ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

যুদ্ধাপরাধের বিচার ঘিরে পাকিস্তানের আসল চেহারা বেরিয়েছে

প্রকাশিত: ০৫:২৪, ২৬ নভেম্বর ২০১৫

যুদ্ধাপরাধের বিচার ঘিরে পাকিস্তানের আসল চেহারা বেরিয়েছে

তৌহিদুর রহমান ॥ বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে পাকিস্তানের কোন আপত্তি নেই জানালেও শেষ পর্যন্ত কথা রাখছে না দেশটি। প্রথমদিকে এ বিচার নিয়ে পাকিস্তানের কোন দ্বিমত নেই বললেও এখন ধীরে ধীরে তাদের আসল চেহারা বেরিয়ে পড়ছে। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত থেকে কোন যুদ্ধাপরাধীর চূড়ান্ত সাজা হলেই তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে পাকিস্তান। সর্বশেষ বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও জামায়াতে ইসলামীর নেতা আলী আহসান মুজাহিদের ফাঁসি কার্যকরের পর দেশটি নাখোশ হয়। ফলে ঢাকা-ইসলামাবাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে এখন নতুন করে টানাপোড়েন শুরু হয়েছে। ঢাকায় নিযুক্ত পাকিস্তানের সাবেক হাইকমিশনার আশরাফ কোরেশী আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদের সঙ্গে সাক্ষাত করে বলেছিলেন, ‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়টি বাংলাদেশের একান্তই অভ্যন্তরীণ, এটা নিয়ে পাকিস্তানের কোন মন্তব্য কিংবা দ্বিমত নেই। বাংলাদেশ পাকিস্তানের ভ্রাতৃপ্রতিম দেশ। তাই সে দেশের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের বিষয়ে পাকিস্তানের কোন ধরনের আপত্তি নেই।’ বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়ে পাকিস্তান সে সময় তাদের অবস্থান সুস্পষ্ট করে। পাকিস্তানের পক্ষ থেকে বলা হয়, এ বিচার নিয়ে তারা কোন বিরোধিতাও করবে না। তবে শেষ পর্যন্ত কথা রাখেনি পাকিস্তান। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের শুরু থেকেই তারা বিচার প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হওয়ার পর ঢাকায় নিযুক্ত তৎকালীন পাকিস্তান হাইকমিশনার আশরাফ কোরেশী একটি বিতর্কিত মন্তব্যও করেন। আশরাফ কোরেশী সে সময় মন্তব্য করেছিলেন, ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের যেসব ঘটনা ঘটেছে, ১৯৭৪ সালে সম্পাদিত ত্রিপক্ষীয় (সিমলা) চুক্তিতে তার নিষ্পত্তি হয়েছে। আর ওই চুক্তি এ ইস্যুটির ব্যাপারে চূড়ান্ত রায় দিয়েছে বলে মনে করে পাকিস্তান’। তবে সে সময় আশরাফ কোরেশীর ওই মন্তব্যের প্রতিবাদ জানায় বাংলাদেশ সরকার। এ বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, যুদ্ধের নিয়ম অনুসারে ত্রিপক্ষীয় চুক্তির মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে চিহ্নিত ১৯৫ পাকিস্তানী নাগরিককে সেদেশে ফেরত পাঠানো হয়। চুক্তিতে সে কথাই উল্লেখ রয়েছে। বাংলাদেশের নাগরিক হয়ে যারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে হত্যা, খুন, অগ্নিসংযোগ ও ধর্ষণের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে তাদের কথা বলা নেই। তাই বাংলাদেশে যে বিচার হবে এটা দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। সে ঘটনার কয়েকদিন পরই তৎকালীন আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদের সঙ্গে এক বৈঠকে আশরাফ কোরেশী পাকিস্তানের অবস্থান সুস্পষ্ট করেন। আশরাফ কোরেশী আইনমন্ত্রীকে জানান, বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে পাকিস্তানের কোন আপত্তি নেই। তারা এ বিচারে পাকিস্তান কোন ধরনের হস্তক্ষেপ করবে না বলেও জানানো হয়। তবে বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও জামায়াত নেতা আলী আহসান মুজাহিদের ফাঁসি কার্যকরের পর পাকিস্তান সরকারের পক্ষ থেকে বিবৃতি দিয়ে এ বিচারকে প্রহসন বলে উল্লেখ করে দেশটি। এছাড়া তারা গভীর উদ্বেগও প্রকাশ করে। এ প্রেক্ষিতে ঢাকায় নিযুক্ত পাকিস্তানের হাইকমিশনার সুজা আলমকে তলব করে কড়া প্রতিবাদ জানায় বাংলাদেশ। তবে প্রতিবাদ জানানোর ঘটনা এই প্রথম নয়। এর আগেও একাধিকবার পাকিস্তান সরকার বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে প্রশ্ন তোলে। সে সময়ও ঢাকায় নিযুক্ত পাকিস্তানের হাইকমিশনারকে দুই দফা তলব করে কড়া প্রতিবাদ জানানো হয়। তবে বারবার পাকিস্তান একই ধরনের আচরণ করছে। বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যক্রম শুরুর পরই পাকিস্তান সরকার এই বিচার বানচালে নানামুখী তৎপরতা শুরু করে। এছাড়া যুদ্ধাপরাধী বিচার নিয়ে স্বাধীনতাবিরোধী দল জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের সঙ্গে পাকিস্তান সরকার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রেখে চলে। একই সঙ্গে পাকিস্তানের জামায়াতে ইসলামীও এদেশের জামায়াতে ইসলামী সঙ্গে গভীর যোগাযোগ রেখে চলে। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও আলী আহসান মুজাহিদের ফাঁসির পর পাকিস্তানের জামায়াতে ইসলামীর আমির সিরাজুল হক গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি বাংলাদেশ সরকারের সমালোচনাও করেন। এর আগে জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকর হওয়ার পরও সেদেশের জাতীয় পরিষদে নিন্দা প্রস্তাব পেশ করে পাকিস্তানের জামায়াতে ইসলামীর নেতা আকবর খান। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে যুদ্ধাপরাধ বিচার কার্যক্রম হাতে নেয়ার পরই পাকিস্তানের বিভিন্ন দূতাবাস যুদ্ধাপরাধী ইস্যুতে কূটনীতিক তৎপরতাও চালায়। পাকিস্তানের বিভিন্ন দেশের দূতাবাসের কূটনীতিকরা বাংলাদেশের বিদেশের দূতাবাস ও মিশনে যুদ্ধাপরাধ বিচার কার্যক্রম বন্ধের জন্য নানা ধরনের কার্যক্রম শুরু করে। এরই অংশ হিসেবে ২০০৯ সালের মে মাসে যুক্তরাষ্ট্রে এক বৈঠকে ওয়াশিংটনে নিযুক্ত পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত হোসেইন হাক্কানী বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবিরের কাছে যুদ্ধাপরাধের বিচার বন্ধের সরাসরি অনুরোধ জানান। জামায়াত নেতা কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকরের পরে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়, পাকিস্তান কোন দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে না। এরপরও আমরা দেখছি, বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও মানবাধিকার সংস্থাগুলো উদ্বেগ প্রকাশ করছে। বিচারের কারণে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা আরও বেড়ে গেছে। আমরা আশা করি, বাংলাদেশের ভ্রাতৃপ্রতিম জনগণ সংহতির মূল্য বুঝবে এবং সহিংসতামুক্ত পরিবেশ বিরাজ করবে। একই সঙ্গে সে সময় পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে কাদের মোল্লার মৃত্যুদ- কার্যকরের নিন্দা জানিয়ে একটি প্রস্তাব পাস করা হয়। কূটনৈতিক সূত্র জানায়, যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে বিগত কয়েক বছর ধরে ঢাকা-ইসলামাদের মধ্যে শীতল সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। এই বিচার নিয়ে দুই দেশের মধ্যে একটি টানাপোড়েন চলে আসছিল। বিশেষ করে ২০১৩ সালে পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে নেওয়াজ শরীফের নেতৃত্বাধীন দক্ষিণপন্থী দল মুসলিম লীগ ক্ষমতায় আসার পর দুই দেশের সম্পর্কে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরও গতিহীন হয়ে পড়ে। তবে বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও জামায়াত নেতা আলী আহসান মুজাহিদের ফাঁসির ঘটনাকে কেন্দ্র করে ঢাকায় নিযুক্ত পাকিস্তানের হাইকমিশনারকে তলবের পর এখন দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কে নতুন করে টানাপোড়েন শুরু হয়েছে। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও আলী আহসান মুজাহিদের ফাঁসি নিয়ে পাকিস্তান সরকারের বিবৃতির বিষয়ে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেছেন, এই বিবৃতি দিয়ে পাকিস্তান কূটনৈতিক শিষ্টাচার বহির্ভূত কাজ করেছে। তবে একটি ঘটনা কোন একটি দেশের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন বা পুনঃস্থাপনের মাপকাঠি হতে পারে না। আমি আশা করি, কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার মতো কোন পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে না, তাদের (পাকিস্তান) শুভবুদ্ধির উদয় হবে।
×