ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আবুল মাল আবদুল মুহিত

ছেলেবেলা ও ছাত্রজীবন

প্রকাশিত: ০৫:২৭, ২১ নভেম্বর ২০১৫

ছেলেবেলা ও ছাত্রজীবন

আমার ভাইবোনেরা (১৯ নবেম্বরের পর) আরও স্মৃতি রোমন্থনের শুরুতে আমার ভাইবোনদের সম্বন্ধে কিছু বলতে চাই। আগেই বলেছি আমরা চৌদ্দ ভাইবোনের মধ্যে এগারোজন এখনও জীবিত। আমাদের সবচেয়ে বড় বোন আয়েশা খাতুন (নিনা) আগামী ২২ নবেম্বরে ৮৬ বছর পূর্ণ করবেন। তিনি সিলেটে নয়া সড়কে কিশোরী মোহন বালিকা বিদ্যালয়ে ভর্তি হন ১৯৩৯ সালে। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে সেই স্কুলের ঘোড়াগাড়িতে যাতায়াত বন্ধ হয়ে গেল এবং আমার বোনেরও বিদ্যালয় যাওয়া বাধাগ্রস্ত হলো। যুদ্ধ শেষে তার স্কুলে যাওয়া জানি না কি কারণে বন্ধ হয়ে গেল। ১৯৪৬-এ তার প্রবেশিকা পরীক্ষা দেবার কথা ছিল, সেটা আর হয়ে উঠল না। তখন কিছুদিন আমাদের এক ফুফা সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক সানওয়ার বখত চৌধুরী তাকে আরবী ও ধর্মশিক্ষা প্রদান করেন। ১৯৪৭ সালের শেষ দিকে আব্বার শিক্ষক ও এক সময়ের অভিভাবক আবদুল গফুর চৌধুরী বুবুর জন্য একটি বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসেন। বর ছিলেন মৌলভীবাজারের আগনসী গ্রামের ছেলে আসাম সরকারে দ্বিতীয় শ্রেণীর কর্মকর্তা সমবায় ডাইরেক্টরেটের পরিদর্শক (ইন্সপেক্টর) মোহাম্মদ মজক্কির। তার ছিল এক বড় ও এক ছোট বোন। যাদের কারোই কোন সন্তান জীবিত ছিল না। তার মা সামিনা বেগম এবং এক মামা ছিলেন অভিভাবক। তার জন্ম হয়েছিল ১৯২০ সালের জানুয়ারি মাসে। তিনি মৌলভীবাজারেই পদায়িত ছিলেন এবং সেখানে তার নিজের বাড়িতেই বসবাস করতেন। তাদের ছিল একটি সচ্ছল পরিবার এবং গ্রামের বাড়িতে অন্য শরিক ছিলেন এক চাচাতো বড় ভাই কদর মিয়া ওরফে আবদুল খালিক। আমার দাদা বললেন, ‘গফুর যখন প্রস্তাব এনেছে তা হলে সেটি দেখেশুনেই এনেছে এবং ছেলের বিষয়ে কিছু খোঁজ-খবর নিয়ে রাজি হওয়া যায়।’ মোহাম্মদ মজক্কিরের সঙ্গে বুবুর বিয়ে ঠিক হয়ে গেল এবং বিয়েটি হলো ১৯৪৮ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি। বুবুকে দুলাভাইয়ের একটি ছবি দেখানো হয় এবং তিনি বিয়েতে সম্মতি দেন। মোহাম্মদ মজক্কির আমাদের দুই ভাই থেকে বেশ বড় ছিলেন (১৬/১৮ বছর) এবং তিনি বাস্তবে আমাদের একজন বড় ভাই হিসেবেই সারাজীবন বিবেচিত হন। মৌলভীবাজারে তিনি বেশ কিছুদিন পদায়িত ছিলেন। সেখানে ১৯৪৯ সালের ১ মে তার প্রথম সন্তান সিলভির জন্ম হয়। বাচ্চা বয়সে সে অসুস্থ হলে তাকে তার মাসহ সিলেটে নিয়ে আসা হয় এবং সে ১১ অক্টোবর ইন্তেকাল করে। আমার তাতে কেমন ব্যক্তিগত দোষবোধ জাগে, কারণ আমিই তাদের গাড়ি করে সিলেটে নিয়ে আসি এবং আমার বিলম্বের কারণে তাদের বেশ কষ্ট হয়। তারা নৌকা করে মৌলভীবাজার সিলেট সড়কের একটি নির্দিষ্ট ঘাটে আসেন যথাসময়ে, তবে আমার দেরিতে সেখানে তাদের প্রায় ঘণ্টা দুয়েক অপেক্ষা করতে হয়। সেই বাচ্চা সিলভিকে এক বৃষ্টির দিনে আমি নিজ হাতে আমাদের পারিবারিক গোরস্তানে নামিয়ে দিয়ে চিরনিদ্রায় শায়িত করি। আমার বুবু আটটি জীবিত কন্যা সন্তানের জননী এবং তারা সবাই তাদের পরিবার নিয়ে সুখে-শান্তিতে আছে। তার বড় মেয়ে শফিক ফাতেমা একজন লেখিকা আর তার স্বামী ডাঃ বদরুজ্জামান একজন চিকিৎসক হিসেবে বর্তমানে মৌলভীবাজারে থাকে। দ্বিতীয় মেয়ে ফাতেমা পারভীন বিয়ের পরেই আমেরিকায় তার স্বামী বেল ল্যাবরেটরির প্রকৌশলী বরিশালের ছেলে সিরাজুল ইসলামের সঙ্গে চলে যায়। বর্তমানে তারা অবসর জীবন ঢাকায় এবং আমেরিকায় ছেলেমেয়েদের সঙ্গে কাটায়। তৃতীয় সন্তান নাইম ফাতেমা সিলেটে তার স্বামী ডাঃ একেএম হাফিজের সঙ্গে থাকে। হাফিজ নাক কান গলা বিশেষজ্ঞ। আর নাইম একটি শিশু স্কুলের প্রধান শিক্ষক। চতুর্থ কন্যা মমতাজ শামিম বর্তমানে সিলেটে মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান এবং তার স্বামী ড. আহমদ আল কবীর সীমান্তিক নামক এক বেসরকারী মানব উন্নয়ন সংস্থার প্রধান। পরবর্তী মেয়ে শামসাদ কুহেল বর্তমানে আমেরিকায় ইয়েল এলাকায় আছে। তার স্বামী সৈয়দ বজলুল হক ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক থাকাকালে অবসর নিয়ে প্রবাসী হয়ে যায়। সপ্তম মেয়ে জুঁই ফারজানাও ইয়েলের বাসিন্দা, সেখানে তার স্বামী ওয়াহেদ মাহমুদ একটি চেইন স্টোরের পণ্য খরিদ বিভাগের শীর্ষ ব্যক্তি। কনিষ্ঠতম কন্যা ডাঃ নাহিদ ইলোরা সিলেটে নর্থ ইস্ট চিকিৎসা কলেজের অধ্যাপক এবং তার স্বামী অধ্যাপক ডাঃ সৈয়দ আহাদ মামুন সিলেট সরকারী চিকিৎসা কলেজের চর্মরোগ বিভাগের প্রধান। আমার দুলাভাই ১৭ জানুয়ারি ২০০১ সালে মৌলভীবাজারে তার নিজের বাড়িতে একজন সুখী মানুষ হিসেবে ইন্তেকাল করেন। তিনি সমবায় দফতরের সহকারী নিবন্ধক হিসেবে ব্রাহ্মণবাড়িয়া, আখাউড়া, কিশোরগঞ্জ, রংপুর, চট্টগ্রাম, ঢাকা ও কুমিল্লা হয়ে ডেপুটি নিবন্ধক হিসেবে চট্টগ্রামে ছিলেন মুক্তিযুদ্ধকালে। পরবর্তীকালে তিনি কুমিল্লায় কো-অপারেটিভ কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে অবসরে যান। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে আমি আমার বন্ধু মহলে মাস শেষে কাউকে কাউকে সহায়তা করতাম। আমার টানাটানি হলে মুশকিল আসান করতেন আমার দুলাভাই। একমাত্র রংপুর ছাড়া তার প্রতিটি কর্মস্থলে আমি কোন না কোন সময় বেড়াতে যাই। বুবু বর্তমানে তার মেয়েদের সঙ্গে ঢাকায় অবস্থান করছেন। মাঝে-মধ্যে বার্ধক্যজনিত অসুস্থতায় ভোগেন। সিলেটে বহুদিন তিনি তার তৃতীয় মেয়ের সঙ্গে ছিলেন; কিন্তু এখন আর ভ্রমণ করতে চান না। বড় ভাই ড. আবু আহমদ আবদুল মুহসি আমার দু’বছরের বড় ছিলেন (জন্ম ৬-২-৩২, মৃত্যু ৩০-৩-২০০৮)। আমরা একই সময়ে একই ক্লাসে সিলেট সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হই। তিনি ১৯৫৪ সালে সিলেট মুরারীচাঁদ কলেজ থেকে বিএসসি (বিজ্ঞানে স্নাতক) পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বোটানিতে মাস্টার্স ডিগ্রী নিয়ে কিছুদিন তেজগাঁওয়ের কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। ১৯৬১ সালে তিনি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বৃত্তি পেয়ে টেক্সাস এ এ্যান্ড এম কলেজে (পরবর্তীকালে বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত) উচ্চশিক্ষা নিতে যান এবং ১৯৬৪ সালে পিএইচডি পেয়ে ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। সেখানে তিনি ১৯৮৫-৮৬ সালে কৃষি বিভাগের ডীন হন ও ১৯৯৮ সালে অবসর নিয়ে ঢাকায় অবসর জীবনযাপন করেন। ১৯৬৬ সালের ২৮ আগস্ট তার বিয়ে হয় বগুড়ার সাতআনি বাড়ির আহমেদুর রহমান চৌধুরীর দ্বিতীয় কন্যা আমেনা বেগমের সঙ্গে। ভাবি ১৭ আগস্ট ২০০৩ সালে পরলোকগমন করেন। আমার বড় ভাই অবসরে যাবার পর আবিষ্কার করলেন যে, তিনি ডায়াবেটিসে ভুগছেন। কিন্তু রোগীর নিয়ম-নীতি মানতে তিনি তেমন মনোযোগী ছিলেন না। আমাদের পরিবারে তিনিই প্রথম এই রোগে আক্রান্ত হন এবং মৃত্যুকালে এই রোগেই তার প্রাণবায়ু বেরিয়ে যায়। ইতোমধ্যে তাদের বড় মেয়ে ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃষি প্রকৌশলী হিসেবে স্নাতক ডিগ্রী লাভ করে বৃত্তি পেয়ে ১৯৮৫ সালে জাপানে যায়। সেখানে আইনকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করে দেশে প্রত্যাবর্তন করে ১৯৯২ সালে। তারপর তার বিয়ে হয় ২০০০ সালের ৭ ডিসেম্বর কানাডা প্রবাসী প্রকৌশলী মোহাম্মদ মহসিনের সঙ্গে। তাদের একটি মেয়ে আছে এবং তারা ভানকুভারে বসবাস করে। বড় ভাইয়ের দ্বিতীয় সন্তান আবু আহমদ ফজলে মুকিম ১৯৯৪ সালে ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিকম পাস করে। ১৯৯৬ সালে সিঙ্গাপুরে মার্চেন্ট নেভির জন্য প্রশিক্ষণ ইন্সটিটিউটে ভর্তি হয়। মার্চেন্ট নেভিতে সে চাকরি করার ফাঁকে ফাঁকে ২০০৩ সালে জাহাজ ক্যাপটেনের সনদপ্রাপ্ত হয়। ২০০৭ পর্যন্ত মার্চেন্ট নেভিতে নিযুক্ত ছিল। ২০০৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি পূর্ণা ইশিকা নামের একটি মেয়েকে পরিবারের সম্মতি নিয়ে সে বিয়ে করে। তাদের একটি কন্যা সন্তান এলাইনা ফারিশতা ২০১৪ সালে ১২ মার্চ জন্মগ্রহণ করে। আমার ভাইপো মুন্সীগঞ্জের জাহাজ নির্মাণ কোম্পানি খান এ্যাসোসিয়েটসের একজন অংশীদার এবং প্রকৌশলী পরিচালক। চলবে...
×