা সড়ক ধরে প্রায় ২৫ কিলোমিটার উত্তর পশ্চিমের উপজেলা সদর শিবগঞ্জ। সেখান থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার ভেতরের রাস্তার দুই ধারে দুই গ্রাম হরিপুর ও চককানু। এই দুই গ্রাম আবার দুই ইউনিয়নের মধ্যে। প্রথমটি কিচক ও পরেরটি আটমুল ইউপির মধ্যে। এমন ভৌগোলিক অবস্থানে শিয়া মসজিদটি পড়েছে চককানুর মধ্যে। বগুড়া-জয়পুরহাট আঞ্চলিক মহাসড়ক থেকে প্রায় ২শ’ মিটার ভেতরে একটি সরু পাকা সড়কের ধারে মসজিদ। বাসস্ট্যান্ড থেকে নেমে হেঁটেই আসা যায়। মসজিদের আশপাশের ঘরবাড়ি। এক ধারে ধান ক্ষেত। টিনের চালার এই মসজিদটি হালে পাকা হয়েছে। কাজ এখনও শেষ হয়নি। ভেতরে বিদ্যুত ওয়ারিং কাজ চলছে। ইরান দূতাবাসের সহযোগিতায় বাংলাদেশ ইসলামী জনকল্যাণ ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে মসজিদটি পরিচালিত হয়। ঘটনা প্রত্যক্ষদর্শীদের মধ্যে মসজিদের কাছেই বাড়ি এমন একজন গৃহবধূ সাবিনা আক্তার জানালেন, ঘটনার দিন বিকেলে সাড়ে ৪টার দিকে (আসরের নামাজের পর) তিনি পাশের জমি থেকে সবজি তুলছিলেন। এ সময় মোটরসাইকেলে চেপে তিন যুবক (যাদের বয়স ২০ থেকে ২২ বছরের মধ্যে) মসজিদ এবং আশপাশে ঘুরে একজনকে নামিয়ে দিয়ে চলে যায়। যার কাঁধে ছিল একটি ব্যাগ। প্রত্যেকের মুখে ছিল মাস্ক। যুবকটি মসজিদের পাশে কোথায় যেন গেল। এর কিছু পর পূর্বের দুই যুবক মোটরসাইকেলে এসে নামিয়ে দেয়া যুবককে নিয়ে যায়। হাসপাতালে চিকিৎসারত গুলিবিদ্ধ আফতাব হোসেন বললেন, তিনি সুন্নত নামাজ পড়ছিলেন। বাকিরাও কেউ সুন্নত কেউ দোয়া দরূদ পাঠ করছিলেন। এর মধ্যেই এক শব্দের সঙ্গে তিনি অনুভব করলেন পায়ে যেন কি বিঁধেছে। মনে করছিলেন মসজিদে ইলেকট্রিকের ওয়ারিং হচ্ছে শর্ট সার্কিট হবে হয়ত। এরপর চিৎকার চেঁচামেচি তারপর কি হলো মনে করতে পারেন না। এই মসজিদের পাশেই একটি মুদি দোকান। এটি পরিচালনা করেন পারভীন (৩৫) নামের এক গৃহবধূ। তিনি জানালেন, আলোর মতো কি যেন দেখলেন মনে করেছিলেন শর্ট সার্কিট। তারপর অনেক মানুষের চিৎকারে বুঝতে পারেন বড় কিছু ঘটেছে। আরেক প্রত্যক্ষ দর্শী বললেন, অচেনা ৩-৪ জন যুবক মসজিদে প্রবেশের পরই মূল গেটে তালা লাগায়। তারপর মসজিদের সমুখের গেট থেকেই ১০-১৫ রাউন্ড গুলি করে মসজিদের দক্ষিণধারের প্রাচীর ডিঙ্গিয়ে জমির ভেতর দিয়ে চলে যায়। কিছু বুঝে ওঠার আগেই দুর্বৃত্তরা পালিয়ে যায়। এদিকে ঘটনার পর শিবগঞ্জ থানা পুলিশ সেখানে পৌঁছে। তারপর পুলিশ সুপার, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বাড়তি ফোর্স নিয়ে সেখানে যায়। ঘটনাস্থলেই ৮টি গুলির খোসা পাওয়া যায়। পুলিশ জানায় পয়েন্ট টুটু বোরের এই গুলি পিস্তলসহ হালকা আগ্নেয়াস্ত্রে ব্যবহার করা যায় এবং সহজেই লুকানো অস্ত্র থেকে গুলি ছোড়া যায়। মসজিদের ভেতরে রক্তের ছোপ ও দেয়ালে গুলির চিহ্ন দেখা যায়। এই গ্রাম ও শিয়া সম্প্রদায়ের সম্পর্কে লোকজনের কথা, সম্প্রীতির মধ্যে তাদের বাস। এমনও পরিবার আছে যাদের এক ভাই শিয়া আরেক ভাই সুন্নি। গুলিতে নিহত মোয়াজ্জেম হোসেনরা ৪ ভাই। তিনি শিয়া অনুসারী। বাকিরা সুন্নি। তার এক ছেলে এক মেয়ে ও নাতি-নাতনি। ওই মসজিদের আশপাশের গ্রাম গোপিনাথপুর, কিচক, আলাদী, বেলাই, চালসট্ট, আঙ্কা গ্রামে ১শ’ ২০টি শিয়া পরিবারের বাস। যার মধ্যে চককানুতেই বাস করে অন্তত ৫০ পরিবার। এই গ্রামেই শিয়া মসজিদ- নাম আল মোস্তফা জামে মসজিদ। ১৯৮২ সালে এই গ্রামে মুক্তিযোদ্ধা আবু হায়দার ম-ল শিয়া অনুসারী হয়ে ফাউন্ডেশন গঠন করেন। এরপর ১৯৯৮ সালে ইরান সরকারের অর্থায়নে বাংলাদেশ ইসলামিয়া জনকল্যাণ ফাউন্ডেশন শিবগঞ্জ হরিপুর শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমানে ইরান দূতাবাসের সহযোগিতায় এটি পরিচালিত হচ্ছে। শিয়া সম্প্রদায়ের অনেকে স্কলারশিপ নিয়ে ইরান বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করছে। এদের একজন হরিপুর গ্রামের ইরান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মোজাফ্ফর হোসেন। তিনি ঘটনায় প্রায় নির্বাক হয়ে গেছেন। শিয়া অধ্যুষিত ওই গ্রামের মানুষের মধ্যে এখন চাপা আতঙ্ক। গ্রামের কেউ এমন ঘটনা ঘটাতে পারে তা বিশ্বাসই করতে পারছে না। কেউ বলছেন কিছুদিন ধরে অচেনা কিছু যুবকের আনাগোনা এই গ্রামে লক্ষ্য করা যাচ্ছিল। অনেকেই বলছেন ঢাকার হোসেনী দালানে ঘটনার পর জঙ্গী পরিচয়ে হুমকি দেয়া হচ্ছিল। এমন হুমকি থাকায় পুলিশের প্রটেকশনে গ্রামে গেল আশুরা অনুষ্ঠান হয়। বর্তমানে পুরো এলাকায় পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। শহরে এবং শহরের আশপাশে মোটরসাইকেল অরোহীদের ওপর নজর রাখা হচ্ছে। ইতোমধ্যে শিবগঞ্জ এবং আশপাশের এলাকায় পুলিশী তল্লাশি অভিযান শুরু হয়েছে।
×