ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

শামীম হাসান

নবান্নরে উৎসব

প্রকাশিত: ০৬:৩৭, ২৩ নভেম্বর ২০১৫

নবান্নরে উৎসব

ষড়ঋতুর দেশ বাংলাদেশ। সময়ের পরিক্রমায় ঋতু চক্রের প্রভাবে প্রতিটি ঋতুই তার নিজস্ব রূপবৈচিত্র্যে প্রকৃতিতে আবির্ভূত হয়। হেমন্তেরও আছে নিজস্ব রূপ। হেমন্তে গ্রীষ্মের দাবদাহের রুক্ষতা নেই, নেই বর্ষার বিড়ম্বনা, নেই শীতের দুঃসহ শৈত্যপ্রবাহ। এমনকি বসন্তের মতো বর্ণ, গন্ধ বা পাখির কলকাকলীতে মুখরিতও নয় হেমন্ত। তবুও হেমন্ত নিজস্ব রূপ লাবণ্যে ভরপুর। বাংলাদেশে হেমন্ত আসে ধীর পদক্ষেপে, শীতের পরশ আলতো করে গায়ে মেখে। আবার সঙ্গে থাকে শরতের ¯িœগ্ধতা। শরতও শীত অঙ্গে ধারণ করে এই হেমন্ত। শরত থেকে সে খুব পৃথক নয়, শীত থেকে তেমনি বিছিন্ন নয় তার প্রকৃতি। হেমন্ত শান্ত, ধ্যানমগ্ন ঋষির মতো। প্রকৃতির রূপবৈচিত্র্যে হেমন্ত লাজুক প্রকৃতির। হেমন্তের সকাল হালকা কুয়াশার চাদরে ঢাকা থাকে। ভোরের কাঁচা কোমল রোদ, মৃদু হিম স্পর্শ প্রাণে শিহরণ জাগায়। শিশির ভেজা ঘাষের ডগায় যেন মুক্তোর মেলা। তার ওপর সূর্যের কাঁচা আলো পড়ে যেন হীরকের দ্যুতি ছড়ায়। কুয়াশার ঘোমটা খুলে সূর্য যেন ধীরে ধীরে তার শৈশব, কৈশোর ও যৌবনের রূপে আবির্ভূত হয়। উদীয়মান সূর্যের দিকে তাকিয়ে থাকলে তার এই রূপের বৈচিত্র্যতা যেন চোখের সামনে ভাসতে থাকে। হেমন্তেই দেখা যায় সোনা রোদের ঝিলিক। সকাল ও পড়ন্ত বিকেলের এই সোনারোদ যেন সারা অঙ্গে মাখিয়ে দিয়ে যায়। হেমন্তেও দেখা যায় শরতের মতো মেঘমুক্ত নীলাকাশ। সেই সঙ্গে সাদা মেঘের আনাগোনা। হেমন্তের মৃদু হিম মাখানো হাল্কা-হাওয়ায় ঝর ঝর করে ঝরে পড়ে গাছের পাতা। রাতের বেলায় মৌন, ধ্যানমগ্ন প্রকৃতিতে সেই মৃদু শব্দও কানে শিহরণ জাগায়। হেমন্তের শান্ত সৌম্য রূপে মুগ্ধ হয়ে সৃষ্টি হয়েছে অসংখ্য লোকগাথা, গল্প, গান ও কবিতা। হেমন্তের প্রকৃতির বর্ণনা ফুটে উঠেছে কবি গুরুর ‘নৈবেদ্য স্তব্দতা’ কবিতায়Ñ আজি হেমন্তের শান্তি ব্যাপ্ত চরাচরে জনশূন্য ক্ষেত্র মাঝে দীপ্ত দ্বিপ্রহরে শব্দহীন গতিহীন স্তব্দতা উদার রয়েছে পড়িয়া শান্ত দিগন্ত প্রসার স্বর্ণশ্যাম ডানা মেলি। হেমন্তের বিশেষ রূপ হচ্ছে দিগন্ত বিস্তৃত সোনালী ধানের মাঠ। বর্ষার শেষ দিকে বোনা আমন-আউশ শরতে বেড়ে ওঠে। আর হেমন্তে এসে তা পাকা ধরে। তাই তো গ্রাম-বাংলার মাঠে মাঠে এই সময় ধান কাটার ধুম পড়ে যায়। কাকডাকা ভোরে কৃষকের ধান কাটা শুরু হয়। আর গোধূলি লগ্নে ধানের আঁটি মাথায় মেঠোপথে কৃষকরা সারিবদ্ধভাবে ঘরে ফেরেন। কী এক অপূর্ব দৃশ্য! যেন ফ্রেমে বাঁধানো কোন ছবি। ধান কাটার সময় মাঠে ছড়িয়ে পড়া ধান খাওয়ার জন্য ঘুরঘুর করে টিয়া, ময়না ও শালিকেরা। মাঠের এই দৃশ্য পল্লী কবি জসিমউদ্দীনের চোখে ধরা পড়েছে এভাবেÑ সবুজে হলুদে সোহাগ চুয়ায়ে ধান ক্ষেত পথের কিনারে পাতা দোলাইয়া করে সাদা সংকেত ছড়ায় ছড়ায় জড়াজড়ি করি বাতাসে ঢলিয়া পড়ে ঝাঁকে আর ঝাঁকে টিয়া পাখিগুলি শুয়েছে মাঠের পরে। নতুন ফসল ঘরে তোলার উৎসবে মেতে উঠে কৃষক পরিবার। চারদিকে পাকা ধানের গন্ধে ম ম করে। কিষানিরা ঢেঁকিতে ধান ভানতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ঘরে ঘরে ঢেঁকি নাচে দাপুর দাপুর। জা-জায়ে বা ননদে-ভাবিতে কাঁধে কাঁধে হাত রেখে ছন্দে ছন্দে ঢেঁকিতে পাড় দিয়ে যাচ্ছেন। গোলা ভরে গেছে নতুন ধানে। তাই তো কিষান-কিষানির চোখেমুখে আনন্দ। এই আনন্দ সবার সঙ্গে ভাগাভাগি করতে শুরু হয়ে যায় গ্রাম-বাংলার নবান্ন উৎসব। নতুন ধানের চাল দিয়ে তৈরি করা হয় হরেক রকমের পিঠা, পায়েস, ক্ষীরসহ নানা খাবার। হেমন্ত নিয়ে কবি সুফিয়া কামাল তাঁর কবিতায় লিখেছেনÑ এই তো হেমন্ত দিন, দিল নব ফসল সম্ভার অঙ্গনে অঙ্গনে ভরি, হে রূপ আমার বাংলার রিক্তের অঞ্চল ভরি, হাসি ভরি, ক্ষুধার্তের মুখে ভবিষ্যৎ সুখের আশা ভরি দিল কৃষকের বুকে মাতা হেরিতেছে নবান্ন আসন্ন উৎসবে বিমুগ্ধ নয়নে হেরি পরিপূর্ণ ফসলের ভার। নবান্ন উৎসব হলো বাংলার প্রাচীন একটি উৎসব। বাংলার কৃষিজীবী সমাজে শস্য উৎপাদনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যে সকল আচার-অনুষ্ঠান ও উৎসব পালিত হয়, নবান্ন তার মধ্যে অন্যতম। নবান্ন উৎসব হলো নতুন আমন ধান কাটার পর সেই ধান থেকে প্রস্তুত চালের প্রথম রান্না উপলক্ষে আয়োজিত উৎসব। উৎসবের মূল বিষয় হলো ফসল তোলার পর দিনই ধানের নতুন চালে ফিরনি-পায়েস বা ক্ষীর তৈরি করে আত্মীয়স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীদের ঘরে ঘরে বিতরণ বা দাওয়াত খাওয়ানো। নবান্নে জামাইকে নিমন্ত্রণ করা হয়। এ সময় মেয়েকে বাপের বাড়িতে নাইওর আনা হয়। নতুন চালে তৈরি করা হয় নানা ধরনের পিঠা আর মুড়ি-মুড়কি। সারা বছর যত ধরনের পিঠা তৈরি হয় তার বেশিরভাগই তৈরি করা হয় এই হেমন্ত ও শীতকালে। বন্যার পানি চলে যাওয়ায় এ সময় পুকুর, খাল-বিলে ধরা পড়ছে মাছ। বাড়ির আঙিনায় ঝুলছে কচি কচি লাউ। পালানে আবাদ হয়েছে বেগুন, মুলা, ফুলকপিসহ নানা ধরনের সবজি। সেই সঙ্গে আছে নতুন ধানের চাল। মরা কার্তিকের পরে তাই তো কৃষকের মনে এত আনন্দ। এ জন্যই প্রস্তুতি চলে বিভিন্ন উৎসব আয়োজনের। সাধারণত অগ্রহায়ণ মাসে আমন ধান পাকার পর এই উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। এই উৎসব এখন আর গ্রামাঞ্চলেই সীমাবদ্ধ নেই। বর্তমানে ঢাকা শহরসহ অন্য অনেক শহরেই এই উৎসব পালিত হয়। ১৯৯৮ সাল থেকে ঢাকা শহরে আনুষ্ঠানিকভাবে নবান্ন উদ্যাপন শুরু হয়েছে। জাতীয় নবান্নোৎসব উদ্যাপন পরিষদ প্রতি বছর পহেলা অগ্রহায়ণ তারিখে নবান্ন উৎসব উদ্যাপন করে। এ বছরও সাড়ম্বরে পালিত হয়েছে নবান্ন উৎসব। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার বকুল তলায় অনুষ্ঠিত হয় দেশের সবচেয়ে বড় নবান্ন উৎসব। ভোর হতে রাতব্যাপী অনুষ্ঠিত এই উৎসবে যেন ফুটে উঠেছিল আবহমান বাংলার চিরায়ত রূপ। কুয়াশার চাদর চিড়ে ভোরের নরম আলো গায়ে মেখে শুরু হয় অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানের স্লোগান ছিল ‘এসো মিলি সবে নবান্নের উৎসবে।’ মঞ্চে পরিবেশিত হয়েছে মাটি, মানুষ ও প্রকৃতির গান, আবৃতি হয়েছে হেমন্তের কবিতা ও প্রদর্শিত হয়েছে লোকনৃত্য। বের হয়েছে নবান্নের শোভাযাত্রা। পোশাকে ছিল উৎসবের ছোঁয়া। মেয়েরা রঙিন শাড়ি সঙ্গে খোঁপায় ফুল গুঁজে আর ছেলেরা পাজামা-পাঞ্জাবি পরে এসেছিল। দেশের নানা অঞ্চলের নানা ধরনের পিঠার স্টল ছিল এই নবান্ন উৎসবের অন্যতম আকর্ষণ। পিঠা খেয়ে আগত লোকজন পেয়েছে গ্রামের স্বাদ। কারও স্মৃতিপটে ভেসে উঠেছে দাদি-নানির হাতে বানানো পিঠা খাওয়ার কথা। নবান্ন উৎসব বাংলার একটি প্রাচীন ও একান্ত নিজস্ব সংস্কৃতি। নবান্ন উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানের মাধ্যমেই আমরা বর্তমান প্রজন্মকে পরিচয় করিয়ে দিতে পারি আমাদের লোকজ সংস্কৃতির সঙ্গে। আমাদের এই উৎসবটিই হতে পারে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে একটি দেশীয় সার্বজনীন উৎসব। ছবি : আরিফ আহমেদ মডেল : মেহজাবিন
×