ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

হেমন্তের সোনাঝরা রোদে বসে বিশ্ব সাহিত্যের একক প্লাটফর্মের কথা শোনালেন নোবেল জয়ী মার্কিন বিজ্ঞানী

সাহিত্যের সঙ্গে বিজ্ঞানের সমন্বয়েই ত্বরান্বিত হয় উন্নয়নের ধারা

প্রকাশিত: ০৫:২৩, ২১ নভেম্বর ২০১৫

সাহিত্যের সঙ্গে বিজ্ঞানের সমন্বয়েই ত্বরান্বিত হয় উন্নয়নের ধারা

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ছুটির দিনের সকাল থেকেই দেশ-বিদেশের লেখকদের পদচারণায় মুখর হয়ে ওঠে বাংলা একাডেমির আঙিনা। সঙ্গে ছিলেন সাহিত্যপ্রেমীসহ সৃজনশীল ভুবনের ব্যক্তিবৃন্দ। সব মিলিয়ে হেমন্তের সোনাঝরা সকালের রোদে ভিন্ন রকমের আবহ বিরাজ করেছে একাডেমি প্রাঙ্গণজুড়ে। দেশের সাহিত্যকে বিশ্ব দরবারে পৌঁছে দেয়া এবং বিদেশী সাহিত্যকে জানার বহুমুখী আনুষ্ঠানিকতায় উজ্জ্বলতা ছড়ানো এমন পরিবেশের উপলক্ষ ছিল ঢাকা লিট ফেস্ট। সব মিলিয়ে উৎসবে দেখা মিলেছে দেশের সাহিত্য ভুবনে নতুন দিনের প্রত্যাশার চিত্র। তিন দিনের আন্তর্জাতিক এই সাহিত্য উৎসবের দ্বিতীয় দিন ছিল শুক্রবার। সকাল থেকে রাত অবধি অনুষ্ঠিত হয়েছে ৩৩ অধিবেশন। একাডেমির খোলা আঙিনা, আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ মিলনায়তন, কে কে টি স্টেজ, ভাষা মঞ্চ, বটতলা ও কসমিক টেন্টে অনুষ্ঠিত হয় চিন্তা ও মননের খোরাক জোগানো এসব অধিবেশন। উল্লেখযোগ্য আয়োজনের মধ্যে প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক শোনালেন তার জীবনের গল্প। উন্মোচিত হয়েছে কায়সার হক অনূদিত মনসা মঙ্গল বইয়ের মোড়ক। পরিবেশিত হয়েছে বেহুলার লাচারি। যাত্রা শুরু করল ঢাকা ট্রান্সলেশন সেন্টারের তত্ত্বাবধানে লাইব্রেরি অব বাংলাদেশ। এছাড়াও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহানের স্মৃতিচারণমূলক বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করা হয়। ছুটির দিন শিল্পিত উচ্চারণে কবিতা শুনতে উৎসবে হাজির হয়েছিলেন নোবেলজয়ী মার্কিন বিজ্ঞানী হ্যারল্ড ভারমাস। দ্বিতীয় দিনের উৎসবের একটি অধিবেশনে শ্রোতা হয়ে কবিতা শুনছিলেন প্রথম জীবনে সাহিত্যে স্নাতক করা নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী হ্যারল্ড ভারমাস। এ সময় কথা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সাহিত্যের মধ্য দিয়ে নবজাগরণ আসতে পারে। যুগে যুগে, কালে কালে সেটাই হয়েছে। বিশ্বসাহিত্যের একটা প্ল্যাটফর্ম থাকলে সেখানে সবার অংশগ্রহণের মাধ্যমে সৃষ্টি হতে পারে নতুন কিছু। কবিতা শোনার একপর্যায়ে তিনি একাডেমির ভাস্কর নভেরা গ্যালারির উপরের একটি কক্ষে গিয়ে বসেন। বাংলাদেশ প্রসঙ্গে এই নোবেলজয়ী বলেন, এদেশের ব্যাপারে আমার জানাটা খুব বেশি নয়। তবে যে কোন জাতিকে শিল্প-সাহিত্যে এগিয়ে যেতে হলে শিক্ষাব্যবস্থা মানসম্মত হওয়া জরুরী। জানার কোন বিকল্প নেই। সাহিত্যের সঙ্গে বিজ্ঞানের সমন্বয় ঘটাতে পারলে উন্নয়নের ধারা ত্বরান্বিত হয়। বাংলাদেশের বিজ্ঞান কমিউনিটিতে যারা আছেন তারা এক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারেন। বর্তমান পৃথিবীতে বাংলাদেশের মতো দেশের জন্য জলবায়ু পরিবর্তন মোকবেলা করাও একটি বড় চ্যালেঞ্জ বলে মন্তব্য করেন তিনি। বাংলাদেশে সফর সম্পর্কে জানতে চাইল বলেন, লুই কানের নকশায় গড়েওঠা জাতীয় সংসদ ভবন দেখার ইচ্ছা আছে। লিট ফেস্টের দ্বিতীয় দিনে গল্প বলার একটি চমৎকার অধিবেশন উপহার দেন কেনিয়ার গল্পকথক মুথনি গারল্যান্ড। মাইক্রোফোন হাতে কণ্ঠের ওঠানামার সঙ্গে শরীরের বিচিত্র অঙ্গভঙ্গি দিয়ে তিনি গল্পগুলো প্রাণবন্তভাবে উপস্থাপন করেন। তার এই গল্প দারুণ উপভোগ করে কিশোর ও তরুণ সাহিত্যরসিকরা। ‘মিস্টিক্যাল ডাইমেনশন’ নামে সকালে, আরেকটি চমৎকার সেশন ছিল দুপরে। এখানে রুমি, কবির, হাফিজের মতো অধ্যাত্মবাদী কবিকে নিয়ে কথা বলেন কবি অরবিন্দ কৃষ্ণা মেহেরোত্রা, লেখক ফারুক দ-ি ও প্যাট্রিক লুড। বরেণ্য কথাশিল্পী হাসান আজিজুল হকের জীবনজুড়ে লেখা শীর্ষক অধিবেশনটিও ছিল এককথায় চমৎকার। গল্পছলে এই লেখক বলেছেন দেশ বিভাগের সময় জন্মভূমি ছেড়ে আসার কথা। মেলে ধরেন বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন কিভাবে ও কতটা প্রভাব ফেলেছে তার লেখালেখির ভুবনে। দিনের শুরুতেই ছিল নাত-ই রাসুলের মনোমুগ্ধকর সুর। বিশিষ্ট কণ্ঠশিল্পী নাশিদ কামাল পরিবেশন করেন নাত। সকালের মূল আকর্ষণ ছিল ফিলিস্তিনী কবি ঘাসান জাকতান ও ফেইদি জৌহাদের আলোচনা পর্বটি। সঞ্চালন করেন ব্রিটিশ সাংবাদিক জন স্নো। আলাপের শুরুতেই জন স্নো ঘাসান জাকতান ও ফেইদি জৌহাদকে অনুরোধ করেন একটি করে কবিতা পড়ে শোনাতে। কবি জাকতান মন্দ্রিত কণ্ঠে প্রথমে আরবীতে ও পরে ইংরেজীতে স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি করেন। কবি জৌহাদও নিজের একটি কবিতা দর্শক-শ্রোতার উদ্দেশে উপস্থাপন করেন। দুটি কবিতাই ছিল ফিলিস্তিনের জীবন ও অভিজ্ঞতার অনন্য বয়ান। এরপর আলোচনা শুরু হলে দুই কবিই শোনান তাদের ছেলেবেলার গল্প, উদ্বাস্তু হওয়ার অভিজ্ঞতা ও কবিতা লেখার প্রেরণার কথা। উৎসবের দ্বিতীয় দিনে আন্তর্জাতিক ম্যাগাজিন ওয়াসাফেরির বিশেষ সংখ্যা বাংলাদেশ ইস্যুর প্রকাশনা অনুষ্ঠিত হয় ভাষা মঞ্চে। বাংলাদেশের সাহিত্য ও নবীন প্রতিভাধর সাহিত্যিকদের বিশ্বের সাহিত্য অঙ্গনে তুলে ধরার তাগিদেই নেয়া হয়েছে এই উদ্যোগ। দুই উৎসব পরিচালক কাজী আনিস আহমেদ ও আহসান আকবর প্রকাশনা অনুষ্ঠানে ওয়াসাফেরির বাংলাদেশ সংখ্যার অনলাইন ও প্রিন্ট সংখ্যা দর্শকের সামনে প্রদর্শন করেন এবং সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর দেন। এদিন কেকেটি স্টেজে অনুষ্ঠিত হয় ‘এ মাল্টি ভার্স অব আইডিয়াজ’ শীর্ষক অধিবেশন। এতে অংশ নেন কিউবার কল্পবিজ্ঞান লেখক ও রকস্টার ইয়োস। আয়োজনটি সঞ্চালনা করেন সাদ জেড হোসেন। আরও ছিলেন সাহিত্যিক রনবীর সিধু ও ঔপন্যাসিক মার্সেল থেরোক্স। বক্তাদের আলোচনায় উঠে আসে বিজ্ঞানমনস্ক লেখার নানা ধরন ও টেকনিক। ‘দ্য ট্রায়াম্প অব স্ন্যাক গডেজ’ সেশনে কায়জার হকের অনুবাদে মনসা মঙ্গল কাব্যগ্রন্থের মোড়ক উন্মোচিত হয়। বইটি নিয়ে নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলেন কায়জার হক। ভাষাবিষয়ক অনন্য আয়োজন ‘মাদার টাং’-এ অংশ নেন লেখক ও শিক্ষাবিদ সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, ভারতীয় প্রাবন্ধিক কিরণ নাগরকর ও মারাঠী লেখক বিনিয়ামিন। সঞ্চালনায় ছিলেন মাসরুর আরেফিন। এ সময় বক্তারা সাহিত্যে মাতৃভাষার ব্যবহার ও তার অনুবাদ নিয়ে পর্যালোচনা করেন। বক্তারা প্রত্যেকেই নিজ দেশে অনুবাদক হিসেবে সমাদৃত। লাইব্রেরি অব বাংলাদেশ শীর্ষক অধিবেশনে অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহানের বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস নিয়ে স্মৃতিচারণমূলক বইয়ের মোড়ক উন্মোচিত হয়। মাহফুজ আনামের সঞ্চালনায় মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ব্যারিস্টার কামাল হোসেন। তিন প্রথিতযশা ব্যক্তিত্বের কথোপকথনে উঠে আসে তাদের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ও বাংলাদেশের ইতিহাস। ‘আনপ্লাগড’ শীর্ষক সেশনে সঙ্গীত পরিবেশন করেন আরমিন মুসা ও জয়িতা খান। দিনে শেষের আকাক্সিক্ষত একটি অধিবেশনে ছিল ভারতীয় লেখক ও সাংবাদিক শোভা দে’র আলোচনা। অন্তরা গাঙ্গুলীর সঞ্চালনায় তিনি নারীবাদ নিয়ে আলোচনা করেন। নারীর অবস্থান ও বাস্তবতা নিয়ে সরাসরি প্রশ্নের উত্তর দেন। নিজস্ব অভিমত তুলে ধরার পাশাপাশি ভারত সরকারের সাম্প্রতিক কার্যক্রম নিয়ে তিনি যে টুইট করেন সেটি নিয়েও আলোচনা করেন। আজ শনিবার শেষ হবে আন্তর্জাতিক এই সাহিত্য উৎসব। দেশের সাহিত্যকে বিশ্ব দরবারে তুলে ধরতে এই ফেস্টের আয়োজন করেছে যাত্রিক। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় সহযোগী আয়োজক হয়েছে বাংলা একাডেমি।
×