ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

আবুল মাল আবদুল মুহিত

ছেলেবেলা ও ছাত্রজীবন

প্রকাশিত: ০৩:৫৬, ২৪ নভেম্বর ২০১৫

ছেলেবেলা ও ছাত্রজীবন

ঢাকায় ছাত্রজীবনের সূচনা (২৩ নবেম্বরের পর) ক্রমে ক্রমে আরও কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা পায়। ১৮৮২ সালে পাঞ্জাব, ১৮৮৭ সালে এলাহাবাদ, ১৯১৬ সালে বেনারস হিন্দু এবং ১৯১৭ সালে পাটনা। ১৯১৮ সালে হায়দরাবাদে ওসমানিয়া ও ১৯২০ সালে আলীগড় হলো প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯২১ সালে একসঙ্গে তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় হলো ঢাকা, লাখনৌ এবং দিল্লী। ঢাকার বিশেষত্ব হলো যে, এটি হলো মূলত আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং এর অধীনে অন্য কোন কলেজ ছিল না। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় ছিল প্রধানত উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীদের পরীক্ষা নেয়ার জন্য; কিন্তু ঢাকার সে রকম কোন দায়িত্ব ছিল না। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ একটি হলের ছাত্র হওয়া। যারা হলে থাকত না তাদেরও হলের এটাচ্্ড ছাত্র হতে হতো। আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবন ছিল অত্যন্ত কর্মব্যস্ত। পড়াশোনার বাইরে নানা বিষয়ে- বিতর্কে, খেলাধুলায়, সমাজসেবায়, বিনোদনে সব কিছুতেই অংশগ্রহণের সুযোগ ছিল আবাসিক ছাত্র হিসেবে। একটি বিশেষ ক্ষেত্রে আমাদের ছিল সক্রিয় ভূমিকা- সেটা ছিল ছাত্র রাজনীতি। জাতীয় রাজনীতিতে অবসাদ এবং প্রতিবাদের অভাবই বোধ হয় ছাত্র রাজনীতিকে এত সক্রিয় ও প্রবল করে তোলে। ছাত্র রাজনীতিতে আমার সম্পৃক্তি বা ক্রিয়াশীল ভূমিকা শুরু হয় সিলেটে থাকতেই, ঢাকায় সম্ভবত তার বিস্তৃতি ও গভীরতা বৃদ্ধি পায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সম্বন্ধে আর একটি মন্তব্য কোনমতেই বাদ দেয়া যায় না। ১৯০৫ সালে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি বিভক্ত হয়। বেঙ্গলে ব্রিটিশ শাসন শুরু হয় বলে প্রথম দিকে নতুন যেসব এলাকা ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দখলে যেত সেগুলো বেঙ্গলের সঙ্গেই যুক্ত হয়। ব্রিটিশ শাসনের কেন্দ্রস্থল ছিল কলকাতা। সে কারণেও বেঙ্গল একটি বৃহদাকার প্রদেশে পরিণত হয়। তিন প্রদেশ নিয়ে হয় ব্রিটিশ রাজত্বের সূচনা। বেঙ্গল ছিল ব্রিটিশ শাসনের সবচেয়ে বড় প্রদেশ। তাতে অন্তর্ভুক্ত ছিল আসামের সুমর উপত্যকা, বর্তমান বাংলাদেশ, বর্তমান পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, ঊড়িষ্যা এবং সম্ভবত ঝাড়খণ্ডের কিয়দংশ। ব্রিটিশ ভারতের আয়তন কিন্তু বাড়তেই থাকে এবং তা সম্পূর্ণ হয় মোটামুটিভাবে ১৮৭৭ সালে যখন অযোধ্যা রাজ্য ব্রিটিশ সরকারের সরাসরি দখলে আসে। এর পরে একমাত্র বেরার রাজ্য ১৯০৩ সালে সরাসরি ভারত সরকারের অধীনে আসে। ব্রিটিশ ভারতের আয়তন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন এলাকা তিনটি প্রদেশের সঙ্গেই যুক্ত হয়। প্রথম পরিবর্তন হলো ১৮৩৩ সালে যখন আগ্রা ও দিল্লী নামে একটি নতুন প্রদেশ গঠিত হলো। ১৮৫২ সালে রেঙ্গুন ও বার্মার এলাকা রেঙ্গুনের সঙ্গে যুক্ত হলো। ১৮১৬ নাগপুরে ব্রিটিশ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা পেলে সেটা হলো বেঙ্গলের অংশ। তবে ১৮৫৬ সালে সেখানে আরও কিছু এলাকা যুক্ত করে হলো নাগপুর নামে পঞ্চম প্রদেশ। ১৮৫৬ সালে স্থাপিত হলো উত্তর-পশ্চিম প্রদেশ, যার অন্তর্ভুক্ত হলো দিল্লী আগ্রা প্রদেশ এবং আরও কিছু এলাকা। ১৯০২ সালে এই প্রদেশের নাম বদলে হলো যুক্ত প্রদেশ (টহরঃবফ চৎড়ারহপব)। ১৮৬১ সালে মারাঠাদের চূড়ান্ত পরাজয়ের পর নতুন প্রদেশ হলো কেন্দ্রীয় প্রদেশ (ঈবহঃৎধষ চৎড়ারহপব)। ১৮৭৪ সালে মনিপুর রাজ্য ও আরও কতিপয় স্থানীয় গোষ্ঠীকে পদাবনত করে নতুন একটি প্রদেশ হলো আসাম। তবে সেই প্রদেশে ব্রিটিশ শাসন ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে তার সঙ্গে বেঙ্গলের পূর্ব ও উত্তর-পূর্বের কতিপয় এলাকা সংযুক্ত করা হলো। (এ সময়ই সিলেট, কাছাড় ও গোয়ালপাড়া বেঙ্গল থেকে আসামে গেল)। ১৮৫৬ সালে বার্মা হলো একটি প্রদেশ। তবে ১৯৩৭ সালে বার্মাকে ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন করে একটি স্বতন্ত্র দেশ স্থাপিত হলো (যার বর্তমান নাম মিয়ানমার)। ১৯০১ সালে পাঞ্জাবের আয়তন কমিয়ে গঠন করা হয় উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ (ঘড়ৎঃয-ডবংঃ ঋৎড়হঃরবৎ চৎড়ারহপব)। ১৯০৫ সালে বেঙ্গলকে ভাগ করে এবং ১৮৭৪ সালে সৃষ্ট আসামকে একত্র করে সৃষ্টি হলো দু’টি প্রদেশ- বেঙ্গল এবং পূর্ব বাংলা ও আসাম। কিন্তু এই বিভাজন মাত্র কয়েক বছর স্থায়ী হয় এবং ১৯১১ সালে দুই বাংলাকে ভাগ করে হলো তিনটি প্রদেশ- বিহার ও ঊড়িষ্যা, বেঙ্গল এবং আসাম। ১৯৩৫ সালে দুটি নতুন প্রদেশ হলো সিন্ধু এবং উড়িষ্যা। তাই ব্রিটিশ ভারতে ১৯৩৭ সালে হলো এগারোটি প্রদেশ- বেঙ্গল, মাদ্রাজ, বোম্বাই, যুক্তপ্রদেশ, পাঞ্জাব, কেন্দ্রীয় প্রদেশ, আসাম, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, বিহার, সিন্ধু এবং উড়িষ্যা। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাস ছিল আসলে তিনটি, তবে চারটিও বলা যেতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শুরুতেই সলিমুল্লাহ মুসলিম হল এবং জগন্নাথ হল প্রতিষ্ঠিত হয়। তাদের নিজস্ব দালানকোঠা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের প্রথম দশ বছরের মধ্যেই সম্পন্ন হয়। পরবর্তীকালে আরও দু’টি হল প্রতিষ্ঠা পায় মুসলিম ছাত্রদের জন্য ফজলুল হক মুসলিম হল এবং অন্য ছাত্রদের জন্য ঢাকা হল। আমরা ঢাকায় এসে দেখলাম যে, জগন্নাথ হলটি প্রাদেশিক পরিষদ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে এবং জগন্নাথ হলের ছাত্ররা সবাই ঢাকা হলে স্থানান্তরিত হয়েছে। জগন্নাথ হল এবং সলিমুল্লাহ হলের মধ্যখানে ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবন, যেখানে রেজিস্ট্রার আবদুল হাদি তালুকদার সদম্ভে রাজত্ব করতেন। উপাচার্যের দফতরটি তার বাড়ির একাংশেই ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তখন সারা প্রদেশের একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার ফলে সেখানে ছাত্রসংখ্যাও বেশ বেড়ে যায়। তবে আবাসিক ব্যবস্থায় নতুন কোন সংযোজন হলো না। তার ফলে সলিমুল্লাহ হলের পাশে অবস্থিত এলাকায় ব্যারাক টাইপের কয়েক সারি স্থাপনায় একটি অনিয়ন্ত্রিত ছাত্রাবাস গড়ে ওঠে। এই ব্যারাকগুলো ইকবাল হল নামে পরিচিত ছিল এবং এখানে সচরাচর বয়ঃজ্যেষ্ঠ ছাত্ররা থাকতেন। আমার মনে হয় না সেখানে স্নাতক শ্রেণীর কোন ছাত্র ছিলেন। তারা ছিলেন নিয়মিত সময় উত্তীর্ণ কলা, বাণিজ্য বা বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র এবং বেশিরভাগ আইন অনুষদের ছাত্র। আমার মেজ মামা সৈয়দ শাহাদত হোসেনও এই ইকবাল হলে থাকতেন। তিনি তখন কিন্তু এমএ পাস করে গেছেন এবং আজাদ পত্রিকায় সম্পাদকীয় দফতরে কাজ করতেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি হলে ছাত্র ইউনিয়ন (বলতে গেলে সংসদীয় কায়দায় এক ধরনের ছাত্র সরকার) ছিল এবং প্রত্যেক বছর সেখানে নিয়মিতভাবে ইউনিয়নের কার্যকরী পরিষদ নির্বাচিত হতো। এই নির্বাচিত পরিষদের ছাত্রনেতা হতেন সহ-সভাপতি এবং আরও দু’জন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন সাধারণ সম্পাদক ও ক্রীড়া সম্পাদক। এছাড়াও আরও কয়েকটি নির্বাচিত পদ প্রতিটি নির্বাহী পরিষদে ছিল। নতুন ক্লাসে ছাত্র ভর্তি হওয়ার অব্যবহিত পরেই ইউনিয়নের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতো। ইউনিয়নের প্রধান কাজ ছিল শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ছাত্র উদ্যোগের পরিচালনা। যেমন খেলাধুলা, নাটক অভিনয়, বার্ষিক মিলাদ, হিন্দুদের দুর্গা এবং সরস্বতী পূজা ইত্যাদি। নিয়ম অনুযায়ী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য বিভিন্ন ছাত্রাবাস থেকে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি কেন্দ্রীয় ছাত্র ইউনিয়নও ছিল, যা ঢুকসু (উধপপধ টহরাবৎংরঃু ঈবহঃৎধষ ঝঃঁফবহঃং’ টহরড়হ) নামে পরিচিত ছিল। সম্ভবত ১৯৪৬ সালে দেশ বিভাগের কারণে ঢুকসু নির্বাচন মোটামুটিভাবে বন্ধ ছিল। ঢুকসুর পুনরাবির্ভাব হয় ১৯৫৩ সালে। আমাদের সলিমুল্লাহ হলে দুর্ভাগ্যবশত ১৯৫১ সালে কোন নির্বাচিত ছাত্র ইউনিয়ন ছিল না। সংসদীয় কায়দায় নিয়ম ছিল যে, নির্বাচিত ছাত্র ইউনিয়ন প্রথমেই তাদের বার্ষিক বাজেট পাস করবে। ১৯৫১ সালে একটি ত্রৈমাত্রিক ছাত্র ইউনিয়ন নির্বাচন হয় এবং নির্বাচিত ইউনিয়ন কার্যকরী পরিষদ তাদের বাজেটটি পাস করাতে ব্যর্থ হয়। এটিই সম্ভবত আজও বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি অনন্য রেকর্ড হয়ে আছে। নির্বাচিত কার্যকরী পরিষদ নিয়মিতভাবে বাজেট পেশ করে; কিন্তু তার জন্য ছাত্রদের সংগঠিত করে বাজেট সভায় হাজির হওয়ার ব্যবস্থা নেয়নি। এই সুযোগে প্রতিপক্ষ দু’টি দল মিলে বাজেট পাস করতে দিল না। তার ফলে সংসদীয় কায়দায় কার্যকরী পরিষদ বাতিল হয়ে গেল। ইউনিয়নের এই অভাব হল কর্তৃপক্ষ অর্থাৎ প্রভোস্ট সাহেব নানাভাবে কাটিয়ে ওঠার ব্যবস্থা করেন। যেমন তিনি কতিপয় ছাত্রকে বিভিন্ন বিষয় দেখাশোনা করার দায়িত্ব দেন। যথা- নাটক অভিনয়ের জন্য একজনকে সেই দায়িত্ব দেন, মিলাদ অনুষ্ঠানের জন্য আর একজনকে দায়িত্ব দেন। বার্ষিক সাহিত্য প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠানের জন্য আরেকজনকে দায়িত্ব দেন। ঠিক তেমনিভাবে বিভিন্ন খেলাধুলা পরিচালনার জন্য ক্যাপ্টেন বা সংগঠক মনোনীত করেন। তবে নির্বাচিত সংগঠন থাকলে যে ধরনের কার্যক্রম একটি হলে প্রতিপালন করা হয় সেটি ছিল না। তাই আমরা যারা নতুন ছাত্র-ছাত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিলাম তাদের জন্য কোন নবীনবরণ অনুষ্ঠান হলো না। এই অভাব পূরণের জন্য আমরা কয়েকজন উদ্যোগী হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে নবীনবরণ উৎসবের আয়োজন করলাম। যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকসু ছিল না, সুতরাং বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ধরনের কিছুই হতো না। এই উদ্যোগ নেয়ার ফলে আমাদের একটি উদ্যোগী পর্ষদ অজান্তেই গড়ে ওঠে। বিশ্ববিদ্যালয়ে অবশ্য আমরা আসার আগের বছরে সংস্কৃতি সংসদ নামে একটি প্রগতিশীল প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। এই প্রতিষ্ঠানের প্রথম সভাপতি ছিলেন ইংরেজী বিভাগের অধ্যাপক সারওয়ার মুর্শিদ খান এবং সম্পাদক ছিলেন ১৯৫০ সালের আইএ পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকারী অর্থনীতির ছাত্র আজিজুল জলিল। অবশ্য কিছুদিন পরেই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এসব ছাত্র উদ্যোগে শিক্ষকদের অংশগ্রহণ বারণ করে দিলেন। তখন আজিজুল জলিল হলেন এর সভাপতি এবং সম্পাদক হলেন হাফিজুর রহমান চৌধুরী মনা। তারা আমাদের সংগঠনে অংশ নিতে আহ্বান করলেন। প্রথম দিকে আমরা ওই আহ্বানে তেমন সাড়া দিইনি এবং নিজেরা একটি সংগঠন গড়ে তুলতে চেষ্টা করি। আমরা সংগঠনের উদ্যোগে একটি দেয়াল পত্রিকা প্রকাশ করি। অবশ্য কিছুদিন পর বুঝতে পারলাম যে, আর একটি সমান্তরাল প্রগতিশীল প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা সঠিক নয় এবং তাই আমাদের উদ্যোগের সমাপ্তি টানি। আমরা উদ্যোগের নাম দিয়েছিলাম ‘প্রগতিসংঘ’। আগস্ট মাসের ৩১ তারিখে দেয়াল পত্রিকাটি প্রকাশ করি। চলবে...
×